November 22, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

সমতার কথা বলে কি নারীকে বেশি সুবিধা দেয়া হচ্ছে?

সুবীর সাহা শুভ্র।।  সবচেয়ে সহজ কথা হলো, আপনি যদি নিজেকে একজন মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন, তাহলে আপনাকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে, একজন মানুষ হিসেবে সকল মানুষের অধিকার সমান। নারী, পুরুষ বা যেকোনো লিঙ্গ ধারণ করা সবাই’ই প্রথমত মানুষ। এবং মানুষ হিসেবে একইরকম মেধা, মনন, প্রজ্ঞা, যোগ্যতা এবং অধিকার সমান।

কিন্তু আমরা যদি সকল মানুষকে সমানভাবে সমান সুযোগ দিয়ে বড় করে তুলতে না পারি, তখন সমান মেধা, মনন, প্রজ্ঞা, যোগ্যতা ও অধিকার থাকার পরেও আমাদের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভাগুলো সমানভাবে বিকশিত হয় না। এর জন্যে যে বড় হয়ে উঠেছে সে দায়ী নয়, দায়ী আমাদের সমাজ ব্যবস্থা।

এখন, যেহেতু আমি বললাম, সকল মানুষের মেধা, মনন, প্রজ্ঞা, যোগ্যতা ও অধিকার সমান- তাহলে বহুল প্রচলিত একটা প্রশ্ন আসে, নারীদেরকে কেন শিক্ষাক্ষেত্রে বিনা বেতনে পাঠদান ও উপবৃত্তি বা চাকরিক্ষেত্রে (কোনো কোনো চাকরিতে) অধিক সুবিধা দেয়া হচ্ছে?

আপনার চোখে নারী অবশ্যই পুরুষের সমান সবকিছু ধারণ করেন, তাই তাদের অধিক সুবিধা দেয়ার দরকার নেই। কিন্তু শুধু আপনার চোখে দেখলেই তো সবটুকু দৃশ্য দেখা হয়ে যায় না!

সমাজের অধিকাংশ মানুষ কীভাবে দেখে?

তারা ভাবে নারী অযোগ্য বা পুরুষের সমকক্ষ নয়। এছাড়াও, একজন পুরুষ যখন বাইরে বের হয় বা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ও কর্মক্ষেত্রে যায়- পথে ঘাটে শুধুমাত্র পুরুষ পরিচয়ের জন্যে অন্তত কটু কথা বা টিজিং এর শিকার হতে হয় না। একজন নারী যখন বাইরে বের হয় বআ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ও কর্মক্ষেত্রে যায়, শুধুমাত্র নারী পরিচয়টুকুর জন্যে সেই নারীকে অসংখ্য কটু কথা বা টিজিং বআ যৌন নির্যাতনের এর শিকার হতে হয়।বাইরে বের হওয়ার সময় প্রত্যেক নারী এই ভয়টুকু নিয়েই বের হয় অথবা মানসিক ট্রমার শিকার হয়ে থাকেন। এইজন্যে অনেক নারী পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে থাকেন অথবা চাকরিও ছেড়ে দেন।

একজন পুরুষের স্নাতক পাশ করা মানে শুধুই স্নাতক পাশ করা। কিন্তু একজন নারীর স্নাতক পাশ করা মানে একইসাথে স্নাতক পাশ করা এবং সেইসব নির্যাতক সামাজিক কীটগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় লাভ করা। তার মানে এক্ষেত্রে একজন নারী বরং একজন পুরুষের চেয়ে বেশি যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে। এর বাইরেও, একজন পুরুষ যখন বাবা হয়, সেই পুরুষকে সন্তানের জন্যে পড়ালেখা বা চাকরি ছাড়তে হয় না। কিন্তু একজন নারী যখন মা হয়, তখন তাঁকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পড়ালেখা, চাকরি এবং ক্যারিয়ার ছাড়তে হয়। আবার, একজন কর্মজীবী নারী যখন অফিস থেকে ফিরে আসে ক্লান্ত হয়ে, রান্নাবান্না ও ঘরের কাজগুলো  সেই নারীকেই করতে হয়। একজন নারী কি ক্লান্ত হয় না? একজন নারী কি ক্লান্তিহীন রোবট?

ভাই/আপু, আপনার মতো আধুনিক বা শক্তিশালী মানসিকতা তো আমাদের সুবিধাবঞ্চিত সকল নারী ধারণ করেন না, এবং পরিবার বা সমাজের অধিকাংশ মানুষ নারীদেরকে দুর্বল ভাবেন- তাই তারাও নিজেরাও নিজেদেরকে পুরুষের চেয়ে নিচু ভাবেন অথবা সমকক্ষ ভাবেন না। এক্ষেত্রে বলা যায়, একজন প্রগতিশীল মানুষের মনে করেন নারী-পুরুষ সমান। কিন্তু সমাজের অধিকাংশ মানুষ যেহেতু এটা ভাবছে না বরং ভাবছে নারী কখনোই পুরুষের সমকক্ষ নয়। সুতরাং বলা যায়, নারী হচ্ছে সমাজের চোখে অপেক্ষাকৃত দুর্বল।

এবার একটা প্রশ্ন করি, আপনার শরীরের দুইটা পায়ের তো সমান কাজ বা সমান অবদান, কিন্তু যদি একটা পা ভেঙ্গে যায়, তখন কি সেই ভাঙ্গা পায়ে প্লাস্টার করবেন না কি উভয় পায়ে? এখন, ডাক্তার তো শুধু ভাঙ্গা পায়েই প্লাস্টার করবে। তখন যদি সুস্থ পা বিদ্রোহ করে বসে যে, ভাঙ্গা পা’কে কেন অধিক সুবিধা দিচ্ছো? আমি মানি না, আমাকেও প্লাস্টার করো!

তখন কী হবে?

সুতরাং প্রগতিশীল মানুষের চোখে নারী-পুরুষ সমান যেমন সত্যি, তেমনি সমাজের অধিকাংশ মানুষ যতোদিন ভাববে যে, নারী সবসময়ই পুরুষের চেয়ে দুর্বল এবং নারী ভাঙা পায়ের মতো- ততোদিন নারীকে ভাঙ্গা পায়ের মতো অধিক যত্ন করতে হবে। এটাই হচ্ছে প্রকৃত অর্থে সমতা। আপনি যতই মানবিক মানুষ হোন, যতোক্ষণ আপনি নিজে নির্যাতিত না হবেন, ততোক্ষণ আপনি নির্যাতনের আসল যন্ত্রণাটা অনুভব করতে পারবেন না।

তাই, প্রশাসন ও চাকরিক্ষেত্রে সকল পদে পুরুষের পাশাপাশি নারী চাকরিজীবী জরুরি। অন্তত, নারী পরিচয়ের যন্ত্রণাটা তার পরিচিত।

এখন কথা হচ্ছে, ভাঙ্গা পা যখন সুস্থ হয়ে যায়, তখন প্লাস্টার এমনিতেই খুলতে হয়, না হলে পায়েরই ক্ষতি। তেমনি যতোদিন সমাজের অধিকাংশ মানুষ নারীকে পুরুষের সমকক্ষ না ভাবছে, ততোদিন একজন নারীকে শিক্ষা বা চাকরিক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে এবং সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর- এই অধিক গুরুত্বের অবসান আপনা আপনিই হবে।

একইসাথে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ যাদের বলি, তাদেরও একইভাবে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব দিয়ে সমাজের মূল স্রোতে আনতে হবে।

আসুন, সমাজের দৃষ্টিতে যতোদিন ‘সবাই সমান’ এই কথাটা মেনে নেয়ার মতো পরিবর্তন না হয়, ততদিন সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াই। অন্তত তারা আমাদের বিশ্বাস করুক যে তারা এই যুদ্ধে একা নয়- আমরাও আছি।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]