December 23, 2024
নারী'র খবরবিদেশফিচার ২

তালেবানদের ঠেকাতে আমাকে অস্ত্র তুলে নিতেই হয়- আফগান নারী গভর্নর

ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর ডেস্ক।। উত্তর আফগানিস্তানের বালখ প্রদেশের চাক্রিন্ত জেলার গভর্নর সালিমা মাজারি। ৪০ বছর বয়েসী সালিমা দেশটিতে মাত্র তিনজন নারী গভর্নরের একজন। উগ্রবাদী তালেবানকে ঠেকাতে দাফতরিক কাজের পাশাপাশি অস্ত্র হাতে সামরিক দলকেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি।

তালেবানের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে সালিমা মাজারি নতুন নয়। তবে চাক্রিন্ত জেলার গভর্নর হিসেবে গত কয়েক মাস ধরে নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ডারদের নিয়ে বৈঠক, আলোচনা, তাদের নির্দেশনা দেওয়া তার দৈনিক কাজের অংশ হয়ে উঠেছে। সামরিক নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি অস্ত্র হাতে স্বয়ং যুদ্ধেও লড়তে হয় সালিমাকে।

আফগানিস্তানের অন্য সব জেলার গভর্নররাও একই কাজ করছেন। তারাও দাফতরিক কাজের পাশাপাশি সামরিক দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে নারীদের প্রতি কট্টরতম মনোভাবের একটি দেশের গভর্নর হিসেবে এসব কাজ করছেন বলে সালিমা মাজারি দেশ ও দেশের বাইরে আলোচনায় উঠে এসেছেন। তাছাড়া সালিমার নেতৃত্বে থাকা বাহিনী কোনো লড়াইয়ে তালেবানের কাছে পরাজিত হয়নি—এটিও তাকে নিয়ে ব্যপক চর্চার অন্যতম একটি কারণ।

তালেবানের সাম্প্রতিক উত্থান ঠেকাতে দফতরের পাশাপাশি ময়দানে সামরিক নেতৃত্ব দেওয়ার কাজ করার ব্যাপারে সালিমা মাজারি বলেন, “মাঝে মাঝে আমাকে চাক্রিন্তের দফতরে থাকতে হয়, বাকি সময় আমাকে বন্দুক হাতে নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে ছুটতে হয়”।

একজন গভর্নর হিসেবে তার কাজ দৈনিক আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার তদারকি করা, দাফতরিক সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তা বাস্তবায়ন করা। তবে গত কয়েক মাস ধরে আফগানিস্তানে উগ্রবাদী গোষ্ঠী তালেবানের উত্থান পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে। তালেবান যেভাবে আফগানিস্তান দখলে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে, এর বিপরীতে সরকারকেও পূর্ণ শক্তি নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হচ্ছে।

ফলে গভর্নরদের সামরিক ব্যবস্থাপনায় যোগ দিতে হচ্ছে। সালিমা মাজারির জেলার কয়েক হাজার মানুষের নিরাপত্তা বিধান করতে হচ্ছে তাকেই। মানুষের জীবন ও দেশ রক্ষার প্রয়োজনে নিরাপত্তা বাহিনীকে মাঠে থেকে নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে তাকে।

সালিমা মাজারি সতর্কবার্তা উচ্চারণ করে বলেন, “চরমপন্থী মতাদর্শ এবং যে গোষ্ঠীগুলো আমাদের উপর জবরদস্তি চালায়, আমরা যদি এখনই তাদের বিরুদ্ধে লড়াই না করি, তাহলে আমরা তাদের পরাজিত করার সুযোগ হারাবো। তারা সফল হবে। তাদের মতাদর্শ সমাজের উপর চাপিয়ে দেবে”।

উল্লেখ্য যে, সালিমা মাজারির পরিবারের সোভিয়েত যুদ্ধের সময় ইরানে পালিয়ে গিয়েছিল। ১৯৮০ সালে সেদেশেই তার জন্ম। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক অর্জনের পর আন্তর্জাতিক অভিবাসন নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। প্রায় এক দশক আগে তিনি আফগানিস্তানে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, “শরণার্থী হওয়ার সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিক হলো—নিজ দেশ বলতে কী বুঝায় সেটা বুঝতে না পারা। শরণার্থী হলে মনে হয়, কোনো জায়গায়ই আপনার দেশ নয়”।

আফগানিস্তানে ফিরে তার জেলার মানুষের জীবনমানের উন্নতির জন্য নানা কাজ করেন তিনি। ২০১৮ সালে সালিমা মাজারি চাক্রিন্ত জেলার গভর্নর পদে আবেদন করেন। অন্যান্য বহু আবেদনের মাঝে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং জেলার মানুষের জন্য তার কাজ করার অভিজ্ঞতার কারণে এ পদে তিনিই নিয়োগ পান। সালিমা মাজারি বলেন, “যেদিন আমি চাক্রিন্তের গভর্নর হলাম, আমি সবার সমর্থন দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম”।

তিনি বলেন, “অনেক নারী আমাকে সমর্থন জানাতে তাদের বাড়িঘর থেকে কোনো হিজাব, বুরকা বা পুরুষ অভিভাবক ছাড়াই বের হয়েছিলেন। জেলা গভর্নরের ভূমিকায় কাজ করা এমনিতেই সহজ ছিল না। শীঘ্রই আমি বুঝতে পারলাম, আমাকে এখন যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে হবে”।

আফগানিস্তানের জেলা গভর্নর অফিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, একসময় চাক্রিন্ত জেলায় ২ লাখের বেশি মানুষের বসবাস ছিল। কিন্তু একাধিক যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট দারিদ্র্যতার কারণে এ জেলা ছেড়েছে বহু মানুষ। সালিমা মাজারি মনে করেন, তার জেলাকে আফগান সরকার দ্বিতীয় সারির জেলা হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। তিনি এ জেলার উন্নয়ন ঘটাতে বদ্ধপরিকর। আফগান আমলাতন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা দুর্নীতি তার কাজকে আরও কঠিন করে তুলেছে।

দুই বছর আগে সালিমা তার জেলায় একটি নিরাপত্তা কমিশন গঠন করেছিলেন। এ নিরাপত্তা কমিশনের কাজ হলো জেলা রক্ষায় স্থানীয় আফগান মিলিশিয়াদের নিয়োগ দেওয়া।

তিনি বলেন, “আমি চাক্রিন্তের সকল প্রান্তের মানুষকে আমার দফতরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম, এবং জেলার উন্নতি কীভাবে করা যায় সে সম্পর্কে তাদের মতামত চেয়েছিলাম। এর ফলে চাক্রিন্তের বাসিন্দারা আরও বেশি সম্পৃক্ত হয়েছে এবং তারা জেলা গঠনে সময় ও পরিশ্রম বিনিয়োগ করছে। সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রতি তাদের বিশ্বাসও তৈরি হয়েছে”।

সালিমা মাজারির নেতৃত্ব শৈলী তালেবানের নতুন হামলার আগ পর্যন্ত ভালোভাবেই জেলার উন্নতি বিধানে কাজে আসছিল। তবে তালেবানের সহিংসতা বৃদ্ধির পর লড়াইয়েও মনোযোগ দিতে হচ্ছে তাকে।  তিনি বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে আমরা তালেবানের হামলার মুখোমুখি হয়েছি এবং আমরা এখন পর্যন্ত তাদের চাক্রিন্তে প্রবেশ করতে দেইনি”।

যুদ্ধে লড়তে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র এবং অন্যান্য সুবিধার অভাবে রয়েছে, ফলে এ কাজ আরও কঠিন হয়ে উঠেছে সালিমার জন্য। তিনি বলেন, “যুদ্ধক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক সুবিধার অভাব রয়েছে আমাদের। নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার জন্য আমাদের কমপক্ষে ৭টি পুলিশ রেঞ্জার গাড়ির প্রয়োজন। হালকা ও ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত দুটি হামভি (হাই মোবিলিটি মাল্টিপারপাস হুইলড ভেহিকল) থাকা চাই। বাস্তবতা হলো আমাদের কাছে অনেক কম যুদ্ধাস্ত্র রয়েছে”।

সালিমা মাজারি তার সেনাদের শহরের উপকণ্ঠে মোতায়েন করেছেন। তার আশা, তালেবান জঙ্গিরা শহরের প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেদ করতে পারবে না।

সালিমা মাজারির নেতৃত্বে থাকা চাক্রিন্তে অবশ্য তালেবান কখনই সুবিধা করতে পারেনি। তিনি বলেন, “এর আগেও আমরা তালেবানের হামলা মোকাবিলা করেছি। বর্তমান আক্রমণের চেয়েও সেগুলো তীব্র ছিল। আমরা তাদের ঠেকিয়ে দিয়েছিলাম”।

তবে গভর্নর সালিমা পরিস্থিতির ব্যাপারে সতর্ক, এবং তার জেলার জনগণের ভবিষ্যত নিয়েও উদ্বিগ্ন। পরিস্থিতি যে কোনো সময় অবনতি হতে পারে এবং এতে তার জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। বিশেষ করে, গত শুক্রবার থেকে একের পর এক উত্তর আফগানিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী দখল করে নিচ্ছে তালেবান। বালখ প্রদেশেও বিভিন্ন জেলায় তালেবান তীব্র আক্রমণ চালিয়েছে।

গত বছর সালামি তার জেলায় একশর বেশি তালেবানকে সফলভাবে আলোচনার মাধ্যমে আত্মসমর্পণে রাজি করিয়েছিলেন। তবে সবসময় এমন আলোচনা সফল হয় না বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন, “একাধিকবার আমরা আমাদের জনগণের পক্ষ থেকে তালেবানদের সঙ্গে আলোচনার জন্য প্রতিনিধি পাঠিয়েছি। জনগণের জীবন, ফসল এবং সম্পত্তি রক্ষার জন্য আমরা তালেবানের সঙ্গে দশ বারের বেশি বৈঠক করেছি। আমাদের কৃষক ফসল ঘরে তোলার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু তালেবান প্রতিবার আমাদের জনগণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে আসছে“।

আফগানিস্তানে নারীদের উপর খড়গহস্ত তালেবান। এর মধ্যে একজন নারী তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ফলে গভর্নর সালিমা মাজারির জীবন সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর আগেও তালেবান মাটিতে মাইন পুতে রাখাসহ একাধিক প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে তার উপর। সবগুলো হামলায় তিনি প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন।

এ ব্যাপারে সালেমি বলেন, “আমি ভীত নই। আমি আফগানিস্তানে আইনের শাসনে বিশ্বাস করি”।

– দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে