ইভানাকে আত্মহননের পথে ঠেলেছে কারা?
ব্যারিস্টার মিতি সানজানা ।। গত ১৫ সেপ্টেম্বর বুধবার সন্ধ্যাবেলা ইভানা লায়লা চৌধুরীর আত্মহত্যার খবরটি পাই। এমন ভয়াবহ আর মর্মান্তিক খবরটি পাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষন বাকরুদ্ধ ছিলাম। শাহবাগের পাশে পরীবাগের দুটি নয়তলা ভবনের মাঝ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে আমাদের সকলের প্রিয় ইভানার মৃতদেহ। ইভানা ব্যারিস্টার হওয়ার জন্য এলএলবি করেছিল। শেষ পর্যন্ত আইন পেশায় থাকেনি। ইভানার সাথে সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে অনেকবার দেখা হয়েছে। ফেসবুকে দুয়েক সময় টেক্সট এর আদান প্রদান ছাড়া তেমন একটা যোগাযোগ ছিল না। তবে ফেসবুকে ফুটফুটে দুই সন্তানের সাথে ওর ভিডিও, ছবি আর ওদের নিয়ে নানাধরনের মিষ্টি খুনসুটির পোস্টগুলো আমি ভীষণভাবে উপভোগ করতাম। দুই ছেলের মধ্যে একজনের বয়স আট বছর আর একজন ছয় বছরের। ছোটটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন (অটিস্টিক) শিশু।
ফেসবুকে ওর ছবি বা কোন পোস্ট দেখে ওকে আমার কখনই অসুখি মনে হয়নি। তাই ইভানার মৃত্যুর পর আবারো নতুন করে উপলব্ধি হল ভারচুয়াল জগতে সবারই নিজের ইচ্ছে মতো নিজেকে অন্যের কাছে তুলে ধরার সুযোগ রয়েছে। ফলে আমরা কেবল ওর কল্পিত সুখ আর সাফল্যের মিথ্যের আবরণে মোড়া ছবিগুলোই দেখতে পেয়েছি। এই সুখের পেছনে কোনো কষ্ট বা হতাশার গল্প আমরা জানতে পারিনি। আমরা কেন, এমন কি তার পরিবারের মানুষ আপনজনেরা কেউ তার হতাশার কথা, কষ্টের কথা জানতে পারেনি!
অবশেষে তার করুণ মৃত্যুর পর তার স্বজনরা জানতে পারল যে আইনজীবী স্বামীর সঙ্গে দুই সন্তান নিয়ে অসুখি এক দাম্পত্যে ছিল ইভানা। পত্রিকা মারফত আর ওর কাছের কিছু বন্ধুদের থেকে জানতে পারি স্বামীর হাতে ওর নির্যাতিত হবার কথা। স্বামীর ও তার পরিবারের সদস্যদের দ্বারা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুটিকে নিয়ে একাই লড়তে হয়েছে তাকে। সে যুদ্ধে স্বামীকে পাশে পাননি তিনি। বরং প্রতি মুহূর্তে তিলে তিলে শেষ করে দেওয়া হয়েছে তাকে। মৃত্যুর দুদিন আগে ইভানার সংসারে অসুখের আঁচ পেয়েও তার পরিবার নীরব ছিল (সম্ভবত সামাজিক নিন্দার ভয়ে)। ইভানার ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব আর পত্রিকা মারফত জানতে পেরেছি তার পরিবার রক্ষণশীল এবং পুরনো ধ্যান-ধারণা পোষণ করেন। পরিবার থেকে তাকে শেখানো হয়েছে বিয়ে সবচেয়ে বড় জিনিস এবং যেকোনোভাবেই তা টিকিয়ে রাখতে হবে। আর তাই ইভানা ডিভোর্স নিয়ে প্রচন্ড আতঙ্কগ্রস্ত ছিল। বাবা-মায়ের সম্মানের কথা ভেবে বিরত ছিলেন তালাক থেকে। বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে যদিও তিনি যোগাযোগ করেছিলেন একজন আইনজীবীর সাথে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইভানা তার এই লড়াইটি জারি রাখতে পারেননি। শুধুমাত্র সমাজ কী বলবে এই ভয়ে ইভানার মত সম্ভবনাময় এবং মেধাবী একটি মেয়ে বিচ্ছেদের কথা ভেবে আতংকগ্রস্থ হয়েছেন। পারিবারিক সহিংসতা আর নির্যাতন সইতে না পেরে দুটি ফুটফুটে সন্তানের মা ইভানা লায়লা চৌধুরীকে চরম হতাশা, ক্ষোভ আর অপমানে বেছে নিতে হয়েছে আত্মহত্যার পথ।
একজন নারী, হোক তিনি পেশাদার ,অপেশাদার, শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত, ধনী কিংবা গরিব – প্রতিনিয়ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রক্তচক্ষুর শিকার হতে হয় তাকে। সব শ্রেণির নারীদের নির্যাতন করার বিষয়টিতে অন্তত আমরা সমতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। পান থেকে চুন খসলেই মহাবিপর্যয়। সমাজ, সংসার আর সন্তানের অনাগত ভবিষ্যতের কথা ভেবে শুধু নারীকে হতে হবে কষ্টসহিষ্ণু। এই শিক্ষাগুলো প্রতিনিয়ত পরিবার আর সমাজ আমাদের শেখায়। সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে হতে হয় পুরুষতন্ত্রের বিকৃত মনস্তাত্ত্বিকতার অনিবার্য শিকার। পুরুষতন্ত্রের এই নোংরা খেলায় শুধু পুরুষই নন, অংশ নেন নারীরাও। আর এই বেড়াজালে পদে পদে ঘটে নারীসত্তার করুন অপমৃত্যু।
একজন নারী হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে প্রতিনিয়ত অপরাধবোধে দগ্ধ হচ্ছি, অপমানে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছি। ধূসর বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে প্রতিটি ক্ষণ। একটু পর পর দুচোখ ভিজে আসছে। বারবার কেবল কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছি। নারীর জীবনে কি তার কোনো নিজস্ব পরিচয় নেই? সে কি তবে শ্যাওলার মতো চির ভাসমান কিংবা স্থায়ী যাযাবর? সেকি ফেরারি? জীবনে চলার পথে তার কি শুধু ঠিকানা আর আশ্রয় বদল হয়? কেবল বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি আবার স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে আশ্রয় খুজে বেড়াতে হয় তাকে? শুধুমাত্র জীবনের শেষ মুহূর্তে এসেই কি তবে তিনি নিজ সমাধিতে খুজে পান আপন ঠিকানা? নাকি মৃত্যুর পরেও তার শান্তি মেলে না?
ইভানার মৃত্যুর পর বেশ কিছু সহকর্মীদের মন্তব্য আমাকে চরমভাবে আহত করেছে। এমনকি তার মৃত্যুর পরেও তাকে অপদস্থ করতে তথাকথিত ‘আধুনিক’ শিক্ষিত মানুষেরাও পিছিয়ে থাকেননি। অনেকে ধিক্কার দিয়েছেন – ছিঃ একজন শিক্ষিত মেয়ে এত দুর্বল! কাপুরুষ! অথচ বেঁচে থাকতে এ সমাজ তার সমস্যার কোনো সমাধান দেয়নি। সাহায্যের জন্য ইভানা অনেকের কাছেই গিয়েছেন কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি তার পাশে। এমন চরম দুঃসময়ে নিজের প্রাণের স্বজনদের কাছেও পাননি কোনো সমাধান।
ইভানা ডিভোর্সড হিসেবে অসুস্থ মা বাবার কাছে ফিরে যেতে চাননি কারণ সমাজ তাকে শিখিয়েছে পালকিতে চড়ে স্বামীর বাড়িতে প্রবেশ আর কফিনে চড়ে বের হওয়াই নারীর জীবনের চূড়ান্ত পরিনতি। সমাজ আর পরিবারে এই শিক্ষাটি পেয়ে বড় হয়েছেন তিনি। আর তাই ডিভোর্সড নারী হিসেবে নয়, আমাদের প্রিয় ইভানা নয়তলা ছাদ এর উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে, লাশকাটা ঘর ঘুরে বাবা মার কাছে ফিরেছেন। যে সমাজ তার দুঃসময়ে এগিয়ে আসেনি, সেই সমাজই দৃষ্টির আড়ালে থেকে অদৃশ্য প্রেতাত্মার মতো তাঁকে ঠেলে দিয়েছে আত্মহননের পথে। এই দায় আমাদের সকলের।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]