September 20, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

গোড়ায় গলদ রেখে আশাবাদী হয়ে লাভ কী?

তাসনিয়া আল সুলতানা।। নোয়াখালীতে গৃহবধূর উপর নির্মম নির্যাতনের যে  ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, সত্যি বলতে আমি সে ভিডিও এখনও দেখি নি। আমার দেখার সাহস হয় নি। আমি দুর্বলচিত্তের মানুষ। এতো ব্রুটালিটি মস্তিষ্কে ধারণ করার ক্ষমতা আমার নেই। তাই নিউজফিড স্ক্রল করতে গিয়ে বারবার চোখের সামনে ভিডিওটা চলে এলেও স্কিপ করে গেছি। এক সেকেন্ডের জন্যও দেখি নি।

সবার লেখা পড়ে মোটামুটি যা ধারণা পেলাম ওই গৃহবধূ ধর্ষকদের “বাপ” বলে সম্বোধন করার পরও রেহাই পান নি। কখনো তোষক দিয়ে ঢেকে, কখনো উপুড় হয়ে তিনি নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু শেষ রক্ষে হয় নি। শুনলাম ঘটনাটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার আরো ৩২ দিন আগের। এটি যদি ভাইরাল না হতো আমরা কেউ কখনো জানতামই না এ ধরণের একটি লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে গেছে।

তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণ বলবো নাকি অভিশাপ বুঝতে পারছি না৷ যদি তথ্যপ্রযুক্তির ইতিবাচক দিক থেকে দেখি, তাহলে বলবো আজ এর কল্যাণেই এ ধরণের একটি লোমহর্ষক ঘটনা সামনে এসেছে এবং সারা দেশ আজ এই ঘটনার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ছে।

আবার যদি নেতিবাচক দিক দিয়ে দেখি তাহলে বলবো, আজ তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের জীবনের সাথে এতোটাই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে যে কোনো ঘটনা যদি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ভাইরাল না হয় তাহলে সে ঘটনাকে আমরা খুব একটা আমলে নিই না, তা ঘটনার তীব্রতা যত গভীরই হোক না কেন।

সেদিন একটা জরিপে দেখলাম বাংলাদেশে এখন ধর্ষণের হার পৃথিবীর যেকোনো দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি। প্রতিদিন বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে, অথচ আমরা জানতে পারছি শুধু সেগুলোই, যেগুলো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ভিডিও বা খবরের মাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে। ওই যে বললাম, আজকাল কোনোকিছু ভাইরাল না হলে আমরা তা নিয়ে খুব একটা মাতামাতি করি না কিংবা আমলে নিই না।

ধর্ষণের কথা বাদ দিলাম। এমন কোনো মেয়ে কি পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে যে তার জীবদ্দশায় কখনো কোনো পুরুষ দ্বারা মলেস্ট হয় নি? উত্তর হলো পাওয়া যাবে না। আচ্ছা, ধর্ষণ কি শুধু জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? কথার দ্বারা, চোখের বাজে দৃষ্টি দ্বারা, শারীরিক অঙ্গভঙ্গী দ্বারা কত মেয়ের মন দিনের পর ধর্ষিত হচ্ছে সে খবর আমরা কজনই বা রাখি? আমি নিজেও ছোটবেলায় মলেস্টেশনের শিকার হয়েছি। কিন্তু আমার ভাগ্য ভালো যে আমার বাবা মা আমাকে এমনভাবে গড়ে তুলেছেন যে আমি বিনা সংকোচেই তাঁদের সাথে বিষয়টি শেয়ার করেছি, এবং তাঁরা উপযুক্ত পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। কিন্তু আমার মতো কপাল তো আর সবার নয়। কতশত মেয়ে এসব যন্ত্রণা প্রতিনিয়ত সহ্য করতে করতে মানসিকভাবে কুঁকড়ে যাচ্ছে আমরা তা ভেবে দেখেছি কি কোনোদিন? আর যেসব মেয়ে বিয়ের পর  নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামীর সাথে শারিরীক সম্পর্কে যেতে বাধ্য হয়, কিংবা স্বামীর বিকৃত যৌনাচরণ যেসব মেয়ে মুখ বুঁজে মেনে নেয়, সেসব ম্যারিটাল রেইপের  খবর কি রাখি আমরা?

আমাদের সমস্যাটা কোথায় জানেন? একটি মেয়ে জন্মানোর পর থেকে তাকে সমাজের সামনে জবুথবু হয়ে চলার শিক্ষাটা যেমন দিই, ঠিক তেমনি একটি ছেলে জন্মানোর পর তাকে আমরা এমনভাবে গড়ে তুলি যেন পুরুষমানুষ মানেই হলো সমাজের বাদশা। পুরো সমাজেই পুরুষ নামক বাদশাদের রাজত্ব কায়েম থাকবে। বাংলাদেশে খুব কম সংখ্যক পরিবারই আছে যেসব পরিবারে ছেলেদের, মেয়েদের প্রতি সম্মান রাখার শিক্ষা একদম শুরু থেকেই দেওয়া হয়৷ গলদ কিন্তু এই এক জায়গাতেই। যদি শিশু অবস্থাতেই প্রত্যেক পরিবারেই এই শিক্ষা ছেলেদের দেওয়া হয় যে মেয়ে কোনো ভোগের বস্তু, বা যৌনসামগ্রী নয় যে উঠতে বসতে চলতে ফিরতে কখনো কথার দ্বারা, কখনো নোংরা কাজের দ্বারা তার সম্মানে আঘাত হানা যাবে তাহলে আমাদের দেশে ধর্ষণের ঘটনা এভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারতো না। শারীরিক কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে কোনো তফাৎ তো নেই। উভয়ই তো মানুষ। তাহলে কেন একজন মেয়েকে আমরা মানুষ হিসেবে গণ্য করতে পারি না? আমাদের দৈন্য আসলে কোথায়?

দৈন্য হলো আমাদের মন-মানসিকতায়। যতদিন পর্যন্ত না এই মন-মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে না, ততদিনই ধর্ষণ থাকবে, বিকৃত যৌনাচরণ থাকবে, মানসিক অত্যাচার থাকবে। বর্তমানে নোয়াখালীর ঘটনার প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ চলছে। কিন্তু আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে চাই, এসব কর্মকাণ্ডে আমি মোটেও আশাবাদী নই। কারণ আমি জানি সব একদিন ঠান্ডা হয়ে যাবে। সবাই সবকিছু ভুলে যাবে। আবার নতুন কোনো ধর্ষণের ঘটনা ভাইরাল হলে হয়তো কদিনের জন্য আবার  বিক্ষোভ হবে, কিন্তু দিনশেষে সবকিছু সবাই ভুলে গিয়ে যার যার পথে হাঁটা শুরু করবে। কোনো সমাধান হবে না, কারণ আমাদের সামাজিক ব্যবস্থাপনার গোড়াতেই গলদ রয়েছে। যতদিন এই গলদ শুধরানোর চেষ্টা করা হবে না, ততদিন কোন সমাধানেরই পথ মিলবে না।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]