কোভিড এর সময়টাকে মনে রেখে দেব যত্ন করে
নাজিয়া হোসেন অভি।। রেগে গিয়ে বা ব্যর্থতায় অনেকেই বলেন- ‘আমার জন্মের শিক্ষা হয়েছে, আর না’।
২০২০ আমাদের জন্য জন্মের শিক্ষার সময়। ঠিক এই অর্থে কিনা বলতে পারছি না তবে ইংরেজিতে বোঝানোর মতো সুন্দর শব্দ আছে একটা- ‘লাইফ লেসন’। ২০২০ আমাদের জন্য এই লাইফ লেসনের সময়। বছরের গোড়ার দিকেও পছন্দ মতো সবকিছু বেছে নেবার, স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবার, অসচেতন হবার, এমনকি অসচেতন হয়ে হাজারটা ভুল করে সেটাকে পাত্তা না দেয়ার অবাধ স্বাধীনতা ছিলো। কিন্তু বছরের এই শেষ ভাগে এসে কতকিছু যে নতুন করে শিখতে হলো, হচ্ছে, তার হিসেব কষতেই হিমশিম অবস্থা।
প্রয়োজনের সংজ্ঞাই বদলে গেলো পুরোটা। বন্ধু, আড্ডা, একসাথে হাজার মানুষের ভিড়ে মিশে গিয়ে উল্লাস- সব আগের জন্মে দেখা স্বপ্নের মতো। এই ১৮০ ডিগ্রি কোনে উল্টো হাঁটতে শুরু করার আগে পৃথিবী বড় বেশি ছিল ব্যস্ত, ছিল আত্মকেন্দ্রিকতায়। যা আছে থাক, আরো চাই। আরো জমিয়ে রাখতে হবে, মজুত করতে হবে ভবিষ্যতের জন্য। হোক তা অর্থবিত্ত, হোক সম্পদ, হোক কোনো বিশেষ ব্রান্ডের পোশাক, ঘড়ি, জুতো, ব্যাগ। সব চাই সব কারণ এগুলোই তো এ যুগে যোগ্যতা বিচারের একমাত্র মাপকাঠি। আমাদের জীবনটা ছিল যেন বোকা ইভানের জীবন। ঈশ্বরের বরপ্রাপ্ত ইভান যতদূর দৌড়োবে সবটা জমি তার। বোকা ইভানের মতো আমরা শুধু দৌড়েই গেছি। সূর্যাস্তের আগে ফিরতে হবে সেটা ভুলে গেছিলাম সবাই, তাই যার হাতে রিমোট কন্ট্রোল তিনি পজ বাটন হিসেবে কোভিড-১৯ পাঠিয়ে দিলেন। থমকে গেলো গোটা পৃথিবী।
খুব ছোটবেলায় আমার ডরোথি টিচার নামের একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি যতক্ষণ পর্যন্ত আমাকে দেয়া কাজগুলো নিখুঁত না হচ্ছে ততক্ষন পর্যন্ত নানারকম শাস্তি, ভয়, যন্ত্রনা দিতে থাকতেন। ভালোবাসতেন খুব কিন্তু tough love কী জিনিস সেটা তিনি হাড়ে হাড়ে বুঝিয়েছেন। তার কালি কলমের লাল রঙের কালি এখনও চোখের সামনে জ্বলজ্বলে। কোইন্সিকোয়েন্স শব্দটা মাথায় গেঁথে দিয়েছিলেন হাতুড়ি ঠুকে। ভুল করলে তার পরিনাম সইতে হয়। এই ভয়াবহ সময়টাকে আমার ডরোথি টিচারের মতো মনে হয়। পাহাড় পরিমান অসংযম আর অবাধ্য জীবনে প্রথমেই একটা দাড়ি টেনে দিলো এই সময়টা। অত্যাচারের মতো চাপিয়ে দিলো গৃহবন্দী জীবন। মন ছুটে যেতে চায় বন্ধুদের আড্ডায়, দোকানে, হাজার মানুষের ভিড়ে কিন্তু আমার ডরোথি টিচার আমাকে আটকে দিলেন বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে বাঁচতে হলে, বাঁচাতে হলে।
আমার জন্য সব থেকে বড় শেখার জায়গাটা বোধহয় অতীত আর ভবিষ্যতের থেকেও মূল্যবান বর্তমান। জীবন মানে আজ। আমরা আমাদের সাধ, স্বপ্ন, হতাশা, চাওয়া পাওয়া সুখ কষ্ট শঠতা সব কিছু সাথে নিয়ে নিজেদের ভাঙি গড়ি, নিজেদের জন্য একটা মাপকাঠি তৈরি করি, মাথার মধ্যে, কিন্তু সেই জায়গাটা আমার হবে কিনা সেটা আমার বশে নয়, অতীতে যা ঘটছে তা বদলে দেবার ক্ষমতা আমার নেই। ভবিষ্যতে কী ঘটবে তাও আমার নিয়ন্ত্রণে নয়। আমার জীবনর বর্তমানটাই আমি ঠিকঠাক চালিয়ে নিতে পারি।
একা একা কী করে সন্তুষ্ট থাকা যায় সেই চর্চাটাও এই সময়টা করিয়ে নিলো। নিজের গাছ, সবজি বাগান, ফুল, কাঠবিড়ালি, পাখি, সকাল বিকেল ওদের খোঁজ খবর, ওদের খাবার, লেগো, গল্পের বই এই নিয়ে নিজেকে নিজেই ব্যস্ত করে রাখার কি তুমুল আয়োজন। বেহিসাবী রকমের সমাজবদ্ধ আমি শিখে যাচ্ছি নিজের মতো করে নতুন অনুষঙ্গ নিয়ে বাঁচতে।
এখন জীবনে যা কিছু শুভ সেগুলো প্রতিদিন গুনে দেখতে ভালো লাগে। মাথার ওপরে ছাদ , ভাঁড়ারে খাবার, ঘরে বসে কাজ করতে পারার স্বাচ্ছন্দ, যারা ঝুঁকি নিয়ে আমাদের জীবনটাকে সহজ করছেন তাদের জন্য কৃতজ্ঞতা, প্রিয় মানুষগুলো সুস্থতা আর সবার থেকে বেশি ভালো লাগে সুস্থভাবে এখনো নিঃশ্বাস নিতে পাড়ার অনুভূতিটুকু। এই অবাধ্য জেদি মস্তিষ্ক তবুও প্রায়ই আগের জীবনটার স্বপ্ন দেখে, আশাবাদী হয় একদিন সব আগের মতো হবে। জীবন হবে বাঁধাহীন, একছুটে উড়ে গিয়ে পরবাসে ফেলে রাখা কোনো প্রিয়মুখ ছুঁয়ে দিয়ে আসবো। ছুটির দিনে তুমুল আড্ডায় বসবো, গানের জলসায় হেড়ে গলায় গলায় গান গাইবো। অযাচিত অনুষঙ্গ মুখোশটার সাথে আড়ি হবে। ওকে ঘরের কোনে ফেলে রেখে হাসতে হাসতে বেরিয়ে যাবো। কিন্তু ঠিক সেই সময় মাথার মধ্যে আমার ডরোথি টিচার কোভিড-১৯ বলে ওঠে- ‘আমাকে ভুলে যেওনা কিন্তু, আমার আসায় তোমার নিজের সাথে অনেক সময় কাটানো হয়েছে, নিজেকে নতুন করে চেনা হচ্ছে কত। দেখো, বদলে দিলাম পৃথিবীটাকে। একটু দম নেবার ফুরসৎ করে দিলাম। সবাইকে নতুন করে ভাবার সুযোগ করে দিলাম। কত প্রয়োজন যে অপ্রয়োজনীয় দেখিয়ে গেলাম তোমাদের। মনে রেখো এই সময়টাকে’। আমি উত্তর দেই- ‘তোমাকে চলে যেতেই হবে নিশ্চিত, কিন্তু আমি এই সময়টাকে মনে রেখে দেব খুব যত্ন করে। ভালোবেসেই মনে রাখবো, এ যে আমার জন্মের শিক্ষার সময়, আমার লাইফ লেসনের সময়’।