November 21, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

পুরুষ হলে ‘মানবাধিকার’, নারী হলে ‘বেশ্যা’!

প্রিয়া দেব।। আজকাল একটু গভীরভাবে ভাবলে আমি দেখি যুগ বদলেছে,আমরা আধুনিক হয়েছি, আমাদের চিন্তাভাবনা বদলেছে, আমাদের হাতের কাছে প্রযুক্তি বদলেছে, কিন্তু নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির বেলাতে এ সমাজ মোটেও বদলায়নি। বরং সমাজ সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে নিত্য নতুনভাবে জটিল করে তুলেছে একজন নারীর জন্য।

আপনি আজকে যেকোনো চলমান ইস্যুর দিকে তাকান, যেকোনো পত্রিকাতে চোখ রাখুন, যেকোনো টিভি অ্যাড দেখুন, বুঝতে পারবেন নারীদের অবস্থান সেখানে কী রকম। আপনি পক্ষপাতদুষ্ট না হলে স্পষ্ট বুঝতে পারবেন এখানে যেকোনো জায়গায় নারী চরিত্রের উপস্থিতিটা কী রকম।

আসুন চলতি ঘটনাটা দেখি। একজন মানুষ এক্সপোজড হয়েছেন, তার পক্ষে তার মুরিদসহ হাজার হাজার সুশীল দাঁড়িয়ে গেছেন। তিনি পরকীয়া করলেও সেটা বৈধ এমন দাবি নিয়ে তারা দাঁড়িয়েছেন চরিত্রটির পাশে। বিষয়টা খারাপ না, এমন বোধোদয়ই তো দরকার। কিন্তু আমার খারাপ লাগে যখন এদেশে মিথিলার মতো সেলিব্রেটিদের যখন নিজের প্রেমিকের সাথে ছবি ভাইরাল হয়, তখন এই প্রগতিশীল মানুষেরা, বিশেষ করে পুরুষেরা প্রচুর মজা নেন। তারা মিম শেয়ার করেন, ডাবল মিনিং জোকস করেন, কমেন্টের লাইনে লাইনে তাদের হাস্যরসাত্মক বুদ্ধির পরিচয় থাকে।

বিশ্বাস করুন আমি তখন তাদের একবারো ওই সেলিব্রেটি মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে কোনো পোস্ট দিতে দেখি না। তারা বলেন না ‘‘মিথিলা যাই করুন না কেন সেখানে কাঁদা ছোড়ার, মজা নেওয়ার অধিকার জনসাধারণের নেই।”

তখন তারা সেখানে অন্যায় দেখেন না। কি সুন্দর হিপোক্রেসি!

সব বাদ দিন, কয়েকদিন আগে ক্রিকেটার নাসিরের স্ত্রী তামিমাকে নিয়ে কি নোংরা ট্রল করলো এ দেশের জনগন।

‘‘তামিমা বেশ্যা, তামিমা বারোভাতারী।” শব্দগুলোর চাপে সোশ্যাল মিডিয়াতে আর কোনো নিউজই দেখা যাচ্ছিলো না। সেই তামিমাকে নিয়ে যথেষ্ট মজা প্রগতিশীলরাও নিয়েছেন, কেউ মনে করেননি এখানে তাদের তামিমা নামক মেয়েটাকে নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা উচিত।

আজকে যে লোক এক্সপোজড হলেন, তিনি যখন সারাবছর ধরে নারীবিদ্বেষী ওয়াজ করে গেছেন, নারীদের নিয়ে নোংরা নোংরা মন্তব্য করে গেছেন, তখনো তার বিরুদ্ধে কোনো প্রগতিশীল কথা বলেননি, তার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামার সাহস করেন নি।

নারী সম্পর্কে এমন মন্তব্য এতোটাই স্বাভাবিক উনাদের কাছে যে হাতে গোনা  ক’জন ছাড়া কেউই এই বিষয়ে একটা প্রতিবাদ করেননি। সেটা অবশ্যই তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, কিন্তু অবাক লাগে সেই নোংরা মন্তব্যকারীকে নিয়ে উনারা হিউম্যান রাইটসের কথা বলেন, ‘‘ব্যক্তিগত’’ শব্দটা ব্যবহার করেন। এই শব্দগুলো ব্যবহার কেন উনারা এতোদিন যখন নারীদের অবমাননা করা হয়েছিল তখন করেন নি, তা আমার কাছে পরিষ্কার না।

সমাজের অবস্থাটা এখন এরকম যে, যেকোনো ঘটনায় পুরুষ মূল চরিত্রে থাকলে নীতিকথা, আইন, মূল্যবোধ সবকিছুর সংজ্ঞা সবাই ব্যবহার  ক’রে পুরুষটির কাজকে জাস্টিফাই করবে, কিন্তু যদি নারী মূল চরিত্রে থাকে তবে সেটা নিয়ে ট্রল হবে, মিম হবে, মেয়ের চরিত্র নিয়ে নোংরা ডাবল মিনিং কথা হবে।

এবং এ সবকিছু মিলিয়ে একটা জিনিস স্পষ্ট বোঝায়। আর সেটা হচ্ছে সমাজের নিচের স্তর থেকে শুরু করে এলিট স্তর- কোথাও নারীর অবস্থান এখনো শক্ত না। পার্থক্য একটাই- যারা সমাজের তথাকথিত নিচের স্তরের মানুষ, তারা প্রকাশ্যে নারীকে গালিগালাজ করে, আর আমাদের এলিট শ্রেণিরা তাদের বিশুদ্ধ ভাষায় নারীকে হেয় করেন।

আর নারী যদি নারীবাদী হয় তবে তো হয়েই গেল। প্রতিটা কথায় ওই নারীবাদী শব্দ টেনে নারীকে নিচু করা হবে ,দেখে মনে হয় নারীবাদী শব্দটা টেনে কাউকে কথা বললে বিশাল বড় আঘাত দেওয়া যায়।

এই বর্তমান ইস্যুতেই সবাই মিলে দ্বিতীয় বিয়ে থেকে শুরু করে পরকীয়া পর্যন্ত জায়েজ করা শুরু করেছেন। কিন্তু একবার এখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রে একটা নারীকে ভেবে দেখুন তো? ভাবতে কষ্ট হলে মিথিলা, নাসিরের স্ত্রী তামিমা আপনার সামনেই আছেন। এদের ঘটনাতে ট্রল করলে যারা হা হা রিয়্যাক্ট দেন, সেই তারাই বর্তমান ঘটনায় কয়েকজন নারী আনন্দ প্রকাশ করাতে তাদের ধুয়ে দিয়েছেন। কারণ বিষয় বিভেদে উনারা প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী হয়ে যান।

সমাজের এই দুই ক্ষেত্রে ভিন্ন অবস্থান কি আপনাকে ভাবায় না? না ভাবালে নারী হিসেবে ভাবতে শিখুন।

আমার ভীষণ হতাশ লাগে, যখন প্রতিনিয়ত এরকম ডাবল স্ট্যান্ডার্ড রোল প্লে করে যায় সমাজ, তখন আমার সত্যি হতাশ লাগে।

আজকে আমি শুধু নারী বলে একটা বিষয়ে বারবার অপদস্ত হবো, কিন্তু নীতিবিহীন পুরুষেরা সেখানে বিশাল প্রিভিলেজ পাবেন, এটাই তো বর্তমানের দৃশ্যপট।

মানুষের অধিকার নিয়ে প্রতিবাদ হোক। কিন্তু মানুষ বলতেই যেন পুরুষ না ভাবা হয়। নারী পুরুষ উভয়েই মানুষ এ সত্য যেন সবার মাথায় ঢোকে।

যে লোকের মানবাধিকার নিয়ে আজকে লড়াই চলছে, সেই লোক যখন নারীদের নিয়ে একের পর এক নোংরা মন্তব্য করে, তখনো যেন এই সমাজ তাদের স্ট্যান্ড বজায় রেখে নারীর পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে। তখন শুধু জুজুর ভয়ে যেন তারা না পালায়!যে লোকের বিরুদ্ধে জানের ভয়ে আওয়াজ তুলতে পারেন না, সেই লোকের জন্য মানবাধিকার নিয়ে চ্যাচানোর আগে যেন এতোদিনের ওই জানের ভয় নামক অজুহাতটা মাথায় থাকে।

আজকেও দেখলাম শ্বশুর শাশুড়ির সেবা করলে শাড়ি উপহার দেওয়ার নিউজে বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী, ধার্মিকরা নারীবাদীদের এসব দেখে শিক্ষা নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করছেন, কিন্তু এই মানুষেরাই প্রতিদিন স্বামীগৃহে নারী নির্যাতনের ঘটনায় চুপ করে থাকেন। মাত্র দুদিন আগের ঘটনা, যেখানে স্বামী স্ত্রীকে খুন করে দূর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিচ্ছিলেন সে ইস্যুতেও উনারা একটা শব্দ বলেননি। উনারা তখন ডমেস্টিক ভায়োলেন্স নিয়ে একবারো আলোচনা করবার প্রয়োজন অনুভব করেন নি।

এইতো আমাদের আধুনিক সমাজের চিত্র।

তাই নারীদের লড়াই চলবে। যতোদিন সমাজ তাদের মানুষ ভাববে না ততোদিন এ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটকে এটা অনুধাবন করা সবচেয়ে জরুরি।

নারীকে বুঝতে হবে এ সমাজের উঁচু থেকে নিচু প্রতিটা জায়গাতেই সে নিপীড়িত। তাই লড়াইটা পুরো সমাজের বিরুদ্ধেই করতে হবে। পৃথিবী মানুষের হোক, মানবিকতার হোক। কিন্তু তার আগে নারীদের মানুষ ভাবা হোক। নারী কোনো বিনোদন সামগ্রী কিংবা শো পিস না- এ সত্য প্রতিটা মানুষের মাথায় ঢুকুক।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]