May 15, 2024
সাহিত্যউপন্যাসফিচার ২

পৌনঃপুনিক [পর্ব – ১০]

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী ।।

রিকশা থেকে নেমে হাঁটা ধরে দোলন। অদ্ভুতভাবে রিকশাওয়ালা ভাড়া চায় না। দোলন আনমনে হেঁটে চলে। মফস্বলের চেনা রাস্তা। সন্ধ্যার টিমটিমে আলো। রাস্তার ধারে হাট বসার মতো পসরা সাজিয়ে বসে আছে কয়েকজন। চিতই পিঠাগুলো ধবধবে জোছনার মতো আলো ছড়াচ্ছে। ধোঁয়ায় ভেসে আসা পিঠার সুঘ্রাণ দোলনের খুব ভালো লাগছে। সারি সারি ঝুড়িতে উঁকি মেরে সে পিঠার সাথে মরিচ ভর্তা খুঁজছে। আশ্চর্য! এতো সুন্দর আয়োজন অথচ বিক্রেতাদের কারো পিঠা বিক্রি করায় মন নেই! সবার মুখে ঘোর অন্ধকার। সামনে এগোনোর জন্য পা বাড়াতেই কারা যেন অদ্ভুত নিরুত্তাপভাবে অথচ সমস্বরে বিড়বিড় করে বাধা দিতে থাকে – “ওদিকে যাবেন না! ওদিকে যাবেন না! মাছের মড়ক লেগেছে…।” দোলন এগোতো ঠিকই, “মড়ক লেগেছে” কথাটা শুনে থমকে দাঁড়ায়। টের পায়, হাতের তালু ঘামতে শুরু করেছে। আঁচলে ঘাম মুছতে মুছতে সে শংকিত হয়, দিয়া আর দীপ ঠিক আছে তো? ওদের কোনো বিপদ হয়নি তো? আদি?

মা আর আব্বুকে দেখতে যাওয়া হয়নি অনেকদিন। এমন দুঃস্বপ্ন কেন দেখছি?

মা! ও মা! ঠিক আছ?

কপালে দিয়ার হাতের স্পর্শ অনুভব করে দোলন। ঠিক মায়ের মতো দিয়ার হাতটা। কপালে রাখলে কেমন প্রশান্তি নেমে আসে।

পানি খাও! এতো ঘামছ যে!

মায়ের মতোই শান্তভাবে আদর করে পানির বোতল এগিয়ে দেয় মেয়েটা। পানির জন্য সত্যিই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে দোলনের। চুমুক দিয়ে মনে হয়, কত যুগ পর পানি খাচ্ছে সে। শরীরটা যেন ব্লটিং পেপারের মতো পানি শুষে নিচ্ছে।

স্বপ্ন দেখছিলে মা?

হ্যাঁ, কেমন যেন এলোমেলো সব স্বপ্ন!

থাক! বাদ দাও। ঠিক হয়ে যাবে। বেশি স্ট্রেস নিয়ে ফেলছো মা। একটু ব্রেক নাও। নানুর বাসায় চলো, যাবে?

মেয়ের কথা শুনতে ভালো লাগে দোলনের। এই তো সেদিনের বাচ্চা! কখন সে তার মেয়ে থেকে মা হয়ে উঠেছে হাবেভাবে, ভাবতে অবাক লাগে। দিয়ার মতো বয়সে মায়ের সাথে দোলনের সম্পর্কে এমন মধুরতা ছিল না। মায়ের যে কখনো স্ট্রেস হতে পারে সেই ধারণাই তাদের সময়ে ছিল না। “স্ট্রেস” শব্দটাই তখন উচ্চারিত হতে শোনেনি কখনো। তখনকার মায়েরা স্নেহের আধার ছিল কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু ছেলেমেয়েকে স্পেস দেয়ার কথা তারা ভাবতো না। অবেলার ঘুম ভেঙে দোলনের ভীষণ কান্না পায়। শুধুমাত্র আদিকে ভালোবেসে বিয়ে করাটাই মায়ের থেকে তাকে যোজন মাইল দূরে ঠেলে দিল! রিমি মাকে হারিয়েছে সেই কবে! রিমির ধারণা, মা বেঁচে থাকলে তার জীবনটা অন্যরকম হতো। আর দোলন ভাবে, মা থেকেও যেন হারিয়ে যাওয়া কোনো মানুষ! একুশটা বছর ধরে অদৃশ্য এক শীতলতা দুটো মানুষকে গ্রাস করেছে ধীরে ধীরে। দোলন আর কখনো মায়ের কাছে নিজেকে মেলে ধরতে পারেনি। মাও তো হাতটা বাড়িয়ে দেয়নি! প্রেম করে বিয়ে সে তো ভাইয়াও করেছে! ভাইয়া যখন নাইন-টেনে পড়ে তখন থেকেই বাড়িতে ওর বিশেষ মেয়ে বন্ধুরা আসা-যাওয়া করতো। ভাইয়া কলেজে ওঠার পর পড়ার ছুতোয় ছাদের ঘরে আস্তানা গাড়লো। তখন দোলনের ছাদে ওঠা বারণ। নোট দেয়া-নেয়ার নাম করে মুনিয়া এসে রোজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা দরজা বন্ধ করে আড্ডা দিতো। এখনকার ছেলেমেয়েদের ভাষায় “রুমডেট” যাকে বলে। মা যে বিষয়টা পছন্দ করতো, এমন না, কিন্তু সব জেনেও না জানার ভাব ধরে গোপন পাহারাদারি করতো। এদিকে, দোলনের খেলা বন্ধ করে দেয়া হলো – সেয়ানা, ধিঙ্গি মেয়েরা নাকি বাইরে খেলে না, পায়জামা-ফ্রিল দেয়া জামা পরলেও না। ওইটুকু বয়সে “সেয়ানা” “ধিঙ্গি” শব্দগুলো কি সাংঘাতিক, অপমানজনক ঠেকে দোলনের কানে! রোজ মনে হতো, “বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো!” রিমির খেলা বন্ধ হয়ে গেল। রুনু আপার বিয়ে হয়ে গেল। রিমির মা মারা যাওয়ার পর ওরা চলে গেল। লেনিন ভাইয়েরা আলাদা দল করে হৈ হৈ করে খেলতো ঠিকই। পথেঘাটে দেখা হলেও আড়ষ্টভাবে কুশল বিনিময় হতো কেবল। দোলন ক্রমশ একা হয়ে পড়ছিল। বুক ঢাকো, পা ঢাকো, জামার নিচে সেমিজ পরো! ছেলেদের সাথে কথা বলা যাবে না, যাদের সাথে শিশুকাল থেকে বেড়ে ওঠা, তাদের সাথে খেলা যাবে না। পিরিয়ড হলে মেয়ে সেয়ানা হয়ে যায় আর সেয়ানা হওয়াটা মহা অপরাধ! নাহলে দাদি-নানি মা-খালারা “সেয়ানা” হওয়ার অপরাধে খেলা বন্ধ করতে এতো উদগ্রীব হবে কেন?

প্রথম দিকে দোলনরা ঢাকা থেকে বদলি হয়ে যাওয়াতে এমনিতেই সবাই কিছুটা দূরত্ব রেখে মিশতো কেন যেন। তারপর যখন সবার সাথে মিলেমিশে বন্ধুত্বপূর্ণ একটা জগৎ তৈরি হলো, তখনই আবার কে কোথায় হারিয়ে গেল! মা কি আজো উপলব্ধি করতে পারে, তার একমাত্র মেয়েটা জীবন থেকে কবে কখন দলছুট হয়ে গেল?

চোখেমুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিতে দিতে স্বপ্নের কথাটা আবার মনে পড়লো দোলনের।

“ওদিকে যাবেন না! ওদিকে যাবেন না! মড়ক লেগেছে।”

মা আর আব্বুকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছে!

[চলবে]

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী : সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা। এই মুহূর্তে শিল্পকর্ম এবং স্বাধীন লেখালিখিতে ডুবে থাকাতেই স্বচ্ছন্দ। মিশ্র মাধ্যমে শিল্পকর্মের বিষয় হিসেবে জানালার গল্পের আড়ালে আসলে ফেলে আসা সময়, স্মৃতির সঞ্চয় অথবা জীবনের কোনো চেনা গল্প রয়ে যায়। জীবনের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় নানা ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে যে বিষয়গুলো বিশেষভাবে ভাবায় : নারী – পুরুষের সমতা, সম্পর্কের  টানাপোড়ন ও জটিলতা। পারিবারিক – সামাজিক নির্যাতন ও বৈষম্য। শিশুর নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আড়াই লক্ষাধিক বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী জীবন সংগ্রামের ইতিহাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *