নারী নেতৃত্বের গোপন অস্ত্র: আইকিউ না ইকিউ? [শেষ পর্ব]
ক্যামেলিয়া আলম।। দাবা খেলায় রাজা মূখ্য হলেও রাজাকে প্রোটেকটেড করা সামনের সাদাসিধা সোলজারও কিন্তু কম গুরুত্ব রাখে না! তাবৎ প্রাণিকূলের সাথে ইন্টারকানেকশন, রিলেশনশিপ তৈরি না করা গেলে আমরা টিকে থাকতে পারি না। ফলে নিজের প্রয়োজনেই অপরের সাথে আমাদের সম্পর্ক গড়া লাগে। মূলত ব্যক্তির সফলতা নির্ভর করে সে কতটা অন্যের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক গঠনে ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তা পরিবারই বলি আর প্রতিষ্ঠানেই বলি। ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স থাকলেই যা সম্ভব।
এক গবেষনাগারে ৭০ জন বিজ্ঞানীকে নিয়ে এক ব্যক্তি দেশের এক যুগান্তকারী আবিষ্কারে ব্যস্ত। কাজটি প্রায় শেষ পর্যায়ে বলে কাজের প্রচণ্ড চাপ। এর মাঝে একদিন এক বিজ্ঞানী বসের কাছে সাড়ে ৫টার দিকে চলে যাবার অনুমতি নিতে এলেন। যেহেতু কাজের ডেডলাইন, সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কাজেই আগাম ছুটি দেয়াটা কিছুটা ঝামেলার। বস তাই ছুটির কারণ জানতে চাইলেন। বিজ্ঞানী ইতস্তত ভঙ্গীতে জানালেন, তার তিন সন্তানকে নিয়ে এক একজিবিশনে যাবার প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে তার। প্রতিষ্ঠানের কাজ গুরুত্বপূর্ন হলেও পরিবারের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতির গুরুত্ব বিবেচনা করে সাথে সাথেই অনুমতি দিলেন উর্ধ্বতন ব্যাক্তি। নিশ্চিন্ত মনে কাজে ডুবে গেলেন বিজ্ঞানী। কাজ শেষের এক পর্যায়ে সময় দেখে চমকে উঠে দেখেন ঘড়ির কাটা আটটা পেরিয়ে গেছে। হতভম্ব হয়ে দ্রুত বসের রুমে বিদায় জানাতে আর কাজের বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শোনেন বস বেশ আগেই আজ বেরিয়ে গেছেন। সে বেশ কুণ্ঠা নিয়ে বাড়িতে ফিরে দেখেন তার স্ত্রী ম্যাগাজিন নিয়ে লিভিংরুমে বসে পড়ছেন। ভীত হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাতেই তাকে আশ্চর্য করে দিয়ে স্ত্রী প্রশ্ন করলেন তিনি কফি খেতে চান নাকি সরাসরি ডিনার করবেন? বিজ্ঞানী বিস্মিত। কোন রকমে জানালেন কফিই বেটার। এরপর আশেপাশে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, বাচ্চারা কই? তার স্ত্রী বললেন, কেন জানো না তুমি? তোমার বস এসে বাচ্চাদের নিয়ে গেছেন একজিবিশনে। এবার তার অবাক হবার পালা। ঘটনাটা এমন ছিল যে, সাড়ে ৫টার দিকে বস যখন দেখেন বিজ্ঞানী বিদায় জানাতে আসছেন না, তখন উনিই যান স্মরণ করিয়ে দিতে। গিয়ে দেখেন বিজ্ঞানীর চোখ গভীর মনোযোগ দেয়া যন্ত্রে। তখন তাকে আর কিছু না বলে সোজা চলে যান তার অধস্তনের বাসায়। কারণ বাচ্চাদের দেয়া বাবার প্রতিশ্রুতি যেন না ভাঙ্গে।
যে বসের গল্প আমি বললাম, উনি কে অনুমান করতে পারেন? উনি ভারতের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট এ. পি. জে. আবদুল কালাম। বলে দিতে হয় না যে, এই সুপার সেনসিটিভ বস ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্ট। একজন আই কিউ সম্পন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের জন্য কার্যকর সন্দেহ নাই। তবে ইকিউ (ইমোশলনাল কোয়েন্ট) সম্পন্ন বস ছাড়া প্রতিষ্ঠান টিকে থাকে না। এ এখন প্রমাণিত। আর নারী নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক এ কারণেই এগিয়ে যাচ্ছে। তবে সব নারী আবার এই গুণাবলী অর্জন করতে পারে না। তাদের জন্য আর অ্যারোগেন্ট বসদের জন্য কিছু সাদামাটা নিয়ম তুলে ধরলাম যার চর্চা তাকে এক অনন্য বস হিসেবে বদলে দিতে পারে। নিজেকেও জানাই। আগে জেনে নেই কোন বৈশিষ্ট্য থাকলে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স কম আছে মনে করা হয়।
ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্ট হবার পথে বাধার কারণ-
দ্রুত স্ট্রেসড
নিজের কথা স্পষ্ট বলতে ব্যর্থ
নেতিবাচক আবেগ ( ফ্রাস্ট্রেশন, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি) নিয়ন্ত্রনে ব্যর্থ
অনুমানের উপর ভিত্তি করে কারও প্রতি তীব্রভাবে আক্রমণাত্মক অবস্থান
প্রতিহিংসাপরায়ণ
কোন ভুল একসেপ্ট না করা
ভুল বোঝাবুঝি না কমিয়ে বাড়ানো
কোথায় আবেগের রাশ টানতে হবে বুঝতে ব্যর্থ
‘আমার রাগ নাই’– এমন ভাব নিয়ে থাকা
সারাক্ষণ অন্যকে দোষারোপ
নিজেকে অন্যের কাছে হাস্যকরভাবে উপস্থাপন
ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স বাড়াতে যে গুণাবলী প্রয়োজন –
চারপাশে ইতিবাচক মানুষ রাখা
কাজ শুরুর আগে অন্তত দুইবার পড়া
শোনার অভ্যাস গড়া
ভুল থেকে শিক্ষা অর্জন
অবসরে ভালো কাজের চর্চা- মেডিটেশন, বেড়ানো, ভালো গান শোনা
নিয়মিত পাঠচর্চা রাখা
মানসিক বিষয় নিয়ে প্রফেশনাল কারও পরামর্শ নিয়মিত নেয়া
একজন সফল উদ্যোক্তা হতে হলে–
১. নিজেকে আগে জানা প্রয়োজন। সক্ষমতা অক্ষমতা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা।
২. আবেগ গোপন না করে অকপটে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে প্রভাবিত করা
৩. আত্মসচেতনতা অর্জন। তার আচরণ অন্যকে কী প্রভাব বিস্তার করছে তা বোঝার সক্ষমতা।
৪. অন্যের জায়গায় নিজেকে ভেবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা
৫. যে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিজে কতটা যোগ্য তার এক প্রাক ধারনা।
৬. পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া –
– জগতের জটিলতাকে একসেপ্ট করা
– ব্লেইম গেইমের চেয়ে কারণ খোঁজা
– অনুসন্ধানী মন
– কাজের ফোকাস ঠিক রাখা। মনোযোগী হওয়া
– ইতিবাচক মানসিকতা
৭. আন্তঃব্যাক্তিক সীমানা নির্ধারন
৮. মতামত, আলোচনার পরিবেশ বজায় রাখা
৯. ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স বাড়াতে অন্যকে উৎসাহিত করা
বিষয়গুলো খুব জটিল না আবার খুব সহজসাধ্যও না। আমাদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ আমাদের গুণাবলী তৈরিতে সাহায্য করে। আমাদের রুচি, অভ্যাস গড়ে ওঠার পেছনে জেনেটিক কারণ যেমন দায়ী থাকে, তেমন দায়ী থাকে পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান। পরিবার অ্যারোগেন্ট, অ্যাগ্রেসিভ হলে সেই পরিবেশে বেড়ে ওঠা সন্তানটি হয় ভীরু, কাপুরুষ। আর একইভাবে দুর্বলের উপর অত্যাচারী। নিজের অক্ষমতা ঢাকতে আক্রমণাত্মক যেমন থাকে, তেমনই অন্যের সামান্য ভুলকেও একসেপ্ট না করার মানসিকতা দেখা যায়। আবার কোন শিশু যখন সহনশীলতা, সততা, কর্তব্য আর নিষ্ঠা দেখে বড় হয়, তার মাঝে অন্যের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা জন্মায়। সেই শিশুটি পরবর্তী জীবনে নিজের প্রতি আস্থাশীল থেকে প্রতিষ্ঠানের উন্নতি করতে পারে। ইতিবাচক, কম্প্রোমাইজিং মানে কিন্তু আবার অন্যায় সহ্য করার চেষ্টা না, বরং অত্যন্ত সততার সাথে, সহনশীলতার সাথে কাজ করে যাওয়া। মনে রাখতে হবে, আইকিউ ই না, ইকিউ ছাড়া সফল কখনও হওয়া যায় না। যত গলার জোরই আপনার থাকুক না কেন!
[সমাপ্ত]
নারী নেতৃত্বের গোপন অস্ত্র: আইকিউ না ইকিউ? [পর্ব – ০১]
নারী নেতৃত্বের গোপন অস্ত্র: আইকিউ না ইকিউ? [পর্ব – ০২]