পিরিয়ড নিয়ে কেন এত কৌতুহল, এত গোপনীয়তা!
সাইফুল বিন হাসান।। পিরিয়ড যাকে সহজ ভাষায় আমরা অনেকে “মাসিক” বলে থাকি। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিটি নারীর প্রাপ্তবয়স হলে প্রকৃতিগত কারণে পিরিয়ড হয়ে থাকে। এটা কোন লজ্জার কিংবা অপরাধ না। এটা যে লজ্জার আর অপরাধের কিছু না এ কথা আমরা সকলে বুঝি এবং অন্যদের সামনে বড় মুখ করে আলোচনার মাঝে কথা ছুড়ে দিই। কিন্তু… এই কিন্তুতেই পিরিয়ড নিয়ে আমরা গোপন এক ধরণের কৌতুহল জন্ম দিই নিজের মনের ভেতর।
পিরিয়ড নিয়ে অনেকের আবার বেশ আগ্রহ, তারা সুযোগ পেলে যে কোন নারীকে এটা নিয়ে অনেক প্রশ্ন করে থাকে, যেন জানার আগ্রহের কোন শেষ নেই। জানার জন্য হলে বেশ ভালো, কিন্তু এটা যদি হয় এমন প্রশ্ন “ঐটা হয় নাকি? কীভাবে হয়? কোন দিক দিয়ে হয়? তখন কেমন অনুভূতি হয়?” এমনটা তো জানার জন্য না! মনের ভেতরে থাকা অবদমিত যৌনতাকে সুখ দেয়ার জন্যই প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া। প্রকৃতিগত ভাবে পিরিয়ড হবে, সেটা অতি সাধারণ একটা বিষয় কিন্তু তা যদি ভিন্ন অর্থে এবং ভিন্ন ভাবে দেখা হয় তবে হবে সেটা অপরাধ, শুধু অপরাধ নয় নারীকে অপদস্থ করার জন্য ঘোরতর অপরাধ।
আর যদি পিরিয়ড নিয়ে গোপনীয়তার কথা বলতে হয়, তাহলে মনে পড়ে আমার কলেজ জীবনের কথা। “আমরা বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধবী গ্রুপ করেই কলেজে যেতাম, আড্ডা দিতাম। হঠাৎ একদিন আমাদের এক বান্ধবী কলেজে আসেনি, আমি যথারীতি তাকে ফোন দিলাম কেন এলো না, কিন্তু সে ফোন ধরলো না। পরে আড্ডা যখন দিচ্ছি তখন অন্য এক বন্ধু বলল, কি রে ও আজকে আসেনি কেন। এক বান্ধবী বলে উঠলো, তার আজ শরীর খারাপ তাই আসেনি। আমি বললাম, শরীর খারাপ জ্বরটর হলো নাকি রে। বান্ধবী বলল, আরে না ঐ মেয়েলী সমস্যা। আমি বললাম, ও আচ্ছা পিরিয়ড হয়েছে। তাই তো বলি আজ আসেনি কেন, এত ইমপরটেন্ট ক্লাস করলো না। তারে নোট দিয়ে দিস।
এ কথা শুনে আমার বান্ধবী আমাকে যথারীতি বকা দেয়া শুরু করে দিলো। আমি তো অবাক এমন কি বললাম যে সে বকা দিচ্ছে। পরে সে বলে এটার নাম নাকি নেওয়া যাবে না। পরে বুঝলাম “পিরিয়ড” শব্দটা উচ্চারণ করাই আমার পাপ হয়েছে। এর জায়গায় আমার বলার দরকার ছিলো তার মত করেই “মেয়েলী সমস্যা”। বুঝতে পারলাম বড় পাপ কাজটাই করে ফেলেছি পিরিয়ড নামটা ধরে। আচ্ছা বুঝলাম পিরিয়ড নামটা বলে পাপ হলো, কিন্তু মেয়েলী সমস্যা, এখানে সমস্যা শব্দটা কেন ব্যবহার হলো। এটি অতি সাধারণ ও স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু এটাকে সমস্যা শব্দ ব্যবহার করে এমন অর্থ দাঁড় করালো যেন সেটা অপরাধ।
এটাতো অপরাধ বা গোপনীয়তার কিছুই না, সহজ ও স্বাভাবিক একটা বিষয়। কিন্তু এটাকে আমরা জটিল করে তুলেছি। আসলে সেটা হয়েছে আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির জন্য।
আবার দেখুন আমরা সকলে স্যানিটারি প্যাড চিনি। এটা মাসিকের সময় মেয়েরা ব্যবহার করে থাকে। যাতে সে জীবাণু থেকে দূরে, সুস্থ স্বাভাবিক, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পারে। স্যানিটারি প্যাড এটা এমন কিছু না যেটা দোকানে গিয়ে দোকানদারকে কানে কানে বলতে হবে বা চুপিসারে কিংবা ইশারা করে দেখিয়ে দেয়ার মত কিছু। আমাদের মনে হয় আমরা অবৈধ কিছু ক্রয় করতে গিয়েছি দোকানদারের কাছ থেকে। তাই আস্তে করে বলতে হবে বা ইশারা করে বলতে হবে যেন পাশের জন শুনতে না পায়। শুনতে পেলেই ইজ্জত যাবে!
আর আমাদের পরিবারগুলোতে কী হয়? মেয়েদেরকে ছোট থেকেই পিরিয়ড যে স্বাভাবিক বিষয় এবং এতে আতংক হওয়ার কিছু নেই, পিরিয়ড হলে কী করণীয়- এসব সম্পর্কে কিছু বলা বা পারিবারিক শিক্ষা দেওয়া হয় না। যার কারণে যখন পিরিয়ড হয় তখন মেয়েরা ঘাবড়ে যায় এবং এটা গোপন করার চেষ্টা করে, যাতে কেউ জানতে বা বুঝতে না পারে। কেউ জেনে গেলে তার ইজ্জত যাবে, এটা একটা লজ্জার বিষয়, অপরাধ- এমন ধারণা পুষে রাখে মনের ভেতর।
পিরিয়ড স্বাভাবিক ও প্রকৃতিগত একটি বিষয়, যেটি শুধুমাত্র মেয়েদের হয়ে থাকে আর যার কারণে তাদের শরীরে বিশেষ কিছু পরিবর্তন ঘটে যার মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পৃথিবীতে আসার পথ সৃষ্টি হয়।
তাই আসুন পিরিয়ড নিয়ে অতি কৌতুহলজনিত প্রশ্ন ছুড়ে নারীকে বিব্রত না করি এবং মাথায় রাখি যে এতে গোপনীয়তার বা লজ্জার কিছু নেই। সহজ ও স্বাভাবিক বিষয় সহজ-স্বাভাবিকভাবেই জেনে রাখা ও মেনে নেয়া উচিত।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]