ছোটবেলা থেকেই আমি নারীবাদী, যা আমার অজানা ছিল
ভাবনা খন্দকার।। নারীবাদী নারীরা নাকি জীবনে সুখি হয় না! অনেক শুনে বড় হয়েছি এই বাণী। যখন নারীবাদ নারীবাদ শুনতাম, ভাবতাম এ আবার কী জিনিস? খায় নাকি মাথায় দেয়? তবে যতটুকুই বুঝতাম, এ বড্ড ঘোরতর অন্যায় কোনো জিনিস। আমিও ভাবতাম, নারীবাদ অনেক খারাপ এর নাম মুখে আনা পাপ। যারা এই ঘরানার মেয়ে তাদের ছেলেরা পছন্দ করে না, বিয়ে করে না, ভালোবাসে না। এরা চরম বেয়াদব আর উগ্র প্রকৃতির, চরিত্রের ঠিক নেই ইত্যাদি ইত্যাদি এমন হাজারো বাণী এদের নিয়ে৷
এই ঘোরতর পুরুষতান্ত্রিক একটা দেশে একপাল পুরুষের মাঝে (আমি যে পরিবারে বড় হয়েছি সে পরিবারে পুরুষের সংখ্যা বেশি)। বড় হয়ে পদে পদে তাদের অন্যায় আর বৈষম্যমূলক আচরণ, কথাবার্তা চালচলন, যৌন হয়রানি সব মিলিয়ে আমি ভীষণ ক্ষিপ্ত থাকতাম আর মনে মনে অনেক কিছুই চিন্তা করতাম- তারা এতো অন্যায় কীভাবে করে! আমার মা, বোন, চাচী, দাদী সবার সাথেই ঘোরতর অন্যায় হচ্ছে। আজ নারী বলে আমরা অনেক বৈষম্যের শিকার, বাক স্বাধীনতা নেই, পোশাকের স্বাধীনতা নেই, শান্তিমতন থাকার স্বাধীনতা নেই। সবচেয়ে বড় কথা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই যেটা সবচেয়ে জরুরি জীবনে মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য৷।
সবকিছুতেই আমি মেয়ে বলে এটা করা যাবে না, ওটা ধরা যাবে না, ওটা বলা যাবেনা এমন হাজারো ‘না’তে জীবনটা বিষিয়ে গিয়েছিল। ভাবতাম, এইগুলা আমার বদনসীব আমার সাথেই এসব কেন হবে। বড় হয়ে দেখি আমার মতন মেয়ে আরো আছে বরং আমাদের দলটাই ভারি। ততদিনে আমি নারীবাদ নিয়ে বিভিন্ন টেড টক দেখা শুরু করেছি, বিখ্যাত সব মানুষদের নারীবাদ নিয়ে বলতে দেখেছি। এরপর নিজ দায়িত্ব আর আগ্রহ থেকে শুরু করলাম পড়ালেখা। আস্তে আস্তে বিষয়টা পরিষ্কার হলো। পরে আবিষ্কার করলাম আমি নিজেই তো ছোটবেলা থেকেই একটা নারীবাদী শুধু একটা সংজ্ঞার অভাবে, জানার অভাবে তা আমার অজানা ছিলো।
নারীবাদ ভয়ের কোনো বস্তু নয়। এটি নিয়ে বললে বিস্তর আলোচনায় বই হয়ে যাবে। নিজের ভাষায় যা বুঝি আর উপলব্ধি করি, আবহমানকাল ধরে বয়ে চলা অন্যায় ও শোষনমূলক পুরুষতান্ত্রিকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অধিকার, নিজের ইচ্ছা, স্বাধীনতা সর্বোপরি নিজের মতন করে বাঁচতে চাওয়াটাই তো নারীবাদ। নিজের নানী, দাদী, মা, চাচীরা তো সারাজীবন শোষণ আর বঞ্চনায় কাটিয়ে দিলো। আপনি না হয় নারীবাদী হয়ে কাটান। নারীর অধিকারগুলো নিশ্চিত করুন। এতে ভবিষ্যতে যেসব শিশু নারী হয়ে উঠবে তারা শোষণ-বঞ্চনাহীন সাম্যের একটা পৃথিবী পাবে। আমরা নারীবাদীরা সেই স্বপ্নই দেখি৷
আমাদের পুরুষদের প্রতি কোনো বিদ্বেষ নেই। অনেকেই ভাবেন, আমরা পুরুষদের ঝাঁটা মারতে চাই। তাদের উদ্দেশ্যে বলি, পুরুষ নয় আমরা পুরুষতন্ত্রকে ঝাঁটা মারতে চাই। পুরুষ শুধু এই পুরুষতন্ত্রের একার ধারক ও বাহক নয়, আমাদের দেশের অধিকাংশ নারী-ই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পুরুষতন্ত্রকে সাপোর্ট করে। যখন পুরুষতান্ত্রের সমর্থকরা বলেন, আপনারা হিউম্যানিজম বিশ্বাস করেন, ইকুইটি আর জাস্টিস বিশ্বাস করেন কিন্তু ফেমিনিজমে বিশ্বাস করেন না, ঘৃণা করেন- তখন হাসি পায় আর ভাবি, নারীরা কি হিউম্যান না! তারা ইকুইটি আর জাস্টিস চাইলেই নারীবাদীরা খারাপ!
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]