নারী কি রহস্যের আধার, নারী কি এলিয়েন, নারী কি শয়তান?
তারেক আজিজ বাপ্পী।। আমাদের সমাজে আজও দেখা যায় পুরুষের সাথে প্রেমের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অধিকাংশ নারী প্রেমের ভান (Flirt) করতে পছন্দ করে। এর মধ্যে থাকে নানা প্রকার লুকোচুরি, ছলচাতুরি আর অপ্রয়োজনীয় ও অনর্থক লাজুকতার অভিনয় ইত্যাদি। দেখা গেল কোন পুরুষকে সবুজ সংকেত দিয়ে তার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে, আবার পরমুহূর্তেই তেমন কোন কারণ না দর্শিয়েই লাল সংকেত দিয়ে প্রত্যাখ্যান করছে। আবার দেখা যায় একই সাথে একাধিক ছেলেকে ভালোবাসার আশা দিয়ে ঝুলিয়ে রাখছে। এমনকি তার দেহকে প্রধানতম করে রূপের মায়াজালে ভুলিয়ে পুরুষের থেকে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধাও হাতিয়ে নিচ্ছে। এর মধ্যে আরো আছে- ধরা যাক কোন ছেলে একটি মেয়েকে খুব পছন্দ করে, এখন সে (ছেলে) নানাবিধ উপায়ে মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে; যেমন হতে পারে সোস্যাল মিডিয়ায় মেয়েটির প্রতিটি পোস্টে সে লাভ-কেয়ার ইত্যাদি রিয়্যাক্ট দিচ্ছে, ভেবেচিন্তে সুন্দর-গঠনমূলক কমেন্ট করারও চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে মেয়েটির ‘হ্যাঁ’ও না-‘না’ও না অবস্থা। অর্থাৎ সে বুঝেও না বোঝার ভান করছে এক্ষেত্রে। একজন মানুষ যে তাকে ভিন্নমাত্রায় গুরুত্ব দিচ্ছে সেখানে তার কোন সুদৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করতে মেয়েটি ব্যর্থ হচ্ছে। দিনশেষে সে আবার নাটক করে বলছে ‘কই তুমি তো আমাকে মুখফুটে কোনোদিন বলোনি’! অথচ এখানে তার অবস্থানটা হতে পারত ছেলেটির সবকিছু ভালভাবে জেনেশুনে ভাল লাগলে ‘হ্যাঁ’ বলে দেয়া আর ইতিমধ্যে সে অন্য কারোসাথে সম্পর্কে থাকলে বা ইচ্ছা না থাকলে তাও সরাসরি (বোল্ডভাবে) বলে দেয়া (এবং ফেসবুকে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস ‘সিঙ্গেল’ প্রদর্শন না করা)। এতেও ছেলেটির বোধোদয় না হলে তাকে সোজা ব্লক দিয়ে দেয়া। এভাবে অপছন্দনীয় কারো থেকে হ্যারাসমেন্টের শিকার হওয়া থেকে শুরুতেই নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়া যায়। (কাউকে মায়াজালে ফেলে ধোকা দিয়ে তার এবং নিজের মুল্যবান সময় নষ্ট না করা, এগুলো একধরনের সততা ও মানসিক পরিপক্কতা যা ছেলে-মেয়ে সবার জন্য অনুসরনীয়। সেটা ভিন্ন আলাপ, আরেকদিন করা যাবে।)
নারী কেন এত দোদুল্যমানতায় ভোগে এসব ক্ষেত্রে, সহজ বিষয়কে সে কেন জটিল আর রহস্যময় করে তোলে, সে কেন নিজেকে প্রতিনিয়ত প্রবঞ্চক হিসেবে পরিচিত করে তোলে? উল্লেখ থাকে যে, এসব স্থূল আচরণ যে পুরুষেরা করে না তা কিন্তু না। তবে নারীদের তুলনায় পুরুষের অনুপাত কম। সেটা এজন্য যে, পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোতে এই ঘৃণ্য কাজ মূলত নারীর জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে (ফ্লারটিং এর প্রচলিত বাংলা পরিভাষা দেখা যাচ্ছে ‘ছেনালীপনা’ যা একটি স্ত্রীবাচক শব্দ)। আর পুরুষ এসব করলেও এখানে তার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম যতটা না ক্ষতি হয় নারীর ক্ষেত্রে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে এসব আচরণকে নারীত্বের বৈশিষ্ট্য হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে এবং এগুলোকে স্বাভাবিক করে তোলা হয়েছে। তাই সমাজের সিংহভাগ নারীর এসব অস্বাভাবিক আচরণের ফলে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে নারী কি তাহলে রহস্যে মোড়া এলিয়েন টাইপের কোন জীব যার কূলকিনারা করা যায়না, নারী কি শয়তানের রূপ?
প্রথমত, এরূপ স্থূল আচরণ প্রাকৃতিকভাবে নারী চরিত্রে আসে না। বরং এর প্রায় পুরোটাই সামাজিক প্রতিবেশের প্রভাবে তার মধ্যে গেঁড়ে বসেছে। এর পিছনে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামো, একইসাথে যার শিকারও এই শ্রেণির নারী আবার এটি টিকিয়ে রাখার পিছনেও অন্যতম নিয়ামক তারা। অর্থাৎ সমাজের অধিকাংশ নারীই অজ্ঞাতে এই ব্যবস্থার সমর্থনদাতা। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যখন নারীকে কেবলমাত্র পণ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে তখন তার (নারীর) আচরণও হচ্ছে পণ্যের বিক্রেতা বা ব্যবসায়ীসূলভ। পণ্যের বিক্রেতা যেমন তার পণ্য সর্বাধিক লাভে বিক্রির আশায় নানা ক্রেতার কাছে নানাভাবে উপস্থাপন করে, পণ্যকে যেমন সে নানা কৌশলে রহস্যময় ও ক্রেতার আগ্রহের বিষয়বস্তুতে পরিণত করে, আবার অসাধু ব্যবসায়ী যেভাবে এক্ষেত্রে নেয় নানা ছলচাতুরীর আশ্রয়; নারীও ঠিক একই ভূমিকা নিয়ে থাকে এই ব্যবস্থায়। সে তার দেহকে পণ্য করে তুলে বিক্রেতা বনে যায়। অথচ সে ভুলে যায় বা বোঝেনা যে এই পুরুষশাসিত কাঠামোতে তার গোটা অস্তিত্বটাই পণ্যস্বরূপ। সে বোঝেনা যে এখানে তাকে মানুষ হিসেবে ভাবাই হয়না বা ভাবলেও অপূর্ণাঙ্গ মানুষ ভাবা হয়।
তাহলে এই অবস্থার সমাধান বা প্রতিকার-প্রতিরোধের উপায় কি? সহজ কথায় তা হল, পুরুষতান্ত্রিক-লিঙ্গআধিপত্যবাদী-বৈষম্যমূলক সমাজকাঠামো ভেঙ্গে দিয়ে নারী-পুরুষের যৌক্তিক সমঅধিকার ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ করা। সেটা কিভাবে সম্ভব? এমন একটা সমাজ কি নারী পুরুষতন্ত্রের কাছে ভিক্ষা চায় নাকি উপহার হিসেবে চায়? ভিক্ষা হোক আর উপহার, এরকম কিছু আশা করা বোকামিপূর্ণ দিবাস্বপ্ন ছাড়া কিছুই না। বরং সমানাধিকারের এমন সমাজ পেতে চাইলে নারীকেই স্বপ্রোনোদিত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আর তার জন্য নারীকে জানতে হবে অজানাকে, চিনতে হবে অচেনাকে। সমাজ ও ধর্ম নির্ধারিত সিলেবাসের বাইরে তাকে জানতে হবে ভক্তিহীনভাবে। সহজ কথায় প্রকৃত শিক্ষা ও জ্ঞ্যান-বিজ্ঞানের চর্চাই নারীকে মুক্তির পথ দেখাবে। নারী হবে আত্মবিশ্বাসী। তখন নারী অধিকার ও প্রগতিবিরোধীদের মুখে কালিমা লেপন করে দিয়ে প্রমাণিত হবে যে, নারী কোন রহস্যময় কিছু নয়; নারী এলিয়েন নয়, নারী নয় শয়তানী মস্তিস্কধারী। নারী কেবলই মানুষ, ঠিক পুরুষেরা যেমন।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]