November 22, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

বাবা, তোমার মেয়ে হয়ে বারবার জন্ম নিতে চাই

তানিয়া ইসলাম।।

 

প্রিয় বাবা,

আমাদের গ্রামের বাড়িতে বিদ্যুতের সাপ্লাই ছিল না বলে বাসায় সাদা-কালো বিটিভি চলতো ভলভো ব্যাটারিতে। ব্যাটারি সপ্তাহে দু-বার চার্জ করা লাগতো আমাদের সবগুলো ভাইবোনের অনুষ্ঠান দেখার খুব অভ্যেস ছিল বলে, বিশেষ করে সংগীতানুষ্ঠান, বাংলা নাটক আর সাপ্তাহিক সিনেমা। তবে তুমি রোজ নিয়ম করে রাত আটটার বাংলা খবর দেখতে, যেন মনে হতো পুরো বিশ্বের খবর তোমার হাতের মুঠোয় আনা জরুরি। এই সংবাদ দেখার জন্য ব্যাটারির চার্জ জমা করে রাখার বায়নায় আমাদের রোজই মনে করিয়ে দিতে ‘‘এটা কারেন্ট সাপ্লাই না, এটা ব্যাটারিতে চলে”- একটু ধমকের সাথে।

বাবা এই সেদিনের কথা আজ ও খুব করে কানে লাগছে! নিউরনের কোথায় যেন স্মৃতির আলপিনে বাঁধা বিখ্যাত ডিটেক্টিভ শার্লক হোমসের মতো করে তোমার কাছে জানতে পারা সব গোপন তথ্য। এখন একবিংশ শতাব্দী বাসায় ইলেক্ট্রিসিটি, রঙ্গীন টেলিভিশন, ডিশলাইন নিশ্চয়ই অনেক চ্যানেলের খবর দেখতে অসুবিধা হয় না! পাড়ার দোকান থেকে পত্রিকার হেডলাইন মুখস্ত করেও আসতে হয় না নিশ্চয়ই! সবকিছুই তোমার হাতের নাগালে নিশ্চয়ই। বেশ কিছুদিন আগে খবরে দেখেছো এক ধর্ষক বাবার ছবি যে পেশাগতভাবে ঝকঝকা, পরিচিত। ‘ধর্ষক বাবা’- এ শব্দটি আমি ইনভার্টেড কমায় রাখতে চাই যেন এর বিস্তার আর না ছড়ায়! জানো বাবা, এইটুকু লিখতে হাত ভীষণ কাঁপছে, মানসিক নিপীড়ন অনুভব করছি!

সেইদিনের ধর্ষণ ভিডিও অর্ধেক দেখার পর বাদ দিয়েছি ঠিকই, কিন্তু নিদ্রাহীনতায় ভুগছি। এই অপরাধ প্রবণতা কী করে হলো? এতো অসহিষ্ণু, অসামাজিক, অনৈতিক মানসিকতা কী করে হলো? তবে! তবে কি ব্রেইনের ফ্রন্টাল লেভেলের নিউরোট্রান্সমিটারগুলো আলগা হয়েছিল! না হয় ধর্ষণের মতো ফৌজদারি অপরাধ কী করে করলো?

আমি জানিনা বাবা! আমি জানিনা! তুমিও তো পুরুষ। তুমি তো ধর্ষক নও, তুমি সোঁদামাটির বুকে এঁটে থাকা শক্তটিলা, হাতের কাছে এক হীরকখণ্ড। এই পৃথিবীর আনন্দযজ্ঞে আমাকে নিমন্ত্রণ করা ঈশ্বররূপী বাবা।

আচ্ছা বাাবা আমার এই চিঠি যদি সেই ধর্ষণের শিকার সেই কন্যাসন্তানটি পায়, সে কি খুব অভিমান করবে? নিজের জীবনকে কি নিজেই আরো বিষিয়ে তুলবে? নাকি সব বাবা এবং ভাইকে পুরুষ ভাবতে শুরু করবে? নাকি নষ্টবীজ আর নষ্ট সারে গড়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সাথে আপোষহীন লড়াই করবে?

আমি জানিনা বাবা! আমি জানি, প্রথম গোলাপী ফ্রক আর প্লাস্টিকের পুতুলের বায়না তোমার কাছে করেছি মাটিতে গড়াগড়ি করে। তুমি নির্মোহ চোখে তাকিয়ে, চকচকা হাসি দিয়ে বুড়াকর্তার মেলা থেকে প্লাস্টিকের পুতুল আর আবু চাচ্চুর দোকান হতে গোলাপী ফ্রক কিনে দিয়েছো। কায়ক্লেশে ঘাম জড়িয়ে, লাঙ্গল কাঁধে চাষাবাদ করেছো কোনো উঁহু-আহা ছাড়াই। ম্যাস আবাসনে ১৫-২০ দিন পর পরই কোন একটি সব্জির হাট মিস করে তোমার কন্যাকে দেখতে যেতে আমি তখন অনার্স ফাস্ট ইয়ারে পড়ি, অথচ তোমাকে দেখার জন্য আমার ছিল দ্বিধাহীন বায়না। আর তুমিও হন্যে হয়ে ছুটতে সে বায়না রাখতে। ঢাকা থেকে যাওয়ার পথেই নোয়াখালীতে ড্রপ করেছিলে আমাকে স্টেডিয়ামের মেলায় নিয়ে যাবে বলে, সেদিন তোমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিলাম আর পেট ধরতে ধরতে বলেছিলাম আমার প্রথম অবুঝ প্রেমের কথা।

আমার সেই প্রেমিক এখন প্রাক্তন, চলে গেছে জীবন থেকে। কিন্তু তুমি তো বাবা ঠিক বাবা রয়ে গেলে। তুমি সেই প্রেম যার শেষ নেই। এরপর আমি রান্নাঘরে যখন সব কিছু এলোমেলো রাঁধতাম, যা খেতে নিজেরই রুচি হতো না, বাসায় পোষা টমিও চেখে দেখতো না আমার বিস্বাদ রান্না আর তুমি বৃদ্ধাঙ্গুল-তর্জনী আঙুল চেটেপুটে বলতে ‘‘ইশ কি অসাধারণ রান্না, মায়ের হাতের গন্ধ পাচ্ছি!” আমি খুশিতে, আনন্দজলে ভাসতে ভাসতে শিখতে পেরেছি রান্নার মতো শিল্প। বাবা তুমি আমার সেই শ্রেষ্ঠ উৎসাহ দেয়া বাবা।

জানো বাবা, মাঝে মাঝে তোমার উপর আমার ভীষণ অভিমান হতো কারণ আমি সিএ পড়তে চাইতাম, আর্থিক অসচ্ছলতায় যা হয়ে ওঠেনি। আর ছোটবেলায় চাইতাম সায়েন্স গ্রুপ থেকে পড়াশোনা করে ডাক্তার হবো, স্বল্প ফি নিয়ে গ্রামের মানুষদের পাশে থাকবো, চিকিৎসার মতো পরম পেশায় ব্রত হবো। তা আর হয়ে ওঠেনি একই সমস্যার কারণে। স্বপ্নভাঙার যে কি যন্ত্রনা বাবা! তো আজ তোমাকে জানাই, এ যন্ত্রনা সামনে আগানোর ছোট এক মন্ত্র আর সেটি হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ কবিতা। এ কবিতার উপলব্ধি ছিল ভবিষ্যৎ বিচিত্র ও বিপুল সম্ভাবনাময়। অতঃপর আমার দৌড়ানোর শুরু।

মেঝ চাচ্চুর ছেলেমেয়ে ডাক্তার, সেঝ চাচ্চুর ছেলেমেয়েরা প্রাইভেট গাড়িতে চলাফেরা করে অথচ আমি রোজ টিউশনে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠতাম। আজও সংগ্রাম করে যাচ্ছি, যুদ্ধ শেষ হলেও লড়াইটা শেষ হয়নি! কখনো স্বাধীনতার মতো সৌন্দর্য উপভোগ করার লড়াই, কখনো নিজের জীবন-জীবিকার মাঝে অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকার লড়াই, প্রচন্ড কনজারভেটিভ সমাজ-পরিবারে ত্রিশোর্ধ্ব একা নারী হয়ে টিকে থাকার লড়াই। আর এসব লড়াই করতে যে কি বিড়ম্বনা পোহাতে হয় তা তুমি জানবেনা! তবে এসব জায়গায় এগিয়ে দিতে না পারলেও বাঁধা তুমি দাওনি। আমার এসএসসি রেজাল্টের পর তোমার উল্লাস আজও মনে পড়ে।পদ্মা সুইটসের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মিষ্টি নিয়ে বাসায় ফেরার পর আমি চোখ কপালে তুলতেই তোমার সহজ উত্তর- ‘‘আমার মেয়ের রেজাল্ট হয়েছে।”

বাবা আজ এ জন্মে এবং পরজন্মে তোমার মেয়ে হয়ে বারবার জন্ম নিতে চাই। আররো আরো কন্যা সন্তানের জন্ম হোক তোমা রমতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বাবার ঘরে। তারা জানুক সন্তানের জন্য বাবার প্রেম, দ্বিধাহীন ভালোবাসা, উৎসাহ, তালপাতার বাঁশি আর প্লাস্টিকের পুতুর কেনা মেলার বিকেলের আনন্দ। পৃথিবীর সব কন্যা সন্তান জানুক বাবা হওয়ার জন্য ঝকঝকা পেশা দরকার হয় না, তোমার মতো নীরব সাপোর্টার, চকচকে হাসি, কায়ক্লেশে উচ্চবাচ্যহীন বাবা হওয়া যায়।

বাবা আজ তোমার কন্যার অভিমান ভেঙেছে, তোমার কন্যা জানলো দীনতা-হীনতা থাকতে পারে আমার বাবার, কিন্তু আমার বাবা একজন মানুষ, ধর্ষকামী পুরুষ নন। তুমি কেবলই আমার বাবা। জানো তো বাবা, প্রতি বছরের জুনের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস পালন করা হয়, তোমাকে বাবা দিবসের শুভেচ্ছা। আজকের দিনে তোমাকে জানাতে চাই, ভালোবাসি বাবা, এ বেলায়ও ,ও বেলায়ও, সকল আনন্দ হাসি-খেলায়, দুঃখ অবলীলায়। এমনি করে স্বচ্ছতায় আর সুস্থতায় বাঁচো।

ইতি

তোমার অভিমানী কন্যা