অপরাধীর কোন লিঙ্গ নেই
তৌকির ইসলাম।। অপরাধবোধ প্রতিটি মানুষের ভেতরকার ভয়ঙ্কর রূপ যা স্থান-কাল-পাত্রভেদে ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্করতম হয়ে ওঠে। আর তাই প্রয়োজন হয় পারিবারিক শিক্ষা, সামজিক মূল্যবোধ এবং আইনী বিচার ব্যবস্থার। কিন্তু আমাদের সমাজ কি অপরাধীকে শুধু অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করতে প্রস্তুত? মোটেও নয়। আমাদের সমাজ অপরাধীকে নারী পুরুষ বিবেচনা করে একটা বিচারিক কাঠামো তৈরি করে এবং সেই কাঠামোতে তারা বিচার ব্যবস্থা দেখতে চায়।
একটু বিশ্লেষণে আসা যাক। একই অপরাধ করে আমাদের দেশে নারী-পুরুষের সামাজিক মূল্যায়ন হয় দুই রকমের, তাও হয় শুধু লিঙ্গভেদে। একজন পুরুষ যদি খুন করে তবে সমাজ তাকে আখ্যা দেয় শুধুই খুনি হিসেবে। কিন্তু যদি একজন নারী খুনি হয় তবে প্রথমে সে খেতাব পাবে চরিত্রহীন। দ্বিতীয়ত সে খেতাব পাবে গোল্ড ডিগার। সর্বশেষে গিয়ে সে যে খুনি তা সমাজ স্বীকার করবে। হতে পারে মেয়েটি এমনিতেই খুনি; সে চরিত্রহীন অথবা গোল্ড ডিগার নয়। একজন ছেলে যদি চুরি করে তবে সে শুধুই চোর কিন্তু একটি মেয়ে যদি চুরি করে তবে সে নষ্ট, অসভ্য তারপর চোর। সমাজের এই দ্বিচারিতা আমার কাছে মনে হয় পুরুষদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি করে। সমাজকে বুঝতে হবে যে নারী মানুষ এবং সে যদি অপরাধ করে থাকে সে শুধুই অপরাধী। নারী অপরাধ করলেই প্রথমেই তার চরিত্রের পোস্ট মর্টেম করা বন্ধ করতে হবে। আমি মোটেও বলছি না যে একজন নারী অপরাধীর বিচার না হোক। দেশের আইনগত প্রক্রিয়ায় তার যা শাস্তি তা হবে, হওয়া উচিত। কিন্তু শুধুমাত্র নারী বলে সমাজ তার চরিত্রকে কলুষিত করবে তা মোটেও কাম্য নয়। বরং এতে সমাজে এক ধরণের বৈষম্য তৈরি হয়।
শুধু সমাজ নয় আমাদের প্রত্যেকের পরিবারেও আপনি এই ব্যাপারটি লক্ষ্য করবেন। আসুন একটি বাস্তব উদাহরণ দেই। ধরুন, আপনি আপনার ছেলেকে এবং মেয়েকে দুইজনকেই দেখলেন ধূমপানরত অবস্থায়। আপনি আপনার ছেলেকে হয়তো বলবেন যে সে যেন এমন আর না করে, ধূমপান ক্ষতিকর ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আপনি মেয়েকে কি একই কথা বলবেন! হয়তো আমার পাঠকরা এমন নয় কিন্তু আমাদের বাকি পরিবারগুলো, আমাদের সমাজ- তারা মোটেও মেয়েটিকে এভাবে সমানভাবে দেখবে না। বরং সে কেন মেয়ে হয়ে ধূমপান করল এটাই হবে তার অপরাধ।
এভাবেই আমাদের পরিবার, আমাদের সমাজ অপরাধী নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও লিঙ্গ বৈষম্য তৈরি করে। আমার কাছে মনে হয় আমাদের পুরুষদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার পিছনে আমাদের পরিবার তথা সমাজের এই ছকে বাঁধা ব্যবস্থা দায়ী। আমি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ পড়ুয়া অনেক ছেলেকেই দেখেছি যে সে তার মেয়ে বন্ধুর কোন অন্যায় কিংবা অপরাধের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেই ফেলে যে মেয়ে হয়ে এমন করা ঠিক হয় নি ইত্যাদি ইত্যাদি। এই যে আমাদের পুরুষদের ছোটবেলা থেকেই পরিবারের মাঝেই বিচার ব্যবস্থার দুটো ভিন্ন তরঙ্গ দেখতে পাওয়ার দরুন নারীর প্রতি সহিংস হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার একটি কারণ বলে মনে হয়।
অপরাধীকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শেখা অনেক বেশি জরুরি, নারী-পুরুষ হিসেবে নয়। কারণ অপরাধীর কোন লিঙ্গ নেই, তার মূল পরিচয় সে একজন অপরাধী।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]