September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্স: পুরুষের মনে ঘাপটি মেরে থাকা রোগ

সামিয়াতুল খান।। সেক্সুয়াল সাইকোলজি নিয়ে একটু আধটু জ্ঞান থাকলে সাইকোঅ্যানালাইসিসের জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের নাম আপনার জানা থাকার কথা। আনকনশাস মাইন্ড আর সেক্সুয়ালিটি নিয়ে তাঁর নিউরো-থিওরি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পেয়েছে, পেয়েছে গ্রহণযোগ্যতাও!

বিশের দশক তখন কেবল শুরুর দিকে। সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাঁর এক পেশেন্টের মধ্যে এক ধরণের সাইকোলজিক্যাল ডিকোটমি দেখতে পেলেন। কী ধরণের সাইকোলজিক্যাল ডিকোটমি এটা বোঝার আগে ডিকোটমি কী সেটা একটু বুঝে ফেলা জরুরি। ডিকোটমি হল এক ধরণের দ্বিবিভাজন যেটা কিনা একই স্বত্ত্বার মধ্যে বিরাজ করে। বোঝাই যাচ্ছে সাইকোলজিক্যাল ডিকোটমি বলতে বোঝাতে চাচ্ছি এমন ধরণের মানসিক দ্বিবিভাজন যেটা কিনা একই সত্তা বয়ে নিয়ে চলে। সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাঁর পেশেন্টের মধ্যে যে ডিকোটমি পেয়েছিলেন তাকে বলেছিলেন ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্স!

এই কমপ্লেক্সে ভোগা পুরুষ প্রতিটি নারীকে শুধুমাত্র দুটি রূপেই চিন্তা করে। হয় সে নারীকে দেবী (সিগমুন্ড ফ্রয়েডের থিওরি অনুসারে saint) রূপে কল্পনা করে, নাহয় সে নারীকে বেশ্যা (ফ্রয়েড অনুসারে ছিল prostitute) রূপে চিন্তা করে। এর মাঝামাঝি কিছু কল্পনা করা তার পক্ষে সম্ভব হয়না। মজার ব্যাপার হল, ম্যাডোনা হোর কমপ্লেক্সে ভোগা পুরুষ ‘ভালবাসা’র ক্ষেত্রে সবসময় প্রথম ধরণের নারীকে চাইলেও Desire এর সময় সে চায় সেই নারীকেই যাকে সে মনে মনে প্রস্টিটিউট রূপেই ভাবে। কিন্তু এই ম্যাডোনা হোর কমপ্লেক্সে ভোগা পুরুষ কখনও যে নারীকে ‘লাভিং’ এর ক্ষেত্রে কল্পনা করে সেই একই নারীকে কখনও সেক্সুয়াল ডিজায়ারে কল্পনা করেনা।

সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, “Where such men love, they have no desire and where they desire, they cannot love”

ফিমেল সাইকোলজি অনুসারে ওমেন্স সেক্সুয়ালিটি স্লাইডিং স্কেলের মত সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তন পাবলিকলি হতে পারে, আবার পারসোনালিও হতে পারে। সেক্ষেত্রে একজন নারী ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্সে ভোগা একজন পুরুষের কাছে কীরূপে আবির্ভূত হবে তাতে আক্ষরিক অর্থেই সেই নারীর কোনো অবদান নেই। সে শুধু কেবল নিজের স্বত্ত্বা নিয়েই চলতে পারে।

যা হোক, থেরাপিস্ট আর সাইকোলজিস্টরা এখন অনেক পুরুষের মধ্যে এই সাইকোলজিক্যাল কমপ্লেক্সের দেখা পাচ্ছেন, এবং এই ম্যাডোনা হোর কমপ্লেক্স পাবলিক রিলেশনে বিরাট ভূমিকা রাখে। সেটা অবশ্য অস্বাভাবিক কিছুনা। প্রাত্যহিক জীবনে কোন পুরুষ যদি নারীকে হয় দেবী (‘দেবী’/ ‘সেইন্ট’ বলতে আসলে ফ্রয়েডের মতে পুরুষ ঐ নারীকে ‘পবিত্র’ কন্সিডার করে) নাহয় বেশ্যা বলে ডিফাইন করে আর এই দুই মেরু ছাড়া কিছু ভাবা তার পক্ষে সম্ভব না হয় তাহলে সেটা একটা বিরাট প্রভাব তো রাখবেই। অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতীয় উপমহাদেশের পুরুষের মধ্যে এই ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্সের প্রভাব একটু বেশিই আর এই কমপ্লেক্সে ভোগা পুরুষের সংখ্যাও যে বেশি সেটা খুব স্বাভাবিকভাবেই অনুমেয়।

যা হোক, ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্সের সবচাইতে বড় দুটো প্রভাব দেখা যায় বিয়ের ক্ষেত্রে আর মাতৃত্বের ক্ষেত্রে। ব্যাখ্যা করা যাক।

বিয়ে

বিয়ের ক্ষেত্রে ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্সের প্রভাব বাংলাদেশে অহরহ দেখা যাচ্ছে। ধরা যাক, এই কমপ্লেক্সে ভোগা কোনো পুরুষ কোনো নারীর সাথে প্রেম করল। এরপর সে বিয়ের আগেই সেই নারীর সাথে সেক্স করলে কমপ্লেক্সে ভোগা পুরুষ তখন বিয়ের ক্ষেত্রে সেই নারীকে আর গ্রহণ করতে পারে না। না পারার কারণ হল, বিয়ের পর ‘বউ’ হিসেবে সে সবসময় পবিত্র ‘দেবী’ চায়। কিন্তু সেই নারী যেহেতু বিয়ের আগেই সেই পুরুষের সাথে সেক্স করে ফেলছে তাই সেই পুরুষ সেই নারীকে তখন অপবিত্র ‘বেশ্যা’ কল্পনা করে। আগেই বলেছি, ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্সে ভোগা পুরুষের পক্ষে একটা নারীকে ‘সেইন্ট’ (যেটা আরকি পবিত্র নারী বোঝায়) অথবা ‘প্রস্টিটিউট’ (যেটা আরকি অপবিত্র নারী বোঝায়) ছাড়া আর কিছু কল্পনা করা সম্ভব নয়। সেজন্য সে তাই তার গার্লফ্রেন্ডকে গণ্য করে ‘প্রস্টিটিউট’ হিসেবে আর বিয়ের ক্ষেত্রে সে খোঁজে এমন কাউকে যাকে সে ‘সেইন্ট’ হিসেবে কল্পনা করবে।

এখন অনেকেই ভাবতে পারেন বিয়ের আগে সেক্স না করলেই এই সমস্যার অনায়াসে সমাধান করা যায়। আসলে সেটাও সত্যি নয়। সমস্যা সেখানেও থেকে যায়। ধরা যাক, ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্সে ভোগা কোন পুরুষ তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে বিয়ের আগে একদমই সেক্স করেনি। আর তার গার্লফ্রেন্ড তার কাছে এখনও ‘দেবী’ রূপেই আছে। তাহলে যে সমস্যাটার তৈরি হয় সেটা একেবারে অন্যরকম একটি সমস্যা। কমপ্লেক্সে ভোগা পুরুষ ‘লাভিং’ হিসেবে একটা নারীকে বিয়ে করার পর যখন দেখে সেই ‘নারী’র মধ্যে ডিজায়ার আছে তখন সেই পুরুষ আর সেই নারীকে ‘দেবী’ রূপে কল্পনা করতে পারেনা। শুধুমাত্র সেই নারীর বিছানার সেক্সুয়াল ডিজায়ারের জন্যে সেই পুরুষের কাছে সেই নারী তৎক্ষণাৎ হয়ে যায় অপবিত্র ‘বেশ্যা’। একদম শুরুতেই বলে নিয়েছি, এই কমপ্লেক্সে ভোগা পুরুষ ‘লাভিং’ এর জন্যে যে নারীকে পছন্দ করে সেই নারীকে ‘ডিজায়ার’ এর সময় চায়না।

ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্সের এই দারুণ ব্যাপারটা জনপ্রিয় সিরিজ ‘সেক্স এন্ড দ্যা সিটি’র একটি এপিসোডে উঠে এসেছে। চাইলে দেখে নিতে পারেন।

মাতৃত্ব

মাতৃত্বের ক্ষেত্রে ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্স প্রভাব রাখে বিয়ের ক্ষেত্রে যেভাবে ঘটেছিল তার একেবারে বিপরীতভাবে। সেক্সুয়াল ডিজায়ার দেখানোর মাধ্যমে সেই নারী যখন পুরুষের কাছে ‘অপবিত্র’ বলে কল্পিত হয়, আর এরপরই যখন সেই নারী প্রেগনেন্ট হয় সেটা ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্সে ভোগা পুরুষকে সাইকোলজিক্যালি আঘাত করে। সেই পুরুষ তখন সেই নারীকে আবারও ‘পবিত্র’ কল্পনা করতে চেষ্টা করে। যেহেতু প্রেগনেন্সি ব্যাপারটার সাথে মাতৃত্ব ব্যাপারটা জড়িত আর সেই মাতৃত্বের জন্যেই পুরুষ তখন সেই নারীকে ‘একজন মা’ হিসেবে কল্পনা করে তাই আর তাকে ‘অপবিত্র’ কল্পনা করতে পারেনা। যেহেতু কমপ্লেক্সে ভোগা পুরুষের কাছে একজন নারীকে ডিফাইন করার অপশন মাত্র দুটো তাই সেই নারীকে সে কল্পনা করে ‘পবিত্র’ বলেই। এই কনভার্সন সময়ে পুরুষের সাইকোলজিক্যালি যে পরিবর্তন হয় সেটা সম্পর্কে অনেকটাই প্রভাব রাখে।

আপনি হয়তো ভাবতে পারেন পুরুষ যেহেতু সেই নারীকে এবার ‘পবিত্র’ বলে ভেবেই ফেলেছে তাহলে হয়তো সমস্যার সমধানও হয়ে গেছে। নাহ, তা হয়নি। কেন হয়নি সেটা বলার আগে আরেকটু কথা বলে নেওয়া ভাল। বার্থ গিভিং প্রসেসটা যদি নরমালি হয় তাহলে শিশুটি পৃথিবীতে আসে নারীর যোনিপথের মধ্যে দিয়ে। ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্সে ভোগা পুরুষের কাছে নারীর যোনিপথ শুধুমাত্রই সেক্সের বিষয়বস্তু, অনেকটাই সেক্সডলের মত। তাই পুরুষ যখন জানতে পারে (ক্ষেত্রবিশেষে দেখতেও পারে) তার কল্পনা করা সেক্সডলের মধ্যে দিয়ে একটা নতুন প্রাণ পৃথিবীতে আসছে তখন সেই যোনিপথও তার কাছে আর সেক্সের বিষয় থাকেনা। একেবারেই না। আর এখানেই শুরু হয় সমস্যা।

একটা সময় সেই নারীর প্রেগনেন্সি পরবর্তী সময় পার হয়, সেই নারী আবার পুরুষের সাথে বিছানায় ফিরে আসে কিন্তু সেই পুরুষ আর তখন সেই নারীকে গ্রহণ করতে পারে না। না পারার কারণটা আশা করি বুঝতে পারছেন। সেই পুরুষ ইতোমধ্যে সেই নারীকে ‘পবিত্র’ ডিফাইন করে ফেলেছে, সেই নারীর যোনি আর তার কাছে সেক্সের বিষয়ই নেই। আর যেহেতু ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্সে ভোগা পুরুষের কাছে ‘লাভিং’ আর ‘ডিজায়ার’ এর নারী একই নারী হতে পারেনা তাই তখন দুজনের মধ্যে একটা প্রবল সেক্সুয়াল ডিফারেন্স তৈরি হয়। আর এই প্রেগনেন্সি পরবর্তী সেক্সুয়াল ডিফারেন্সের অসংখ্য উদাহরণ আমাদের দেশেই দেখা যায় যার কারণ এই কমপ্লেক্সিটি।

ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্সে ভোগা পুরুষের কাছে ‘ভালবাসা’র নারী হয়ে যায় সেইন্ট/দেবী, আর সেক্সুয়াল ডিজায়ারের নারী হয়ে যায় প্রস্টিটিউট। আর নারীকে এই দুইয়ের বাইরে আর কিছু ভাবা কমপ্লেক্সে ভোগা পুরুষের পক্ষে সম্ভব হয়না। আমাদের বাংলাদেশের বেশিরভাগ পুরুষের মধ্যে এই ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্স প্রবলভাবে বিদ্যমান আছে। আর সে কারণেই সোশ্যাল মিডিয়াতে কোন নারী যখন প্রচলিত ভাষায় ‘নিষিদ্ধ’ কোন পোস্ট করে (যেমন পিরিয়ড, কনসেন্ট সেক্স, সেক্স বিফোর ম্যারেজ বা কোন অ্যাডাল্ট জোক) সেই নারীকে পুরুষেরা সোজাসুজিভাবে বেশ্যাই ভেবে নেয় আর তখনই হ্যারাজমেন্ট থেকে বুলিং সবকিছু শুরু হয়। বাংলা ভাষাতেই অবশ্য ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্সকে অনেক আগে থেকেই ‘মহৎ’ বানানো হয়েছে। ‘পবিত্র প্রেম’ টার্মের মধ্যে প্রেমের ক্ষেত্রে বিয়ের আগে সেক্সকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মূলত স্বর্গীয় প্রেম, পবিত্র প্রেম, অস্পর্শী প্রেম নামক যে কিম্ভুতকিমাকার টার্মের জন্ম হয়েছে বাংলা ভাষায় সেটা এই ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্সেরই ফল।

তাই, ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্স জানা আর জানানোটা খুবই জরুরি। কোন নারী যদি তার পার্টনারের মধ্যে এই বিবাহপরবর্তী সেক্সে বা প্রেগনেন্সি পরবর্তী সেক্সে সমস্যা দেখেন, কিংবা বিয়ের আগে সেক্স এর পর বিয়ে হলে বিছানায় সেক্সে সমস্যা দেখেন, তাহলে অবশ্যই সেই পুরুষকে সেক্সোলজিস্ট বা সাইকোলজিক্যাল থেরাপিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত।

তথ্যসূত্র:

https://thelatch.com.au/what-is-the-madonna-whore-complex/

http://www.34st.com/article/2021/01/freud-madonna-whore-complex-black-women-trans-women-sex-sexuality

https://swarajyamag.com/magazine/the-saint-and-the-slut-why-men-suffer-from-the-madonna-complex

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]