পুরুষ চাহিবামাত্র প্রস্তুত থাকা নারীর জীবন
আঞ্জুমান রোজী।। আমার শরীর, আমার সিদ্ধান্ত- এমন কথা বলার প্রয়োজন হয়, আসে শুধু নারীর ক্ষেত্রেই। কারণ যুগ যুগ ধরে নারী নিজের উপর কোনো অধিকার খাটাতে পারে নাই। নারীর জন্ম হয় অন্যের জন্য। জন্ম থেকে নারীকে তৈরি করা হয় কীভাবে অন্যের উপর নির্ভর করে চলতে হয়। নারী কোনোকিছু বোঝে না, জানে না। নারীর কোনো বুদ্ধি নেই, মেধা নেই, নারী কোনো সিদ্ধান্ত নিতে জানে না- এমন মানসিকতা নিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে জন্ম থেকে অথর্ব, অবলা বানিয়ে ছাড়ে। এই দৃশ্য আদিকাল থেকে শুরু হলেও বর্তমান সময়ে সভ্যতার চরম শিখরে এসেও নারী তার মেধা, মনন এবং ব্যক্তিত্ব দিয়েও আজ পর্যন্ত তার নিজের উপর নিজের সম্পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না।
বর্তমান সময়ে সঙ্গী নির্বাচনে যতই মন-মানসিকতার জায়গায় গুরুত্ব দেওয়া হোক না কেন, পরবর্তীতে সম্পর্কের গভীরতায় যখনই যায় তখন নারীকেই তার নিজেকে সম্পূর্ণ সপে দিতে হয়। যে নারী, সে যতই পুরুষের চাহিদা মতো হবে ততই তাদের সম্পর্ক সুন্দর থাকবে। পুরুষ চাহিবামাত্র নারীকে প্রস্তুত থাকতে হবে।আমি জানি না এটা পুরুষের সহজাত প্রবৃত্তি কিনা! তবে পুরুষের মানসিকতাই এমন। যত বড় বুজুর্গ, পণ্ডিতই হোক না কেন, সব পুরুষের মানসিকতাই হলো শরীরের কারণে নারী তার অধীনে থাকবে। এখানে কোনো শিক্ষাই পুরুষের এই মানসিকতা বদলাতে পারে না। এমন চিত্র প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে সমাজের সব স্তরে বিরাজ করে। অবশ্য উন্নয়নশীল দেশে এর আধিক্য বেশি। নারী যত বড় শিক্ষিতই হোক না কেন, শরীরিক ব্যাপারে নারীর কোনো অধিকার থাকে না।
কিছুদিন আগে টরন্টোর এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলাম। তখন সে বললো, তারই এক ঘনিষ্ট বন্ধু বলছে, ‘নারী হচ্ছে পুরুষের আমানত।’ আমি একটু ধাক্কা খেয়ে বললাম, ‘নারী আমানত হয় কেমন করে?’ আমার বন্ধুটিও বিষয়টি নিয়ে ভাবছে। আমিও ভাবছি। পৃথিবীর এমন এক উন্নত দেশ, যেখানে সবক্ষেত্রে নারীপুরুষের অধিকারের সমতা বিদ্যমান; ঠিক সেই দেশে বসে এমন রক্ষণশীল মানসিকতা কীভাবে লালন করে? আর আমানত কী? কে সেই পুরুষের কাছে এই নারীকে আমানত হিসেবে দিয়েছে? এটা কীভাবে সম্ভব? আমানত বলতে কী বুঝায়? আমি যেটা জানি, অন্যের জিনিস যত্ন করে দেখেশুনে রাখা, এবং নির্দিষ্ট সময়ের পর তা ফেরত দিয়ে দেওয়া। এক্ষেত্রে নারী কীভাবে আমানত হয়? একটা জলজ্যান্ত মানুষ এই নারী একটা পুরুষের আমানত কীভাবে হয়? নারী কি বস্তু?
ধর্মীয় দৃষ্টিতে নারী যে কী, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে সবই যেন নারীকে কীভাবে বেঁধে এবং নজরদারি করে রাখা যায়, তারই প্র্যাকটিস চলে। সব ওয়াজ মাহফিলে তাই তো বয়ান হয়। আর পুরুষরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে তা গিলতে থাকে। এতে পুরুষের আনন্দই বটে। নারীকে হাতের মুঠোয় রেখে পুরুষ তার ইচ্ছেমতো ময়ান করবে। এখানে নারীর কোনো ইচ্ছাই থাকবে না। অর্থাৎ নারী কোনো মানুষই না। নারীর শরীরের উপর তার নিজের অধিকার থাকে না বলে, এক পর্যায়ে সেই নারী মনোবৈকল্যে ভুগতে থাকে এবং ধীরে ধীরে শারীরিক রোগাক্রান্ত হয়ে জীবযাপন করে। বলতে গেলে অনেকটা করুণার পাত্রী হয়ে অন্যের গলগ্রহ হয়ে বাঁচে।
একদিকে নারীর ব্যাপারে পুরুষের রক্ষণশীল মানসিকতার আগ্রাসীভাব। আরেকদিকে নারীও জেগে উঠছে তার শিক্ষা, মেধা এবং ব্যক্তিত্ব দিয়ে। নারী বুঝতে পারে তার নিজেকে, বুঝতে পারে ভালো লাগা, মন্দ লাগা। নারীও পারে তার নিজ ইচ্ছায় নিজের মতো জীবনযাপন করতে। এখানে শরীরিক বিষয়গুলিও নারী পারে নিজের মতো করে প্রকাশ করতে। শরীরী বৃত্তিতে নারীকেই যেহেতু যুগ যুগ ধরে পুরুষের হাতের ক্রীড়নক হয়ে থাকতে হয়েছে সেহেতু নারী এখন ঠিকই বুঝে নিয়েছে, কীভাবে তার কতটুকু একটা পুরুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা রাখে। যদি সেই নারীর আত্মবিশ্বাস থাকে চুড়ান্তরূপে তাহলে তার নিজের শরীরের অধিকার নিজের মধ্যে রাখতে সক্ষম হবে। সম্পর্কের বাতাবরণে দুজন দুজনার কাছে সমর্পিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নারীর জানতে হবে তার নিজের শরীরের উপর তার অধিকার পুরোটা। সিদ্ধান্ত নেবার মালিক সে। সেই প্রেক্ষিতে আজকের সময়ে বলতেই হয়, ‘আমার শরীর, আমার সিদ্ধান্ত’।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]