November 21, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

এইজ শেমিং: নারীকে দমিয়ে রাখার কৌশল

লামিয়া ইসলাম।। এইজ শেমিং যুগের পর যুগ ধরে হয়ে আসা একটি ভয়াবহ সমস্যা। এইজ শেমিং মানে কাউকে বয়স নিয়ে ট্রল করা। একটু বয়স্ক ব্যক্তিরা যদি একটু সুন্দর হয় তবে তা নিয়ে শুরু হয় এক শ্রেণির মাথাব্যথা। কেন বয়স ৪০ এর পরও কাউকে সুন্দর থাকতে হবে! এমনকি মা হওয়ার পরেই কারু যেন আর সুন্দর থাকা, স্মার্ট থাকা সচেতন হওয়া বারণ।

যুগের পর যুগ ধরে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ শিখিয়েছে নারীরা সংসারের জন্য খাটতে খাটতে নিজেকে বিলিয়ে দেবে, মা হওয়ার পর থেকে আর নিজের যত্ন নেবে না। যদি নেয় তবে সে খারাপ ও স্বার্থপর। অভিনেত্রী জয়া আহসানের সামাজিক যোগাযোগ্য মাধ্যমের কমেন্ট বক্সের নিচে যেসব নোংরা এইজ শেমিং দেখেন এর কারণ মূলত অনেকগুলো। প্রথমত বিয়ে না করে সাকসেসফুলি এই সমাজে টিকে থাকা মেয়ে, যার বয়স এদের তথাকথিত নিয়মের বিয়ের বয়সের অধিক আর দ্বিতীয়ত সে সুন্দর। এই বিষয়গুলোর সাথে মোটামুটি আমরা সবাই পরিচিত। এটার আরেকটাই ফর্ম হলো ছোট বলে এইজ শেমিং।

আমাদের সমাজে ধরেই নেওয়া হয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে হলে তাকে ৪০/৫০ বছরের মানুষ হতে হবে। অন্তত নারীদের ক্ষেত্রে তো অবশ্যই। কম বয়সের কেউ হয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মন্তব্য করেছেন তো মরেছেন। আপনার মন্তব্য খুলে দেখার আগেই বা শোনার আগেই হাসাহাসি বা তাচ্ছিল্যপূর্ন মনোভাব দেখানো শুরু হয়ে যাবে। অথচ ৬০/৭০ বছর বয়সী মানুষও চরম পুরুষতান্ত্রিক ও অযৌক্তিক হতে পারে। আবার একটা ১২ বছরের বাচ্চাও অনেক জ্ঞান বুদ্ধি রাখতে পারে। কথা হওয়া উচিত কথা যৌক্তিক নাকি অযৌক্তিক। সঠিক না বেঠিক সেই প্রসঙ্গে। অথচ হাসাহাসি শুরু হয়ে যায় কম বয়সী নারী দেখলেও। কেউ বা বলার সুযোগ করে দিলেও সেটা খুবই দয়া দেখানো ভাব নিয়ে বলতে দেওয়া হয়। এর কারণে এরা শিখে এসেছে যে নারীর বুদ্ধি কম। তাদের মতামত নেওয়া যাবেনা। সেটা যে শুধু অশিক্ষিত সমাজে তা নয়। বহু বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, ইন্টেলেকচুয়াল মানুষদেরও নারীবাদী বিদ্বেষি হতে দেখেছি। কোনো রকম বাছবিচার বা যৌক্তিক সমালোচনায় না এসেই নারীবাদী শুনেই মুখ বাকা করতে দেখেছি। তো যার বুদ্ধি ‘এমনিই কম’ বলে তারা মনে করে, আর তার উপর যদি সে হয় কম বয়সী, তবে তার কথা না শুনেই যেন তাকে এজ শেমিং করা, ঠাট্টা, বিদ্রুপ উপহাস করাই যায়। এদের মানসিকতা এমন যে অল্প বয়সের ছেলের কাছে যদিও কথায় হারা যায়, কিন্তু অল্প বয়সী নারীর কাছে কথায় তর্কে হারাটা পুরুষতান্ত্রিক ইগোতে ব্যাপকভাবে আঘাত করার মতো বিষয়। সেক্ষেত্রে তর্ক থেকে সরে শুরু হবে ব্যক্তি আক্রমণ এবং এইজ শেমিং। শুরু হবে বড়দের, বিশেষ করে বাবা-বড় ভাই বা অফিসের বড় স্যারদের সাথে তর্ক করার বেয়াদবির বিচার।

একজন কমবয়স্কা নারীর মুখে উচিত কথা এ যেন দুর্বিষহ বিষয়। শুধু কথা নয়, কাজেও যদি সে সফলতা পায়, ধরে নেওয়া হবে বসের সাথে শুয়ে বা নারী হিসেবে বাড়তি সুবিধা পাওয়ার কারণেই সে সফল। কখনোই এটা স্বাভাবিক ব্যাপার হতে পারেনা একজন অল্প বয়সের মেয়ের নিজের যোগ্যতা বা দক্ষতা বা জ্ঞান বেশি বয়সের পুরুষকে অতিক্রম করতে পারে। আর কোনোভাবে অদক্ষতা প্রমাণ করা গেলে শোনা যাবে বা*পাক্না, ছ্যাক খেয়ে খেয়ে ম্যাচুরিটি আসছে এই ধরনের বিদ্বেষপূর্ণ কথা। দোষ একটাই, তা হলো আপনি কম বয়সের নারী হয়েও যোগ্য।

বহু প্রকাশনা আছে, তারা লেখা প্রশংসা করে, কিন্তু বই ছাপতে অনাগ্রহী, কেননা লেখিকার বয়স কম। এমন বহুবার দেখেছি এমন কথা যা তাদের কথার সাথে কাজের বৈপরীত্য প্রমাণ করে। আমি বলার পর লোকের হাসাহাসি বা পাত্তা না দেওয়া অথচ একই কথা একজন বেশি বয়সের পুরুষ বলার পর তাদের নড়েচড়ে বসা এবং সিরিয়াসলি নেওয়া।

অনেক হয়েছে, এবার এই বিষয়গুলো ভিন্নভাবে ভাবা উচিত। অভিজ্ঞতার দাম থাকবে যদি দৃষ্টিভঙ্গী সঠিক ও যৌক্তিক হয়। হাঁটুর বয়সী কোনো নারীর কথা যদি সঠিক হয়, তবে তা অকপটে মেনে নিতে হবে। প্রয়োজনে তার কাছে শিখতে হবে। কারো থেকে কেউ শিখলে ছোট হয়ে যায় না বরং নিজের জ্ঞান বিকশিত হয়। নারী তো শুরু থেকেই প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত, তাই নারীর সহজাত জ্ঞানও পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্রময়। তাই মানুষকে দেখবার মাপকাঠি হোক মেধা, যুক্তি। সৌন্দর্যের মাপকাঠি হোক সুস্থতা। কাজ পাওয়ার মাপকাঠি হোক যোগ্যতা। জ্ঞানের মাপকাঠি হোক পড়াশোনার পরিধি, যা কম বয়সী মেয়েরাও অর্জন করতে পারে। এই কথাগুলো মাথায় রাখতে পারলে তবেই পৃথিবী হবে সবচেয়ে সুন্দর।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]