ইতিহাসে ধর্ষণ এবং পুরুষতন্ত্রের জিঘাংসা
শাকিল মাহমুদ।। বেশ কিছুদিন ধরেই দেশে ধর্ষণ নিয়ে সরব হয়েছে সচেতন সমাজ। হঠাৎ হঠাৎ এ সরব হওয়া আসলে কতটুকু কাজের, সে হিসেব নিকেশে না গিয়ে নিজের প্রতি লজ্জা প্রকাশ করে নোয়াখালীর ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে নরপশুদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে ‘ভিডিও আছে? হ্যাঁ, দিচ্ছি! অপেক্ষা কর’ বলা জনতাকেও দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। কেননা যারা ভিডিও করে প্রকাশ করেছে এবং যারা সেটি একে ওকে দিয়ে বেড়াচ্ছে- প্রত্যেকেই ধর্ষক। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে চারদিকে এমন সব নরপশু রয়েছে যারা দৈনন্দিন পাশবিক কর্ম চালিয়েই যাচ্ছে।
গত কয়েকদিন ধরে একটা দীর্ঘ লেখা তৈরি করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু আজ হঠাৎ করেই লেখাটা শেষ করার জন্য বসতে হলো। কারণ আমাদের মগজ এতটাই বিকৃত হয়ে গেছে যে সেখানে জোরেশোরে একটা নাড়া না দিলেই যেন নয়। সুতরাং এদিক সেদিক থেকে নানা তথ্য জোগাড় করে অবশেষে লেখার সূচনা করতে হলো। গভীরে যাওয়ার পূর্বে হালকা করে নিজের কিছু কথা জানাতে চাই।
আপনারা যারা ধর্ষণের জন্য নানাভাবে নারীকে, নারীর পোশাক-চলাফেরাকে দায়ী করেন, আমার কাঠগড়ায় আপনারাও নিপীড়ক। আমি নিজেও যে ধোঁয়া তুলসী পাতা তা একদমই বলছি না। কারণ এই সমাজে, সমাজের শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে আমার ভেতরেও যে পুরুষতন্ত্রের ছাপ নেই তা কী করে বলি! তবে আমি ‘সম্মতি’ শব্দটার সঙ্গে পরিচিত। এখন সম্মতি কী, কোথায় ব্যবহার করা হয় – তা নিয়ে আলাপে না যাই। রাস্তায় নারীকে দেখলেই বুকের ও নিতম্বের সাইজ মাপার মত মানসিকতা আমাদের অধিকাংশের। এই মানসিকতার পরিবর্তন কি ধর্ষণ প্রতিরোধ করতে পারে? এ প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড়িয়ে সচেতন নাগরিকদের উচিত মগজাস্ত্রের কাজটা শুরু করা।
যা হোক, এবার চলুন গভীরে গিয়ে একটু দেখি, নারীর প্রতি পুরুষের পাশবিকতার চিত্র, তার কারণ এবং এর থেকে মুক্তির পথ কি!
১.
ক. আমাদের কাছে টিক্কা খানের নির্দেশনা ছিল যে, একজন ভালো মুসলমান কখনওই তার বাবার সঙ্গে যুদ্ধ করবে না। তাই আমাদের যত বেশি সম্ভব বাঙালি মেয়েকে গর্ভবতী করে যেতে হবে।
খ. আমাদের এসব উচ্ছৃঙ্খল মেয়েদের পরিবর্তন করতে হবে যাতে এদের পরবর্তী প্রজন্মে পরিবর্তন আসে, তারা যেন হয়ে ওঠে ভালো মুসলিম এবং ভালো পাকিস্তানি।
গ. এসব বাঙালি রক্তে পাঞ্জাবি রক্ত মিশিয়ে তাদের জাত উন্নত করে দাও।
উপরের বক্তব্যগুলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর, বাঙালী নারীদের উপর ধর্ষণ করাকে বৈধতা দিতে গিয়ে এসব বলেছিল তারা। আজকের সময়ে এসে যখন চারিদিকে ধর্ষণের খবর শুনি, নারীর উপর নানারূপে যৌন নিপীড়নের খবর শুনি, তখন ভাবতেই হচ্ছে পাকিস্তানীরা কি তাহলে তাদের কাজে সফল? এদেশে তাদের মতই ধর্ষক জন্ম দিয়ে গেল!
উনিশশ একাত্তর সনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের ইতিহাস দেখতে গেলে দেখা যাবে পাক আর্মি বাঙালি নারীর উপর কী বীভৎস পৌশাচিকতা প্রদর্শন করেছিল। সে সময়ের ধর্ষণ নিয়ে স্পষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও চার লাখের বেশি নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ধর্ষণের পর বীভৎস অত্যাচার, নির্যাতন, শরীরের অঙ্গ কেটে ফেলা, হত্যার মত ভয়াবহ সব ঘটনাও ঘটিয়েছে তারা নারীর ওপর। দিনের পর দিন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পশুর মত আটকে রেখে গণধর্ষণ করা হয়েছে লাখো মেয়েকে। যুদ্ধের পর হাজার হাজার মেয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। অনেকেই গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে মারা যায়। আজীবন অসুস্থ পঙ্গু জীবন বেছে নিতে হয় বহু নারীকে। আর সামাজিক পারিবারিক অমর্যাদা অপমান তো আছেই।
২.
পৃথিবীতে বরাবরই নারীর উপর নিপীড়নকে মূল হাতিয়ার করে পুরুষ তার পৌরুষের ক্ষমতা দেখিয়েছে।
ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে দেখা যায়,
* ১৬৩৫ সালে মুঘল সম্রাট শাহজাহান বুন্দেলখণ্ড আক্রমণ ও দখল করে বুন্দেলা রাজা বীর সিংহের পরিবারের নারীরা মুঘল বাহিনীর হাতে বন্দি হন। বন্দি নারীদেরকে জোরপূর্বক ধর্ম পরিবর্তন করতে বাধ্য করা হয় এবং তারা মুঘল সৈন্য বা সেনা কর্মকর্তাদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন।
* ১৭৪২ সাল থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত মারাঠা নেতা রঘুজীর সৈন্যরা ক্রমাগত বাংলা আক্রমণ করে। এ সময় বাংলার অসংখ্য নারী মারাঠাদের দ্বারা ধর্ষিত হন। মারাঠা সৈন্যরা হিন্দু নারীদের মুখে বালি ভরে দিত, তাদের হাত ভেঙ্গে দিত এবং পিছমোড়া করে বেঁধে তাদেরকে গণধর্ষণ করতো। সে সময়কার বাঙালি কবি গঙ্গারাম বাংলার নারীদের ওপর মারাঠাদের অত্যাচারের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, তারা নারীদের টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যেত এবং দড়ি দিয়ে তাদের আঙ্গুলগুলো তাদের ঘাড়ের সঙ্গে বেঁধে দিত। একজন বর্গি (মারাঠা সৈন্য) একজন নারীর সম্ভ্রমহানি করার পরপরই আরেকজন বর্গি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। এসব নারীরা যন্ত্রণায় চিৎকার করতেন।
* ১৭৫৭ সালে আফগান সম্রাট আহমদ শাহ আবদালী মুঘল-শাসিত ভারত আক্রমণ করেন। এ সময় আফগান সৈন্যরা দিল্লি ও মথুরাসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ করে এবং বহুসংখ্যক নারীকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। সম্ভ্রমহানির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তখন বহু নারী আত্মহত্যাও করেন।
* বক্সার বিদ্রোহের সময় আট-জাতির জোটের সৈন্যরা চীনা জনসাধারণের বিরুদ্ধে ব্যাপক হারে হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণে লিপ্ত হয়। হাজার হাজার চীনা নারী আক্রমণকারী সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন এবং হাজার হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হওয়া থেকে বাঁচার জন্য আত্মহত্যা করেন।
* ১৯০৪–১৯০৫ সালে রুশ–জাপান যুদ্ধের অন্যতম প্রধান রণাঙ্গন ছিল চীন সাম্রাজ্যের মাঞ্চুরিয়া। এই যুদ্ধের সময় রুশ সৈন্যরা মাঞ্চুরিয়ায় বহু চীনা গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, অসংখ্য চীনা নারীকে ধর্ষণ করে এবং যারা তাদের এসব কর্মকাণ্ডে বাধা দিয়েছিল তাদের মেরে ফেলে৷
* ১৯৩৯ সালে জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ ও দখল করে। এ সময় জার্মান সৈন্যরা অসংখ্য পোলিশ ইহুদি নারীকে ধর্ষণ করে। এছাড়া জার্মান সৈন্যরা ইহুদি ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বী হাজার হাজার পোলিশ নারীকেও ধর্ষণ করে। অসংখ্য পোলিশ নারীকে ধর্ষণের পর গুলি করে হত্যা করা হয়।
* ১৯৪১ সালের ২২ জুন জার্মানি এবং এর মিত্ররাষ্ট্রসমূহ (ইতালি, রুমানিয়া, হাঙ্গেরি ও অন্যান্য রাষ্ট্র) সোভিয়েত ইউনিয়নে আক্রমণ করার পর সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনীতে কর্মরত হাজার হাজার মহিলা ডাক্তার, সেবিকা এবং ফিল্ড মেডিক আগ্রাসী সৈন্যদের হাতে বন্দি হন। তারা জার্মান ও অন্যান্য আক্রমণকারী সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত হন, এবং ধর্ষণের পর তাদেরকে হত্যা করা হয়। এছাড়া জার্মান সৈন্যরা সোভিয়েত ইউনিয়নে তাদের দখলকৃত অঞ্চলসমূহে অসংখ্য বেসামরিক নারীকে ধর্ষণ করে। জার্মান সৈন্যরা বন্দি সোভিয়েত নারী মুক্তিযোদ্ধাদের এবং অন্যান্য নারীদের দেহে হিটলারের সৈন্যদের যৌনদাসী শব্দগুচ্ছ লিখে দিত এবং তাদেরকে ধর্ষণ করত। পরবর্তীতে সোভিয়েত সৈন্যদের হাতে বন্দি হওয়ার পর কিছু জার্মান সৈন্য সোভিয়েত নারীদের ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যায় অংশ নেয়ার বিষয়ে গর্ব করেছিল।
* জার্মান সৈন্যরা ইহুদি ও স্লাভ জাতিভুক্ত মানুষদেরকে তাদের তুলনায় নিচুশ্রেণির বলে মনে করত, এবং এজন্য এসব জাতির নারীদের ধর্ষণ করাকে তারা অপরাধ বলে মনে করত না। তারা ধর্ষণকে দখলকৃত অঞ্চলের অধিবাসীদের মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
* সোভিয়েত ইউনিয়নের স্মোলেনস্ক শহরে জার্মান দখলদার বাহিনী একটি পতিতালয় খুলেছিল, যেখানে শত শত বন্দি সোভিয়েত নারীকে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা হত। লভিভ শহরে একটি পার্কে জার্মান সৈন্যরা একটি পোশাক কারখানার ৩২ জন নারী শ্রমিককে জনসম্মুখে ধর্ষণ করে। একজন পাদ্রী তাদের অপকর্মে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করলে তারা তাকে হত্যা করে। বারিসাভ শহরে অগ্রসরমান জার্মান সৈন্যদের কাছ থেকে পলায়নরত ৭৫ জন নারী জার্মান সৈন্যদের হাতে বন্দি হন। জার্মান সৈন্যরা তাদেরকে ধর্ষণ করে এবং এরপর তাদের মধ্যে থেকে ৩৬ জনকে হত্যা করে। এছাড়া হাম্মার নামক একজন জার্মান অফিসারের নির্দেশে জার্মান সৈন্যরা এল. আই. মেলচুকোভা নাম্নী ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরীকে একটি জঙ্গলে নিয়ে যায় এবং সেখানে তাকে ধর্ষণ করে। এরপর অন্য যেসব মহিলাকে জঙ্গলের মধ্যে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাদের সামনে মেলচুকোভার স্তন কেটে ফেলা হয়। কের্চ শহরে জার্মান সৈন্যরা বন্দি নারীদের ওপর বর্বর নির্যাতন ও ধর্ষণ চালায়, তাদের স্তন কেটে ফেলে, পেট চিরে ফেলে, হাত ছিঁড়ে নেয় এবং চোখ উপড়ে ফেলে। পরবর্তীতে সোভিয়েত সৈন্যরা শহরটি মুক্ত করার পর সেখানে তরুণী মেয়েদের ছিন্নভিন্ন দেহে পরিপূর্ণ একটি গণকবর পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞদের ধারণামতে, জার্মানির সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণকালে এক কোটিরও বেশি সংখ্যক সোভিয়েত নারী জার্মান সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন এবং এর ফলে ৭,৫০,০০০ থেকে ১০,০০,০০০ যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়।
* ১৯৪৪ সালে সোভিয়েত বাহিনী পোল্যান্ড থেকে দখলদার জার্মান বাহিনীকে বিতাড়িত করে সাময়িকভাবে পোল্যান্ড দখল করে। এসময় সোভিয়েত সৈন্যরা অসংখ্য পোলিশ নারীকে ধর্ষণ করে। ১৯৪৪–১৯৪৭ সালের মধ্যে এক লক্ষেরও বেশি পোলিশ নারী সোভিয়েত সৈন্যদের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়।
* ১৯৪৫ সালে অগ্রসরমান সোভিয়েত সৈন্যরা হাঙ্গেরি দখল করে। এসময় প্রায় ২,০০,০০০ হাঙ্গেরীয় নারী সোভিয়েত সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন। হাঙ্গেরীয় মেয়েদের অপহরণ করে সোভিয়েত সেনাঘাঁটিগুলোতে নিয়ে যাওয়া হত, যেখানে তাদের বারবার ধর্ষণ করা হত এবং হত্যা করা হত।
* ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে সোভিয়েত সৈন্যরা জার্মান-অধিকৃত অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা দখল করে। ভিয়েনা দখলের পরপরই সোভিয়েত সৈন্যরা শহরটিতে অসংখ্য অস্ট্রীয় নারীকে ধর্ষণ করে।
* ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দারাবাদ আক্রমণ ও দখল করে। হায়দারাবাদ দখলের পর ভারতীয় সৈন্যরা বহুসংখ্যক স্থানীয় মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করে। একটি ঘটনায় ৬ থেকে ৭ হাজার ভারতীয় সৈন্য ও পুলিশ বরাঙ্গল জেলার গ্রামগুলোতে হানা দেয় এবং তিন শত নারীকে ধর্ষণ করে। এদের মধ্যে ৪০ জনকে গণধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়।
* কোরীয় যুদ্ধ চলাকালে দক্ষিণ কোরীয় সৈন্যরা কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল দক্ষিণ কোরীয় নারীদের ধর্ষণ করত।
* ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন সৈন্যরা ভিয়েতনামী নারীদের ওপর ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের যৌন নির্যাতন চালিয়েছিল।
* পশ্চিম পাপুয়ায় ইন্দোনেশীয় আক্রমণের ফলে প্রায় ৩,০০,০০০ থেকে ৪,০০,০০০ পশ্চিম পাপুয়ান নিহত হয় এবং অসংখ্য নারী ইন্দোনেশীয় সৈন্যদের হাতে ধর্ষিত হন।
* ১৯৭৪ সালে তুরস্ক কর্তৃক সাইপ্রাস আক্রমণের সময় তুর্কি সৈন্যরা এবং তুর্কি সাইপ্রিয়টরা বহুসংখ্যক গ্রিক সাইপ্রিয়ট নারীদের ধর্ষণ করেছিল।
* ১৯৭৫ সালে ইন্দোনেশিয়া পূর্ব তিমুর আক্রমণ ও দখল করে। এসময় হাজার হাজার পূর্ব তিমুরীয় নারী ইন্দোনেশীয় সৈন্য ও পুলিশদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন। বহু নারীকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে বন্দি করে রেখে বারবার ধর্ষণ করা হত
* পার্বত্য চট্টগ্রাম সংঘাত চলাকালে ১৯৮১ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশি সৈন্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামের ২,৫০০-এরও বেশি সংখ্যক আদিবাসী নারীকে ধর্ষণ করে।
* ১৯৭৯—১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান দখলকালে সোভিয়েত সৈন্যরা অসংখ্য আফগান নারীকে অপহরণ ও ধর্ষণ করে। যেসব নারী সোভিয়েত সৈন্যদের দ্বারা অপহৃত ও ধর্ষিত হন, তারা বাড়ি ফিরলে তাদের পরিবার তাদেরকে ‘অসম্মানিত’ হিসেবে বিবেচনা করে এবং তারা সামাজিক লাঞ্ছনার শিকার হন
* ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে ইরাক ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় এবং নভেম্বরে ইরাকি বাহিনী ইরানের খুজেস্তান প্রদেশের খুররমশহর দখল করে নেয়। এসময় ইরাকি সৈন্যরা বহুসংখ্যক ইরানি নারীকে ধর্ষণ করে।
* ১৯৮৭ সালে শ্রীলঙ্কায় চলমান গৃহযুদ্ধে ভারত সামরিক হস্তক্ষেপ করে এবং দেশটির বিদ্রোহী তামিল দলগুলোকে নিরস্ত্র করার জন্য দেশটিতে ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করে। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চলমান তিন বছরব্যাপী এই অভিযানকালে ভারতীয় সৈন্যরা অসংখ্য শ্রীলঙ্কান তামিল নারীকে ধর্ষণ করে।
* ১৯৯০ সালে ইরাক কুয়েত আক্রমণ ও দখল করে এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত দখল করে রাখে। এসময় প্রায় ৫,০০০ কুয়েতি নারী ইরাকি সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ চলাকালে মার্কিন বিমানবাহিনীর ফ্লাইট সার্জন (পরবর্তীতে জেনারেল) রোন্ডা কর্নাম একটি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার পর ইরাকি বাহিনীর হাতে বন্দি হন। বন্দি অবস্থায় তিনি ইরাকি সৈন্যদের দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হন
* ১৯৯৫ সালের প্রথমদিকে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের কর্তৃত্ব নিয়ে আফগান সরকার ও অন্যান্য দলের মধ্যে যুদ্ধ হয়। দলের যোদ্ধারা কাবুলের হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ ও গণধর্ষণ করে
* ২০১৬—১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে মিয়ানমার সরকারি বাহিনীর সঙ্গে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সংঘর্ষের ফলশ্রুতিতে মিয়ানমার সৈন্যরা রোহিঙ্গা জনসাধারণের বিরুদ্ধে ‘শুদ্ধি অভিযান’ আরম্ভ করে। এসময় হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী মিয়ানমার সৈন্যদের হাতে ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হন।
উপরোল্লিখিত তথ্যগুলো যুদ্ধকালীন নারীর উপর চলা ধর্ষণের আংশিক চিত্র। যুদ্ধকালীন সময়ে পৌরুষের জোশ দেখাতে এবং বিপরীত পক্ষকে ঘায়েল করতে বলির পাঠা করা হয়েছে নারীকে। তবে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে যখন শুনছি বাসে নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে, মসজিদে শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে, গণধর্ষণের পর বিবস্ত্র করে পৈশাচিক আনন্দ ভোগ করতে ভিডিও ধারণ করেছে এবং তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে- তখন ভাবনাটা ভাবতে হচ্ছে ভিন্নভাবে।
বিগত একটা লেখায় বলেছিলাম, ধর্ষণের মানসিকতা তৈরি হয় পরিবার থেকেই। কিভাবে তৈরি হয়? পুনরায় সে বিষয় নিয়ে আলাপ না করে একটু ভিন্নভাবে, একজন গবেষকের গবেষণালব্ধ তথ্য তুলে ধরে আজকে একটু আলাপ করি। ২০১৩ সালে ইংল্যাণ্ডের অ্যাংলিয়া রাস্কিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপরাধবিজ্ঞান বিষয়ে পি.এইচ.ডি করা মধুমিতা পাণ্ডে ১০০ জন ধর্ষককে নিয়ে গবেষণা করে বের করেন, ধর্ষকদের অধিকাংশেরই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, যাও সামান্য কয়েকজন আছে। তারা হাই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছেন। অনেকেই তৃতীয় কি চতুর্থ শ্রেণির বেশি আর পড়ালেখা করেনি। ধর্ষকরা কেউ রাক্ষস নয়, অদ্ভুত কোন জীব নয় কিংবা ভীন গ্রহের বাসিন্দাও নয়। আর দশটা মানুষের মতো নিতান্তই সাধারণ এবং এ পৃথিবীরই বাসিন্দা। তারা ধর্ষণ করেছে তাদের বেড়ে ওঠার পরিবেশের কারণে, চিন্তার জগতে পারিবারিক আর সামাজিক পরিবেশের প্রভাবে।
মধুমিতা পাণ্ডের গবেষণায় উঠে আসে ভারতীয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। যেখানে নারী পুরুষের অধীনস্থ এবং পুরুষ তার পৌরুষত্বের অহমিকা নিয়ে নারীর উপর চড়াও হয় – শারীরিক এবং মানসিক নিপীড়নের মাধ্যমে।
আমি একটা সিনেমার রিভিউ লিখতে গিয়ে সে লেখায় বলেছিলাম, আমাদের সমাজে ধর্ষণের মাত্রা ব্যাপক আকার ধারণ করার মূল কারণ সঠিকভাবে যৌন শিক্ষা না দেয়া। এর বিরুদ্ধে হাজার জন দাঁড়িয়ে হাজার যুক্তি দেখিয়েছেন। এমনকি ইউরোপ-আমেরিকার কথা উল্লেখ করেও তারা এদেশের ধর্ষণকে বৈধতা দেয়ার একটা চেষ্টা চালিয়েছেন৷ কোন দেশে ধর্ষণের মাত্রা কত, তারা তা কিভাবে মোকাবেলা করছে কিংবা করার জন্যে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে কিনা – সে বিষয়ে এ মুহূর্তে মাথা না ঘামিয়ে বরং আমাদের সমাজে নারীর প্রতি যে ভয়াবহতা দিনকে দিন বাড়ছে তা নিয়ে ভাবনা এ মুহূর্তে জরুরি।
৩.
আমাদের দেশের মত রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় যেখানে বাবা-মা সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুভাবাপন্ন মন নিয়ে আলাপ করছে না। শিশ্ন বা পেনিস, জরায়ু বা ভ্যাজাইনা, সেক্স , ধর্ষনের মতো শব্দগুলো তারা সন্তানদের সামনে উচ্চারণ পর্যন্ত করতে চান না। যেখানে অবিভাবকদের সংকীর্ণতা, রক্ষণশীল মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো প্রয়াস নেই- তখন ধর্ষণের মানসিকতা পরিবার থেকেই বেড়ে উঠে বললে অতুক্তি হবে না। এছাড়াও আমাদের অ্যাকাডেমিক শিক্ষায় সেক্স এডুকেশন বা যৌন শিক্ষা সম্পর্কে কোনো পাঠদান করা হয় না। বরং সংস্কৃতির অবক্ষয় হবে, প্রজন্ম উচ্ছন্নে যাবে এবং ধর্মীয় নিয়মানুসারে এসব বিষয়ে আলোচনা করা পাপ বলে বিষয়টাকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়। আর এই ধামাচাপা দিয়ে রাখার ফল কি তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
ধর্ষণের বিরুদ্ধে সমাজে যতটুকুই হোক প্রতিবাদ হয়েছে বা হচ্ছে, সামনে আরো হবে। এর বিরুদ্ধে লেখালেখি, গবেষণা হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। কিন্তু নারীর উপর পুরুষের পাশবিকতা কমেছে? অবশ্য কমার কোনো আলামত দেখাও যাচ্ছে না। গতকাল এক মেয়েকে ম্যাসেঞ্জারে আমার একটা লেখা পাঠিয়ে বললাম, পড়ো! পড়ে মতামত জানিও। সে জবাবে বললো, পড়েছি! কিন্তু এসবে লাভ নেই। অপেক্ষা করছি কবে ধর্ষিত হই!
এই যে আশঙ্কা, ভয় – এটাই পুরুষের কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার মূল চাবিকাঠি। ধর্ষণ যার মূল হাতিয়ার। যা যুগে যুগে পুরুষ করে এসেছে এবং করে চলছে। অর্থাৎ পুরুষ আজীবন নারীর উপর পাশবিকতা প্রকাশ করে পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রেখেছে । আর পুরুষের এই কর্তৃত্ববাদী আচরণকে টিকিয়ে রাখতে না জেনেই মদদ দিয়েছে নারী নিজেই। আমাদের মা-চাচীরা তাদের স্বামীকে, ‘এই শুনছো’, ‘ওগো’, ‘অমুকের বাপ (আব্বু)’ ডেকে স্বামীর নাম ধরে ডাকা অন্যায় – শিখিয়েছে তার পরবর্তী প্রজন্মের নারীকে। এভাবের প্রজন্মের পর প্রজন্ম নারীরা পুরুষতন্ত্রকে হৃষ্টপুষ্ট করেছে পুরুষের দাসত্ব মেনে।
৪.
একটা সম্পাদকীয়তে গতকাল পড়লাম, একজন নারীর প্রতি কী বীভৎস জিঘাংসা নিয়ে এরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে! এর শেষ কোথায়? এই ধর্ষণমুখী সমাজের শেষ কীভাবে হবে? কীভাবে প্রায়শ্চিত্ত হবে? কীভাবে মুক্তি মিলবে?
মুক্তির পথ আমাদের সামনেই খোলা। রক্ষণশীল মানসিকতা থেকে বেড়িয়ে এসে সন্তানকে যৌন শিক্ষা দিতে হবে, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন শিক্ষার জন্যে আলাদা পাঠ ব্যবস্থা করতে হবে, টেলিভিশন মিডিয়ায় যৌন শিক্ষা নিয়ে অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে। তবে এ পথ খুব সহজ নয়৷ কেবলমাত্র প্ল্যাকার্ড হাতে, মোমবাতি জ্বালিয়ে ধর্ষকের ফাঁসি চেয়ে কখনোই ধর্ষণকে রোধ করা যাবে না। তবে হ্যাঁ এর মাধ্যমে প্রতিবাদ জারি রাখা যায়। তবে আল্টিমেটলি ধর্ষণ রোধে একমাত্র মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন।
সুতরাং চেতনার আমূল পরিবর্তন, পুরুষের কর্তৃত্বের বলয় ভেঙে নারীকে বেরিয়ে আসতে হবে। তখনই সম্ভব একটা সুন্দর সমাজের দেখা পাওয়া। ইতি টানা সম্ভব যুগে যুগে নারীর উপর চলে আসা পৈশাচিক নিপীড়নের।
আমি এ লেখায় আমার দৃষ্টিকোণকে উপস্থাপন করেছি। তবে সমাজ ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আপনার যদি মনে হয় মানসিকতার পরিবর্তনই ধর্ষণ রোধের মূল উপাদান তাহলে তার জন্য কি করণীয় – তা নিয়ে ভাবুন৷
ঋত্বিক ঘটক বলেছেন ভাবতে। আমি কেবলমাত্র এ লেখায় আপনার মগজে নাড়া দিতে চেষ্টা করেছি৷ এখন বাকিটা আপনাদের কাজ।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]