নারীর হাতে সিগারেট- হিপোক্রেসিটা দেখুন
প্রিয়া দেব।। চলুন সিগারেট নিয়ে তোলপাড় হওয়া আলোচনায় কিছু হিপোক্রেসি দেখি।
আচ্ছা আপনাদের কি মনে হয় সিগারেট ইস্যুতে সিগারেটের ক্ষতিকর দিক, স্বাস্থ্যবিধি কিংবা প্রকাশ্যে ধূমপানের ক্ষতিকর দিকটা আদতে কোনো উল্লেখযোগ্য পয়েন্ট? যদি মনে হয়ে থাকে, তবে বলতে হচ্ছে আপনার দৃষ্টিকোনের গভীরতা একদম নেই। এবং এরকম দুর্বল অবজার্ভেশন ক্ষমতা নিয়ে আপনি কোনো যথার্থ সমাধানেই পৌঁছাতে পারবেন না।
ভিডিওটা বারবার দেখা উচিত, এখানে একটা শব্দই আপনাকে বুঝিয়ে দিতে সক্ষম, যে এটা একটা লিঙ্গ বৈষ্যমের যথার্থ চিত্র।
প্রথমত ওই ভিডিওতে বলা হচ্ছিলো “পরে ধর্ষন হলেতো আমাদেরই দোষ দিবেন”। মানে একজন নারী প্রকাশ্যে ধূমপান করলে তাকে ধর্ষিত হতে হবে এমন একটা ধারনা আগে থেকেই সমাজের মস্তিষ্কের ভেতরে ঢুকে আছে। এবং এখানে আরেকটা ব্যাপার পরিষ্কার যে কোনো মেয়ে ধর্ষিত হলে, সে যদি সিগারেটখোর হয় তবে সেক্ষেত্রে ধর্ষণকে জাস্টিফাই করবার যথেষ্ট চেষ্টা এ সমাজ করবে।
তারপর পরিবেশটা দেখুন, চারপাশে প্রচুর মানুষ বসে আড্ডা দিচ্ছেন,পুরুষেরা বীরদর্পে সিগারেট খাচ্ছেন, এবং তাতে কারো কোনো সমস্যা হচ্ছে না কিন্তু একজন মেয়ে বসে সিগারেট খাচ্ছেন তাতেই মানুষজনের সচেতনতা বেড়ে গেছে। মেয়েটিকে এসে দলবেঁধে হ্যারাস করে উনারা নিজেদের ক্ষমতা প্রকাশ করেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে সেই দলবদ্ধ মানুষেরা কিন্তু একবারো “সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর” কিংবা “প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ” এরকম শব্দ ব্যবহার করেন নি, উনাদের সমস্যাটাই সে জায়গাতে ছিল না।এখানে নারীর স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা কারো নেই, এখানে সমস্যাটা হচ্ছে একজন নারী সমাজের তথাকথিত নিয়ম ভঙ্গ করে, নারী মানেই কোমলতা,আদর্শ,পবিত্র এরকম নোংরা টার্ম ব্রেক করে একজন সামর্থ্যবান পুরুষের মতো প্রকাশ্যে নির্ভয়ে সিগারেট খাচ্ছে সেখানে।
নারী মানেতো ঘর সংসার করবে, বয়স একটু কম হলে গৃহকর্মে নিপুনা হবার চেষ্টা করবে যাতে ভালো পাত্র তাকে প্রথম দেখায় পছন্দ করে, নাহলে ভালো ভালো ডিগ্রী নিয়ে বেকার থাকার চিন্তাভাবনা করবে, কারন ডিগ্রিধারী গৃহবধূর হাতের রান্নার স্বাদ সমাজে বেশি, নারী নিজেকে তৈরিই করবে অন্য মানুষের জন্য, সে জায়গায় এভাবে পুরুষদের মতো সিগারেট নারী কেন খাবে?
সিগারেট তো পুরুষরা খাবে, পাবলিক প্লেসে খেয়ে আশেপাশে বসে থাকা মেয়েদের লক্ষ্য করে ধোঁয়া ছাড়বে, বিরক্ত হয়ে না করতে গেলে আরো বেশি করে ধোঁয়া ছাড়বে, পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে পুরুষেরা সিগারেট খেয়ে গুরুত্বপূর্ন আলোচনা করে পৃথিবী উদ্ধার করবে। কারণ সিগারেট একটা পুং লিঙ্গের প্রোডাক্ট। শুধু সিগারেট না, মেয়েরা সাইকেল চালাতে গেলেও ভ্রু কোচকাবে সমাজ,পুরুষ বন্ধু বানালেও ভ্রু কোচকাবে সমাজ,রাতে দেরী করে ফিরলেও মস্তিষ্ক দিয়ে চরিত্র হনন করবে সমাজ।
কারণ সমাজ তার নোংরা নীতি থেকে বের হবে না। এ ইস্যুতে আরেকটা বড় ব্যাপার হচ্ছে “ফেমিনিজম ইজ ক্যান্সার” নামের একটি গ্রুপে এ ভিডিও পোস্ট করে একজন পিওর গর্দভ মহিলা বলেছেন এই মেয়ে নারীবাদী, কারণ নারীবাদী না হলে কোনো মেয়ে সিগারেট খায় না।
হ্যাঁ, এই বৈষম্যের সমাজে প্রকাশ্যে সিগারেট খেতে যে সাহসটা লাগে সেই সাহসটা নারীবাদই আপনাকে দিতে পারে। নারীবাদ এখানে সিগারেট খেতে আপনাকে উৎসাহিত করছে না, নারীবাদ আপনাকে দেখানোর চেষ্টা করছে বৈষম্যটা আদতে কোথায় এবং সেই বৈষম্য ভাঙার চেষ্টাটা কেন সাহসের ব্যাপার।
যারা স্বাস্থ্য নিয়া উদ্বিগ্ন কিংবা যাদের মনে হচ্ছে নারীবাদীরা সিগারেট খাওয়াকে প্রমোট করছেন তারা এই ভুল ধারনা থেকে বের হবেন আশা করি। আর তাছাড়াও স্বাস্থ্য নিয়া আওয়াজ তোলা এসব মানুষেরা সারা বছর সিগারেট এবং স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো আওয়াজ না তুললেও, শুধুমাত্র কোনো মেয়ে সিগারেট খাচ্ছে দেখলেই এরা স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে যান বলেই এসব হিপোক্রেট থিওরিকে পাত্তা দেওয়ার কোনো দরকার আছে বলে আমি মনে করিনা।
ব্যাপার হচ্ছে এখানে নারীবাদকে টেনে আনা হয়েছে, এবং ফেমিনিজম ইজ ক্যান্সার গ্রুপে পোস্টকারী আপুরও নারীবাদীদের উপর বিশাল রাগ। কারণ উনি পুরুষতন্ত্রের দাস, উনি প্রোফাইল ভর্তি করে প্রেমিকের সাথে ছবি দেন, অনেক আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করেন, আবার বায়োতে লেখেন “আল্লাহর দাস”, সেটা অবশ্যই উনার ব্যাক্তিগত ব্যাপার, কিন্তু দিনশেষে উনি নারীবাদীদের জ্ঞান দিতে নামেন, সেটাতে আমার সমস্যা আছে, নিজে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করে অন্যকে নীতিবাক্যে শুনাতে আসলে সত্যি সমস্যা। বং এরকম মানুষ যদি সিগারেট খাওয়া কোনো নারীকে হেয় করাকে সমর্থন করে পোস্ট দেন, তবে আমি মনে করি প্রতিবাদ হওয়া উচিত।
নারীবাদ আদর্শের অনুসারীর প্রতিবাদ করা উচিত। উনাদের মন্তব্যে নারীবাদীদের কিচ্ছু যায় আসে না, কিন্তু সমাজকে ঠিকটা দেখানোর দরকার আছে, সমাজকে তার হিপোক্রেসি ধরিয়ে দেওয়ার দরকার আছে।
প্রতিবাদ হোক প্রতিবাদের মতো, সিগারেটসহ পৃথিবীর কোনো বস্তুই জন্য কোনো একটা পক্ষের ব্যক্তিগত অধিকার না হয়ে যায়, শুধু নারী বলে যেন কাউকে হ্যারাসড হতে না হয়।
হিপোক্রেটদের আচরণের প্রতিবাদ করার, ভুলটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার সময় এটাই…….
শুধু নারী বলে যদি এসব ক্ষেত্রে হ্যারাসড হতে হয় তবে সেই লিঙ্গ বৈষ্যমের প্রতিবাদ হোক সর্বোচ্চ আওয়াজে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]