November 23, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

নিজে নিরাপদ থাকুন, সন্তানকেও সঠিক শিক্ষা দিন

প্রীতিলতা।। শুধু নিরাপদ শৈশব কেন? নিরাপদ কৈশোর চাই, নিরাপদ তারুণ্য চাই, নিরাপদ বার্ধক্যও চাই। আমি সভ্য সমাজের মানুষ হিসেবে একটা নিরাপদ জীবন চাই। এটা আমাকে কেউ দান বা দয়া করে দেবে না, এটা আমার মানবিক অধিকার।  এটাই হওয়া উচিত,  এটাই স্বাভাবিক।

আমার নিজের কথা বলি। আজকের এই ‘আমি’ হয়ে ওঠার পেছনে জীবনের যে বছরগুলো, যে সময়গুলো শৈশবে-কৈশোরে পার করেছি; সে সময়গুলোতে খারাপ সময় ছিল, ভীষণ খারাপ সময় পার করেছি। জীবনে Abusing Behaviour এর শিকার হন নি, এমন কোনো মানুষ মনে হয় নেই; তা সে যেমনই হোক। সেটা হতে পারে Toxic relationship অথবা Molestation অথবা Sexual abuse/ harassment  অথবা Toxic Parents অথবা Physical Torture অথবা Domestic Violence। এগুলোর যে-কোনো একটা দুর্ঘটনাই একটা মানুষের জীবনকে, জীবন সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভাবনাকে বদলে দিতে যথেষ্ট।

একটা মেয়ের জন্য তার পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র- কিছুই নিরাপদ না। সব পরিবেশ-পরিস্থিতিতে একটা মেয়ে খুব সহজেই প্রতিকূলতা, সহিংসতা, নির্যাতনের শিকার হতে পারে। শুধু কি মেয়েরা এসবের শিকার?

উত্তর হচ্ছে – না! ছেলে বা মেয়ে, কেউ নিরাপদ না! ছেলে শিশুর নির্যাতনের খবর পত্রিকা খুললেই দেখবেন। আপনি মা অথবা বাবা;  অথচ আপনি নিজেই কিন্তু জানেন না আপনার সন্তান প্রতিদিন কীভাবে কোথায় নির্যাতনের শিকার হচ্ছে!  ভাবলেই কেমন গা শিউরে ওঠে, তাই না?

জ্বি!  বিষয়গুলো এভাবেই ঘটে, চোখের সামনে কিন্তু সবার অলক্ষে! পরিবারের মা/বাবা হয়ে আপনি পারেননি/ আমরা পারি না, আপনার/আমার সন্তানের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করতে। আমরা বাচ্চাদের অনেক কিছু সঠিকভাবে শেখাতে ব্যর্থ হই। একটা ছেলে বা মেয়েকে অনেকভাবে জেন্ডারভিত্তিক আচরণ শেখাই। তুমি ছেলে, সুতরাং এটা এটা তোমার। তুমি মেয়ে, সুতরাং এটা এভাবে তোমাকে করতে হবে। শুধু মানুষ হিসেবে অন্য মানুষের সাথে তার আচরণ কেমন হবে, অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যের মতকে গ্রহণ/বুঝতে পারার ক্ষমতা, অন্যের চাল-চলন বা জীবনাচরণের প্রতি হস্তক্ষেপ না করা- এ বিষয়গুলো শেখাই না। এগুলো নিয়ে আমরা হয়ত ভাবিই না। একটা শিশুসন্তানের জন্য পরিবারের শিক্ষাটা তার ভিত্তি। পরিবারই সবকিছু। একটা শিশুকে সভ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সহজ বিষয় না।

এতো কিছু বলছি, একটাই কারণ। আমার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রথম দায়িত্ব আমার। আমার শিশুকে সভ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রথম দায়িত্ব আমার। জ্বি, আমার!

রাষ্ট্র কি সবকিছু তৈরি করে দেবে ? আসলেই কি তাই? রাষ্ট্রের দায়িত্ব অবশ্যই আছে। রাষ্ট্র অবশ্যই আইনের প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য। কিন্তু সেটা সাংগঠনিকভাবে সব স্তরে, সম্পূর্ণ কার্যকর করা সময়সাপেক্ষ বিষয়। সবচেয়ে বড় দায়িত্বটা পরিবারের, আমার/আমাদের।  এই যে Abusive Incidents ঘটছে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে,  যারা এসব কুৎসিত ঘটনা ঘটাচ্ছে- এরা সবাই দেখতে মানুষের মতো। একদম স্বাভাবিক মানুষের মতো দেখতে, পরিপাটি গুছানো চেহারা। এরা লেখাপড়াও জানে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, পড়ছে। এরাও শিশু ছিল একসময়, এরা কোনো পরিবারে বড় হয়েছে। এদের মা-বাবা ছিল, অনেকের মা-বাবা এখনো আছে। সভ্য মানুষ হিসেবে মানবিক মূল্যবোধ এদের মধ্যে তৈরি করা যায়নি।

সময়ের আবর্তে যেতে যেতে সমাজ একটা স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করে। ভালো-খারাপের স্ট্যান্ডার্ড। আর সমাজ তৈরি করি আমরা মানুষেরা। আজকের যতো যা কিছু ভালো বা খারাপ, এর দায়ভার দুঃখজনকভাবে আমাদেরই।

আমাদের সন্তানদের মধ্যে মূল্যবোধগুলো আমাদের তৈরি করে দিতে হবে। ছেলে বা মেয়ে হিসেবে না বরং মানুষ হিসেবে কী করা উচিত,  সেই আচরণগুলো আমাদের সন্তানদের শেখানো উচিত।

 আমাদের পরিবারের নিরাপত্তার জন্য সমস্ত প্রস্তুতি আমাদেরই নিতে হবে।

 আপনার সন্তান ছেলে বা মেয়ে যেই হোক, তার  সম্ভাব্য বিপদগুলো সম্পর্কে তাকে একটু অবহিত করুন।

 সন্তানকে আত্মরক্ষার কৌশল শেখান।  বিপদে পড়লে কী কী করণীয়, একটু শেখান।

 ভালো স্পর্শ/ খারাপ স্পর্শ সম্পর্কে শেখান। মা-বাবা হিসেবে একটু সতর্ক থাকুন।

আপনার প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এদের  বিষয়ে একটু সতর্ক থাকুন; কাছের মানুষগুলো থেকেই কিন্তু বিপদের শংকা বেশি। অন্ধভাবে কাউকে বিশ্বাস করা/না-করা নির্ভর করছে আপনার বিচক্ষণতার উপর।

এখন মেয়েরা অনেকে উদ্যোগী হয়ে সেল্ফ ডিফেন্স শিখছে, ভালো খবর। বিপদে পড়লে, তড়িৎ গতিতে কোন অবস্থায় কী কী করতে পারবেন, একটু ভাবুন। নিজের সাথে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস এমনিতেই রাখুন, যেমন: চুলের কাটা, সেফটিপিন, চিমটা এসব টাইপের। প্রয়োজনে ব্যাবহার করুন।

 বাইরে বের হবার সময় মরিচ গুড়া/মরিচের স্প্রে রাখতে পারেন। প্রয়োজনে ব্যবহার করুন।

ক্যাব, উবারে চলার সময় আপনার লোকেশন, চালক এবং গাড়ির ডিটেইলস্ কোনো বন্ধু/পরিবারের সদস্যকে জানিয়ে রাখুন/জানানোর ভান করুন। চালক খারাপ কিছু ভাবার সাহস পাবে না।

আক্রমণকারীর চোখ বা অণ্ডকোষ বরাবর সজোরে আঘাত করলে তাকে কাবু করতে পারবেন, সুযোগ বুঝে কৌশল কাজে লাগান।

নিজের জন্য নিজেকে এসব করতে জানতেই হবে। নিজেদের জন্য, পরিবারের সদস্যদের জন্য সতর্ক থাকতেই হবে। জীবনে চলার পথে অবশ্যই আশেপাশের মানুষের উপর ভরসা রাখবেন। অবিশ্বাস নিয়ে জীবনে চলা মুশকিল, কিন্তু সতর্ক থাকবেন। অন্ধবিশ্বাস কখনো ভালো না।

 নিরাপদ থাকুন। নিরাপদ রাখুন।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]