নারীর সুশিক্ষা বনাম পুরুষের উপার্জনে বসে খাওয়ার শিক্ষা
মৃদু জামান।। নারীকে বলা হয় পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে সুন্দর এবং সহনশীল সৃষ্টি। বলা হয় নারী জন্মগতভাবেই এক ধরনের ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। যদিও বিষয়টি জন্মগত নাকি সামাজিক বেড়ে ওঠার ফল, সেটি আলোচনা সাপেক্ষ। সে যাই হোক, নারীর প্রতি সহিংসতা, তার স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, শিক্ষা নিয়ে অনেক তো হলো। তাহলে এবার নাহয় নারীর ‘সুশিক্ষা’ নিয়ে কিছু কথা বলা হোক!
নারীর মানসিকতার পারিপার্শ্বিক শিক্ষা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। পূর্ব পুরুষদের একটি প্রবাদই যেন এর প্রমাণ দিয়ে যায় বার বার –
“মাছ ধরলে মাগুর,
বর ধরলে ঠাকুর।”
দুই পংক্তির এই উক্তিই যেন সমাজের ঠিক করে দেয়া পুরুষদের যোগ্যতার মাপকাঠি বলে দেয়। ছেলেবেলা থেকেই একটি বেঞ্চমার্ক সেট করে দেয়া হয় অধিকাংশ মেয়ের মনে। এই চিন্তাভাবনা ও মানসিকতার যে বীজটি একটি বাচ্চা মেয়ের মনে গেঁথে দেয়া হচ্ছে, প্রাপ্তবয়সে সেই বীজ অল্প অল্প করে শাখা-প্রশাখার মত নিজেকে মেলে দেয় মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে। সেখানে সমতা বা ইকুয়্যাল কন্ট্রিবিউসান- এই ধরনের আইডিওলজির জন্য কোনো জায়গা থাকে না। তখন নারীদের কাছে পুরুষের সাফল্য কেবল মোটা অংকের মাইনে আর নিজের সাফল্য সন্তান সন্ততির সংখ্যা অবধিই সীমিত থেকে যায়। সংসারের হাল ধরতে গিয়ে তখন কর্তার হাল বেহাল। তালগোল পেকে যায় সব কিছুতে। তখন বেটার হাফ কিংবা অর্ধাঙ্গিনীর মত টার্মসগুলো ভিত্তিহীন হয়ে পড়ে। এরপর শুরু হয় ঝগড়া-বিবাদ-কলহ… শেষ অবধি বিচ্ছেদ।
তখন নারীরা সমাজের কাছ থেকে “গোল্ড ডিগার” নামক এক নতুন তকমায় ভূষিত হয়। কিন্তু আসলে বিহাইন্ড দ্যা সিনে কী আছে? এত সহনশীলতায় পরিপূর্ণ একটি মানুষ হঠাৎ করেই কীভাবে পালটে যায়? কেনই বা নারীরা তাদের সঙ্গীদের অর্জিত উপার্জনকেই সুখের একমাত্র উৎস হিসেবে ধরে নেয়? কারণ সমাজ থেকেই নারী শিখেছে পুরুষের ধর্ম উপার্জন আর নারী ধর্ম সংসার। এই গণ্ডির বাইরে অনেক শিক্ষিত নারীরাও যেতে পারেন না।
অনেক মেয়েই জ্ঞান আহরনের ব্যাপারে সচেতন হলেও উপার্জনের বেলায় তেমন উৎসাহী নয়। লক্ষাধিক টাকা খরচ করে গ্র্যাজুয়েট হয়ে এরা ডক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা বড় কোনো ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট বিয়ে করে থিতু হয়ে যান। তারা ভাবতেই পারেন না যে বিয়ে করে স্বামীর উপার্জিত অর্থে ফাইনালসিয়্যালি সল্ভেন্ট হওয়াটা কোনো গর্বের কোনো বিষয় নয়। সমাজ এদেরকে এক ভুল কনসেপ্টের ভেতরে এমন ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে রেখেছে যার বাইরে এরা যেতে পারে না কিংবা যেতে চায় না।
যদি ভাত রাঁধা আর উপার্জন করার মত বেসিক সারভাইবাল স্কিলগুলো সমাজ লিঙ্গের মাঝে বিভক্ত না করতো, যদি স্বামীর মাথায় বসে কাঁঠাল ভেঙ্গে খাবার চেয়ে আত্মনির্ভরশীলতা ও পরিচয় গড়ার শিক্ষা নারী পেতেন, তাহলে হয়তো তারা আগাছার মত স্বামীর ঘাড়ে পেচিয়ে যেতে সংকোচ বোধ করতেন। সাংসারিক কলহও কমে যেতে পারতো। পৃথিবীটা আরো শান্তির জায়গা হতে পারতো। তাই নারীশিক্ষাই শুধু নয়, নারীর সুশিক্ষাও খুব জরুরি। আর এই সুশিক্ষার ভেতর দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানো ও নিজে উপার্জনের মানসিকতা তৈরি হওয়াটাই আসল কথা।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]