September 20, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

পিডোফিলিয়া, অশালীন মন্তব্য ও আমরা

কায়সুল খান।। সম্প্রতি সাকিব-শিশির দম্পতির জেষ্ঠ্য কন্যা আলাইনার একটি ফটো আপলোড করা হয় শিশিরের ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেইজে। আলাইনা সেই ছবিতে একটি সূর্যমুখী বাগানে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। অত্যন্ত চমৎকার সেই ছবিতে অনেকেই আলাইনার প্রশংসা করেছেন। কিন্তু ৪/৫ জন ব্যক্তি অত্যন্ত আপত্তিকর মন্তব্য করে বসে সেখানে। শিশু আলাইনাকে নিয়ে যৌন সংশ্লিষ্ট সে সব বক্তব্য ভীষণ অরুচিকর এবং কার্যত অভব্যতার নামান্তর।

আমরা জানি অপ্রাপ্তবয়ষ্ক শিশুদের প্রতি যৌনকাতরতাকে পিডোফিলিয়া বলে। এটি একটি মানসিক অসুস্থতা। একই সাথে পিডোফিলিয়া একটি অপরাধ। পৃথিবীর সব দেশেই এই রোগে আক্রান্ত কিংবা এই অপরাধে অপরাধী মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়। তবে উন্নত বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের পার্থক্য হল সেখানে অপরাধীকে শাস্তি দেয়া হয়, একই সাথে প্রতিকারের উদ্দেশ্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করা হয়।

সাকিব-শিশির কন্যার ছবিতে নেতিবাচক ও অশালীন কমেন্টকারীরা নারী/পুরুষ যাই হোক না কেন তারা যে পিডিফিলিয়ায় আক্রান্ত এটা সুস্পষ্ট। না হলে মাত্র ৫ বছর বয়সী একটি শিশুর ছবিতে এ ধরণের মন্তব্য আসত না। পিডিফিলিয়া আগেও ছিল বাংলাদেশে। তখন পরিবারের সদস্য, শিক্ষক কিংবা বড় ভাই শ্রেণির কারও দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে শিশুরা। আর এখন এটা প্রকাশ্যে বলার সাহস পাচ্ছে অপরাধীরা। তাই ফেসবুকের মত ওপেন প্লাটফর্মে আলাইনার প্রতি অশালীন মন্তব্য ছুড়ে দিতে পেয়েছে কিছু মানুষরূপী জানোয়ার।

আলাইনার ছবিতে নেতিবাচক মন্তব্য একই সাথে এ সমাজে যৌন অবদমনের বিষয়টিও সামনে নিয়ে আসে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ান দেশগুলোতে যৌনতাকে ট্যাবু হিসেবে দেখা হয়। ফলে প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষ এখানে প্রিয়জনের সাথে স্বাভাবিক যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হতে সামাজিকভাবে বাধা পান। বদ্ধ পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণে তাদের মাঝে নিষিদ্ধের প্রতি এক ধরণের আকর্ষণ জন্ম নেয়। ফলে শিশু, প্রাপ্তবয়ষ্ক কিংবা বৃদ্ধা- সকলকে যৌনবস্তু হিসেবে দেখতে শুরু করে তারা। বাংলাদেশে পাটক্ষেত কিংবা লিটনের ফ্ল্যাট একটি অশালীন ইঙ্গিত বহন করে। যেহেতু এই দেশে স্বাভাবিক যৌনতার সুযোগ সীমিত তাই মানুষ গোপনে এসব যায়গায় যায়। অনেক সময় নারীকে ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির জন্যও ব্যবহৃত হয়ে এসব স্থান। আলাইনার ছবির মন্তব্যে অশালীন ইঙ্গিত প্রমাণ করে কতটা যৌন বিকৃতি ঘটেছে এদেশের মানুষের মাঝে।

আমরা প্রায়ই বাংলাদেশের সংবাদপত্র, টেলিভিশনে নারী ও শিশু ধর্ষণের সংবাদ দেখতে পাই। সাম্প্রতিক সময়ে ছেলে শিশুকে বলাৎকারের সংবাদও ব্যাপকভাবে উঠে এসেছে। প্রকাশিত এই সংবাদের বাইরেও আড়ালে থেকে যায় অনেক নির্যাতন, ধর্ষণের ঘটনা। সামাজিক লজ্জা নামক এক উদ্বায়ু বস্তুর ভয়ে অভিযোগ দায়ের করেন না অনেকেই। আবার পুলিশ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দুর্নীতির ফলে আদালতে অধিকাংশ কেইসই প্রমাণের অভাবে খারিজ হয়ে যায়। নিম্ন আদালতের রায়ে অপরাধী শাস্তি পেলেও উচ্চ আদালতে আপিল করে অনেক প্রভাবশালী অপরাধী মুক্তি পেয়ে যায়। এই যে ভিক্টিমের লোকলজ্জার ভয়, সামাজিক অসম্মানের ভয়, এই যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এগুলোই বাংলাদেশকে আজ ধর্ষণের, যৌন অপরাধের অভয়ারণ্য বানিয়েছে। অথচ লজ্জা পাওয়ার কথা অপরাধীর, ধর্ষক নামের নিকৃষ্ট প্রাণিগুলোর। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হল বাংলাদেশে ক্ষমতার প্রভাব ও অর্থ থাকলে ধর্ষণের মত অপরাধ করেও অনেকে বুক উঁচু করে হেটে বেড়ায়।

সাকিব-শিশিরের কন্যার প্রতি আপত্তিকর মন্তব্যের ব্যাপারটি আরও একটি দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। সাকিব বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনবান ক্রীড়ানক। খেলাধূলার আয়ের বাইরেও তার ব্যবসা থেকে প্রচুর আয় আসে। তার স্ত্রী শিশির সাবেক মডেল এবং একজন আমেরিকান গ্রীনকার্ড হোল্ডার। ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সাকিব-শিশিরের প্রতি বিদ্বেষ দেখানোর মানুষের অভাব নেই। সাকিব কিংবা শিশিরের সামাজিক মাধ্যমগুলোতে আপলোডকৃত বিভিন্ন ছবির নিচের কমেন্ট পড়লেই সেই বিদ্বেষ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সাকিব-শিশিরের অপ্রয়োজনীয় সমালোচনায় মেতে ওঠেন। যা শুধু আপত্তিকরই নয়, অনাকাঙ্ক্ষিতও  বটে।

বাংলাদেশ তথাকথিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দেশ, তবে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের অধিকাংশই ধর্ম সম্পর্কে লেখাপড়া করেন না। তারা মসজিদ, মক্তব ও অন্যের কাছ থেকে শুনে মুসলমান। অশিক্ষিত, কুশিক্ষিতের পাশাপাশি শিক্ষিত শ্রেণির মানুষও এই দেশে ধর্মভীরু। তাদের অধিকাংশই অন্যের ধর্ম পালনের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নয়। তাই তাদের পছন্দমত করে ধর্মপালন করতে যত্রতত্র আহ্বান জানায়। সাকিব-শিশিরও এদের কবল থেকে নিস্তার পান না। সাকিব কিংবা শিশিরের বিভিন্ন পোষ্ট বা ছবির নিচে এই শ্রেণির বক ধার্মিকদের মন্তব্যে তা সুস্পষ্ট হয়। সেখানে ধর্ম পালন, পর্দা করা কিংবা পোশাক কী পরতে হবে ইত্যাদি ব্যাপারে সাকিব-শিশিরকে উপদেশ দেয়া হয়, যা অন্যের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। এই দম্পতির মত সমাজের উচ্চ শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করা মানুষকে যদি এত বিকৃতি সহ্য করতে হয় তবে সাধারণ মানুষের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।

স্বস্তির সংবাদ এই যে ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিট স্বপ্রণোদিত হয়ে অশালীন মন্তব্যকারীদের প্রতি ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আমরা আশাকরি অচিরেই তারা অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে আদালতের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিতের নেবে।

তবে অস্বস্তির সংবাদ হল, আলাইনার মা শিশির এ ঘটনায় অভিযুক্তদের নিয়ে সামাজিক মাধ্যম ও পত্রপত্রিকায় ব্যাপক আলোচনাকে ভালোভাবে নেননি। তিনি পুরো বিষয়টিকে তার ব্যাক্তিগত সেলিব্রিটি ইমেজের সাথে জড়িয়ে ফেলে একটি অদ্ভুত আত্মকেন্দ্রীক পোস্ট দিয়েছেন। শিশিরের এই আচরণ অপরাধীদের এ ধরণের অপরাধে আরও উদ্বুদ্ধ করবে। কোন্ সে অজ্ঞাত কারণে আলাইনা ইস্যুতে প্রতিবাদকারী সচেতন মানুষের  প্রতি শিশিরের শ্লেষ ঝরে পড়েছে তা আমাদের বোধগম্য নয়। হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশে বসবাস করে বাংলাদেশের বর্তমান সংকটজনক অবস্থা সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল নন। কিংবা কে জানে, হয়তো তার মানসিক বিকাশ জরুরি। বা হয়তো তিনি জেগেই ঘুমোচ্ছেন।

আমরা আশা করি নারী ও শিশুর মত সংবেদনশীল সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে শিশির ভবিষ্যতে দায়িত্বশীল আচরণ করবেন।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]