November 22, 2024
মুক্তমত

পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেমে বিয়ে: বলির পাঁঠা নারী ও পুরুষ

মিলি স্বপ্নময়ী।। মানুষ বিয়ে করে কেন? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলা যায় যে, এখানে নারী এবং পুরুষের বিয়ে করার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন কারণ থাকে। যদি একটা সরলীকরণ করে নারী-পুরুষের বিয়ের প্রয়োজনীয়তা দাঁড় করাতে চাই, তাহলে মূলত দুটো বিষয় সামনে চলে আসে:

জৈবিক চাহিদা মিটানো এবং বংশ বৃদ্ধি করা।

জৈবিক চাহিদা খুবই প্রাকৃতিক একটা বিষয়, যা প্রতিটা মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য। অনেকটা পেটের ক্ষুধার মতো জৈবিক চাহিদাকে মনে হয়। মানুষ যখন প্রচন্ড ক্ষুধার্ত থাকে, তখন তার প্রধান উদ্দেশ্য থাকে ক্ষুধা নিবারণ করা। সেই মূহুর্তে সামনে যা পাবে, তাই সে খাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করবে। তখন কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষুধার্ত ব্যক্তির মাথায় থাকেনা সে আসলে কী খাবার খাচ্ছে অথবা তার স্বাদ কেমন।

পেটের ক্ষুধাকে যেমন কোনো কিছু দিয়েই আড়াল করা যায়না, তেমনি মানুষও জৈবিক চাহিদাকেও অস্বীকার করতে পারেনা।

আমাদের বাবা-মা এবং সমাজ অবাধ যৌনতার লাগাম টানার ইচ্ছেয় একটা বয়সের পর ধর্মীয়, সামাজিক, পারিবারিক নিয়ম মেনে বিয়ে প্রথার মাধ্যমে মানুষের যৌনতাকে বৈধতা দেয়। এর সাথে অবধারিতভাবে যুক্ত হয়ে যায় বংশ বৃদ্ধির প্রক্রিয়া। মানুষ কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিকল্পনা ছাড়াই সন্তান সৃষ্টি করেন। এমন বাবা-মা খুব কমই আছেন যারা পরিকল্পনা করে সন্তানের জন্ম দেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সন্তানসম্ভবা নারীকে বলতে শোনা যায়, হুট করেই হয়ে গেছে অথবা দুর্ঘটনাবশত গর্ভবতী হয়েছেন।

নারী -পুরুষ ভেদে বিয়ের পিছনে আরো পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় কারণ যুক্ত হয়।

আমাদের দেশে মেয়েদের নিয়ে একটা কথা প্রচলিত আছে, তা হলো কুড়িতেই বুড়ি। এই প্রচলিত কথা থেকেই বোঝা যায়, এই দেশে মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে বয়স কীভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।

পুরুষরা বিয়ে করার ক্ষেত্রে সবসময় অল্প বয়সী মেয়ে খোঁজেন। একজন চল্লিশ বছরের পুরুষও অনেক সময় বিয়ে করতে গিয়ে  সদ্য পঁচিশ পার করা মেয়েটিকে নিয়ে মন্তব্য করে ফেলতে পারেন যে, এই মেয়ের বয়স বেশি।আমাদের সমাজের বেশিরভাগ শিক্ষিত পুরুষ বিয়ে করার সময় ১৮-২২ বছরের শিক্ষার্থী মেয়ে চান। শিক্ষার্থী পাত্রী এই কারণেই চান যে, যাতে সমাজে বলে বেড়ানো যায় বউ পড়ালেখা জানে, যেহেতু পাত্র উচ্চশিক্ষিত, তার সাথে তো অশিক্ষিত মেয়ে কোনোভাবেই যায়না। আবার সেই মেয়েটিই যখন বিয়ের দু -এক বছরের মাথায় সন্তানসম্ভবা হয়ে যায়, তখন বেশিরভাগ নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে সেই মেয়ের পড়ালেখা লাটে উঠে বসে থাকে, অনেকের পড়ালেখা শেষ করা সম্ভব হয়না, সেখানে কেরিয়ার গড়া বহুদূরের বিষয়।

একদিন রাতের বেলা টেম্পুতে করে বাসায় ফেরার সময় আমার উল্টো দিকে বসা দুজন ছেলে মেয়েদের বয়স নিয়ে গবেষণা করছিলেন আমার সামনেই। তাদের মতে ২৫ পার করা কোনো মেয়েকে কোনোভাবেই বিয়ে করা সম্ভব না, কারণ যদি বয়স বেশি হয়ে যায়, তখন মেয়েদের ম্যাচুরিটি চলে আসে এবং নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়। সবচেয়ে ভালো হয় ১৮-২০ বছরের মেয়ে বিয়ে করা।

এটা খুবই সঠিক কথা যে, পুরুষরা অল্প বয়সী মেয়ে বিয়ে করতে চান, তার পিছনে যেমন  মেয়েদের কচি শারীরিক গড়ন একটা কারণ, তেমনি যে মেয়ে যত কচি, তাকে ততো বেশি নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব, এটাও পুরুষতান্ত্রিক এক নোংরা চিন্তার প্রতিফলন। একজন উচ্চশিক্ষিত, সচেতন, প্রতিষ্ঠিত নারীকে চাইলেই যেমন তেমনভাবে হাতের মুঠোয় ধরে রাখা যাবেনা, এই ধরে রাখা যাবেনা চিন্তাটাই পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেমকে ভীত করে রাখে।

অবশ্য শুধু পুরুষদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। মেয়ের বাবা-মায়েরাও এইক্ষেত্রে কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই। মেয়েদের একটা বয়সের পর মায়েরাই সবচেয়ে বেশি মানসিক যন্ত্রনা মেয়েকে দিয়ে ফেলেন অসচেতনভাবেই। কারণ মায়েরা মনে করেন, বয়স হচ্ছে মানে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না, মেয়ের বিয়ে দিতে না পারলে নানাজন নানা ধরনের কথা বলবে, মাথার উপর বিরাট বোঝা হয়ে যায় তখন মেয়ে।

একটা বয়সের পরে এই সমাজে মেয়েরা আসলেই বাবা-মায়ের বোঝা হয়ে যায় এবং যেকোনো মূল্যে তারা ঘাড় থেকে এই বোঝা সরাতে চান। এটাই আমাদের সমাজের চিত্র, এই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা দ্বারা আমাদের মায়েরাও প্রভাবিত। পত্রিকা খুললেই যত নারীর আত্মহননের খবর পাওয়া যায় অথবা স্বামী কর্তৃক খুনের ঘটনা সামনে চলে আসে, ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, মেয়ে সংসার জীবনে অসুখি জেনেও আমাদের মেয়ের বাবা-মায়েরা ‘মানিয়ে নাও, মানিয়ে নাও’ বলতে বলতে একসময় মেয়ের আত্মহননের বা খুনের পরোক্ষ কারণ হয়ে যান। কিন্তু তখন দীর্ঘশ্বাস আর চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছুই করার থাকেনা। এই কারণেই বোধহয় বলা হয় আমাদের সমাজে মেয়েদের বিয়ে দেয়া হয় বা মেয়েরা বিয়েতে বসে আর ছেলেরা বিয়ে করে।

আমরা ভাবি যে পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেম বোধহয় পুরুষকে সব দিক থেকে সুবিধাভোগী করে, ক্ষমতাশালী করে। কিন্তু সুবিধাভোগী আর ক্ষমতাবান হওয়ার পাশাপাশি যে পুরুষকে এই পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেম কলুর বলদও করে রাখে সেটা বোধহয় আমরা বুঝতে পারিনা। যে সিস্টেমের বলি হয়ে একজন পুরুষকে বিয়ের পরে পুরো সংসারের দায়ভার কাঁধে নিতে হয়, তার যতই শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম হোক না কেন! বিপরীতে বউ যতই উচ্চশিক্ষিত, যোগ্য হোক না কেন, এই সিস্টেম তাকে ভাবতে বাধ্য করে যে, রোজগারের দায়িত্ব শুধু পুরুষের। ফলে ঘরে বউকে রেখে কলুর বলদের মতো মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, শুধুমাত্র সিস্টেম দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাকে জীবন পাত করে সংসারের জন্যে রোজগার করে যেতেই হবে, এইক্ষেত্রে পুরুষও নিষ্ঠুরভাবে ভিক্টিম হয়ে যায় না বুঝেই, সচেতনতার অভাবে।

যেসব পুরুষ স্বাধীনচেতা স্বভাবের, তারা যদি কোনো কারণে বিয়ে নামক প্রথাতে আবদ্ধ হতে না চায়, তাহলে পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেম তাকে বাধ্য করে, প্ররোচনা দেয়, নানান কটু কথা বলে বিয়ে করার জন্যে।

আমরা ভাবি, যে মেয়েরা বিয়ে করতে চায়না, তাদেরকেই বোধহয় নানা রকম প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়, কিন্তু একটু গভীরভাবে আপনার চারপাশের অবিবাহিত পুরুষদের জীবনের গল্প জানার চেষ্টা করলে বুঝবেন, তাদের জীবনেও প্রতিবন্ধকতার শেষ নেই, নারীর পাশাপাশি সিস্টেমের বলির পাঁঠা তারাও হয়।

আমি বিয়েবিরোধী মানুষ না, আবার শুধুমাত্র বিয়ে করতে হবে বলে করা- তেমন চিন্তার পক্ষপাতীও না। বিয়ে জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত, যে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার জন্যে বিয়ের আগে নারী-পুরুষের একে অপরকে জানা-বোঝার পরিবেশ এবং সুযোগ দরকার। সেই পরিবেশ যদি তৈরি হয়, তবে কে কাকে বিয়ে করবে, কার সাথে কাকে মানাবে, তা ছেলে মেয়েরা নিজেরাই ঠিক করুক না, তাতে আমাদের কি বা যায় আসে!

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]