নামে মডেল মসজিদ, কাজেও তাই হবে তো?
তানিয়া কামরুন নাহার।। মসজিদ যে শুধু নামাজ পড়ার ও ধর্মীয় আলোচনার স্থান, তা নয়। ইসলামের একদম শুরুর দিকে এ মসজিদ থেকে মুসলিমদের নানা রকম দিক নির্দেশনা দেয়া, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। এখানে বিভিন্ন বিরোধ বা সমস্যা মিমাংসাও করা হতো। জ্ঞানের চর্চাও হতো আলোচনার মাধ্যমে। ছোটখাটো পাঠশালার ভূমিকাও এই মসজিদই পালন করতো৷ মসজিদ, এটি নিজেই যেখানে একটা মডেল বা আদর্শ স্থান, সেই মডেলের আবার নতুন করে মডেল বানানোর প্রয়োজন পড়লো বাংলাদেশে! তাও আবার একটি দুইটি না! ৫৬০টি মডেল মসজিদ বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৫০টি মডেল মসজিদের উদ্বোধন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
দুর্মুখেরা এক কালে গুজব ছড়াতো, আওয়ামী লীগ সরকার হলে মসজিদ সব মন্দির হয়ে যাবে, উলুধ্বনি বাজবে মসজিদে। “নাস্তিক সরকার” এমন অপবাদের ট্যাগও রয়েছে এ সরকারের। এসব অপবাদ খণ্ডাতেই কি আজ এত মডেল মসজিদের প্রয়োজন পড়লো?
মডেল মসজিদ হোক। এতে আপত্তি নেই। তবে মসজিদগুলো বাহ্যিক স্থাপত্য শিল্পে যেমন নান্দনিক এর অন্তর্গত কাজও যেন তেমনিই সুন্দর হয়, এটাই প্রত্যাশা। কেউ যদি ফিরিয়ে দিতে পারতো সেই সব রাত্রির এশার আযান, যাকে কবি নজরুল বলেছিলেন “প্রিয়াহারা কান্নার আওয়াজ”। সুবহে সাদিকে দূর থেকে ভেসে আসা ফজরের মিষ্টি আযান কেউ ফিরিয়ে দিক। অতিরিক্ত মাইকিং এর ফলে আযানের সুমধুর সুর আজ বিকট শব্দে বাজে। একই এলাকায় কাছাকাছি দূরত্বে অনেকগুলো মসজিদ হবার কারণে এখন আযানে-আযানেই যেন সংঘর্ষ হয়! মনোযোগ দিয়ে নির্দিষ্ট একটি আযান শোনা যায় না আর। নষ্ট হচ্ছে আযানের সৌন্দর্য। যে আযান মনকে প্রশান্তি দেবার কথা, সে আযানই আজ বিরক্তিকর হয়ে উঠছে দিন দিন। মডেল মসজিদগুলো নিশ্চয়ই এদিকে খেয়াল রাখবে। ফিরে আসুক আযানের সুমধুর সুর। ৫০ ডেসিবলের নিচে আযান দেয়া হোক, যেন কোন শব্দ দূষণ না হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদের পাশাপাশি মাদক, নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে এ মসজিদগুলো সচেতনতা সৃষ্টি করবে। এটা ঠিক, মসজিদের মাধ্যমে জনসচেতনতার কাজগুলো অনেক বেশি কার্যকর করা সম্ভব। শিক্ষা, প্রজনন স্বাস্থ্য, মৌলিক অধিকার, পারিবারিক বন্ধন, প্যারেন্টিং, দুর্নীতি, পরিবেশ দূষণ, ডাস্টবিন ব্যবহার, ইত্যাদি নানান পারিবারিক-সামাজিক বিষয়ে মসজিদের মাধ্যমেই জনসচেতনতার কাজগুলোও করা হোক। মসজিদগুলো এভাবেই সর্বস্তরের মানুষের কাছে মডেল হয়ে উঠবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নারীরা কি এসব মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়তে পারবে? যদি না পারে, তবে এগুলো কেমন মডেল মসজিদ, একটা প্রশ্ন থেকে যাবে। যে মডেল মসজিদে এত জ্ঞানের চর্চা হবে, এত জনসচেতনতা কাজ হবে, সে স্থান থেকে নারী কেন বাদ যাবে? অনেকে হয়ত হাদিস থেকে রেফারেন্স দিয়ে বলবেন, নারীদের মসজিদে নামাজ পড়তে উৎসাহ দেয়া হয় নি। কিন্তু ভেবে দেখুন, ওটা কত বছর আগের কথা?
১৪০০ বছর আগের আরব মুসলিম নারীদের জন্য নিরাপদ ছিল না। অনেক সময় সহিংসতার শিকার হতো। কিন্তু বর্তমানে নারীরা স্কুল কলেজ মাদ্রাসা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, অফিসে কাজ করছে। এখনো নারীরা ঈভ টিজিংএর শিকার হয় বটে, কিন্তু এর বিরুদ্ধে লড়তেও জানে। মানুষও আগের চেয়ে সচেতন। সুতরাং মসজিদেও নারীরা আগের চেয়ে আরো বেশি নামাজ পড়তে আগ্রহী হবে। নারীরা যদি মসজিদে এসে নামাজই না পড়তে পারে, তবে এ কেমন নিরাপদ দেশ?
মসজিদগুলোকে নারীবান্ধব করে তুলতে হবে। পাঁচ ওয়াক্ত জামাতে নামাজ পড়তে গিয়ে একটি এলাকার নারীরা দিনে পাঁচ বার সমবেত হবে। পরস্পরের সাথে সুখ দুঃখের অনুভূতি আদান প্রদান করবে। এমন কি মসজিদে পুরুষতান্ত্রিক কোন ভুল বক্তব্য বা নারীবিদ্বেষী কথা বললে নারীরা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরবে। মতামত শেয়ার করতে পারবে। এগুলো নারীর ক্ষমতায়নেরই অংশ। এভাবেই সমাজে একটি ভারসাম্য আসবে, আশা রাখি। তাহলেই মসজিদগুলো প্রকৃত মডেল হয়ে উঠবে।
একথাও মনে রাখতে হবে, একদিকে একের পর এক মসজিদ নির্মাণ, আর অন্যদিকে মন্দির, প্যাগোডাতে হামলা! অথচ দেশটা সবার। মডেল মসজিদ হোক, ৫৬০টির জায়গায় না হয় আরো এক হাজার হোক। কিন্তু সেই মসজিদকে ঘিরে লাইব্রেরি গড়ে উঠুক। সে লাইব্রেরিতে ধর্মীয় বইয়ের পাশাপাশি থাকুক কোয়ান্টাম ফিজিক্স, দর্শন, মানব সভ্যতার ইতিহাস, গল্প উপন্যাস কবিতার বই। থাকুক মহাভারত, বাইবেল। মহানবী (স) এর পাশেই থাকুক সক্রেটিস, নিউটন, বঙ্গবন্ধু, গৌতম বুদ্ধ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সব ধরনের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। কোরান শরিফের সর্বপ্রথম নাজিল হওয়া আয়াত ছিলো, ‘‘পড়ো।’’ সুতরাং পড়তে আমাদের এত ভয় কীসের? সব ধরনের সংকীর্ণতা, কূপমণ্ডুকতা, সাম্প্রদায়িকতা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, ফিতনা ফ্যাসাদ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বই পড়ার কোন বিকল্প নেই।
আমাদের শুধু মসজিদই দরকার তা তো নয়। আমাদের মৌলিক অধিকার চিকিৎসা, এজন্য দরকার পর্যাপ্ত হাসপাতাল, হাসপাতালের বেড, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। করোনাকালে হাসপাতালের একটি বেড, একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার কতটা জরুরি হয়ে উঠেছিলো, আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। ভারতে ভয়ংকরভাবে করোনা সংক্রমিত হতে শুরু করলো যখন, সেখানকার মসজিদগুলো রোগীদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করতে দেয়া হয়েছে। আমাদের আরো চাই খেলার মাঠ। চাই সুন্দর বাগান, পার্ক।
সব ধরনের, সব শ্রেণি, পেশা, ধর্ম, বর্ণের মানুষের জন্য খোলা থাকুক মসজিদের দরজা। তাহলেই মসজিদগুলো নামে মডেল, কাজেও মডেল হয়ে উঠবে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]