December 23, 2024
সাহিত্যআরও ভাবনাফিচার ৩

নেটফ্লিক্স সিরিজ ‘মেইড’- আমাকে তুমি আর দমন করতে পারবে না

রুখসানা কাঁকন ।। হঠাৎ করে নেটফ্লিক্সে একটা সিরিজ দেখতে বসলাম, কিন্তু কল্পনাও করিনি এই সিরিজ আমাকে এতটা স্পর্শ করবে। সিরিজটির পরতে  পরতে নারীর দীর্ঘশ্বাস, আশা, হাতাশা আর বঞ্চনার  যে যুদ্ধ, তা আমাদের প্রতিদিনের বহু নারীর চেনা জীবন হলেও চোখের সামনে সম্পূর্ণ সিরিজটা আমার ভেতরটা নাড়িয়ে দিয়েছে। এই মুগ্ধতাই আজকে আমাকে রিভিউ লিখতে বসিয়েছে।  আমি  আরো মনে করি এই সংগ্রামী মায়ের গল্প কারো সুযোগ থাকলে দেখে ফেলা উচিত।

মেইড সিরিজটি লেখিকা স্টেফানি ল্যান্ডের স্মৃতিকথা ‘মেইড: হার্ড ওয়ার্ক, লো পে, অ্যান্ড আ মাদার’স উইল টু সারভাইভ” (Maid: Hard Work, Low Pay and a Mother’s Will to Survive) অবলম্বনে তৈরি।

গল্পটা এভাবে শুরু হয় একজন ২৩ বছর বয়সী নারী অ্যালেক্স, তার জীবনের ভালবাসার সাথে থাকার জন্য কলেজ ছেড়ে দেয়। সে গর্ভবতী হয় কিন্তু তাকে গর্ভপাত করতে বলা হয়, কারণ তার প্রেমিক তা চায় না। তার বয়ফ্রেন্ড একজন মদ্যপ, বদরাগী। আমাদের অনেকের জীবনের সাথে মিল আছে, তাই না?

মেইড ছবিতে একটা জিনিস পরিষ্কারভাবে বোঝানো হয় শুধু  শারীরিক নয় মানসিক নির্যাতনও  একটি ভয়ংকর ব্যাপার। এই মানসিক নির্যাতন না মানতে না পেরে এ ছবির কেন্দ্রীয়  চরিত্র অ্যালেক্স তার বন্ধু শনকে ছেড়ে চলে যায়। শন রাগ  হলে দেয়ালে ঘুসি মারে, কাঁচের বাটি  ছুঁড়ে  দেয় এবং অতিরিক্ত মদ খায়। কিন্তু আলেক্স সবাইকে বুঝাতে অক্ষম হয় যে, সে শারীরিক নয়, মানসিক নির্যাতনের শিকার। সমাজে মানসিক নির্যাতনকে খুব ক্ষুদ্রভাবে দেখা হয়। আমাদের বাঙালি সমাজে বলে, ‘গায়ে তো হাত দেয় নি, একটু বকা টকা দেয়, একটু মানিয়ে নাও’। তেমনি অ্যালেক্সকে ভাবতে হয়েছিল আদালতকে সে কী বলবে, যখন তাকে স্পর্শ করা, আঘাত করা বা মারধর করা হয়নি। এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ শেল্টারে থাকা ড্যানিয়েলের মুখ থেকে দেয়া যায়- “Before they bite, they bark. Before they hit you, they hit near you. And it grows, like mold on the walls”.

নারী স্বাধীনতার অন্যতম  মূলমন্ত্র হলো অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যা এই ছবিতে স্পষ্ট। শুরুতে অ্যালেক্সের কোনো অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছিল না। শন তার কাছে থাকা একমাত্র এটিএম কার্ডটি নিয়ে গেছে, তাকে আর্থিক এবং মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। অ্যালেক্স অর্থনৈতিক  স্বাধীনতার আনন্দ উপভোগ করতে পেরেছে, যখন সে  ভ্যালু মেইডস সংস্থার ব্যবস্থাপক ইয়োলান্ডার সাথে কাজ করার সুযোগ পায়। মেইড হিসাবে কাজ তাকে তার একমাত্র শিশু কন্যা কে নিয়ে  বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিয়েছিল।  ছবির এই জায়গাটা আমাকে প্রচন্ড ভাবিয়েছে যখন অ্যালেক্স ভেবেছে এই নোংরা টয়লেট পরিষ্কার করার কাজ সে ছেড়ে দেবে কিন্তু জীবনযুদ্ধ্ব তাকে আরো বেশি তার কাজের প্রতি নিবেদিত করে, আর  সে আরো ভাল মেইড হয়ে ওঠে।  তার এই নিবেদিত হবার ক্ষমতাই হয়ত সিরিজের শেষে তার জন্য উচ্চশিক্ষা অর্জনের পথ তৈরি করেছিল। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অ্যালেক্সকে পরবর্তীতে করে সাহসী করে আর সে হয়ে ওঠে শেল্টারের নারীদের অনুপ্রেরণা। এই কাজই তাকে শিখিয়েছিল ন্যায্য পাওনা আদায়ের জন্য প্রতিবাদ করতে। আমার ওই মুহূর্তে মনে হয়েছে একজন মানুষ ঝড়ের মুখে তার চলার পথে অনেক কিছু বেছে নেয়, কিন্তু তার আত্মপ্রত্যয়ী  মনোভাব তাকে নিতে পারে একদম শীর্ষে। অ্যালেক্সের মধ্যে আমি তাই  নিজেকে দেখেছি।

মেইড ছবিতে কিছু নারী চরিত্র আমাকে অনেক ভাবিয়েছে। আমি দেখতে পেয়েছি কীভাবে অনেক নারী পুরুষের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে  নানাভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। যেমন অ্যালেক্সের ক্লায়েন্ট একজন ধনী কর্মজীবী মহিলা, সন্তান ধারণ করতে না পারায় তার স্বামী তাকে প্রত্যাখ্যান করে। সে কি তার অধিকারের জন্য লড়াই করে? না। কিন্তু সে একটি শিশুকে দত্তক নেয়, তাকে বড় করে তোলে এবং ওয়াইন খেয়ে তার দুঃখগুলোকে  ভোলার পথ খোঁজে।

আশ্রয়কেন্দ্রের ড্যানিয়েল। তার স্বামী তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যার চেষ্টা করার পরে তার ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু ছেলের নিরাপদ ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দিতে সেই নির্যাতনকারীর কাছেই ফিরে আসে।

অ্যালেক্সের মা পলা চরিত্রটিও পারিবারিক নির্যাতনের শিকার  হয়েছিল। অ্যালেক্স যখন শিশু ছিল, তখন তিনি আলাস্কায় পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং তাকে একা বড় করেছিলেন। তার বাইপোলার ডিসঅর্ডার যত  না ছিল, তাকে আমার মনে হয়েছে সে ট্রমাগ্রস্থ  যা সে বারবার অস্বীকার করত।  জীবনে বার বার পুরুষের কাছ থেকে  আঘাত পেয়ে সে  ওই পুরুষের প্রেমেই  পড়ত।

পলার নিজের অনাকাঙ্খিত ট্রমা শুধুমাত্র তার আত্ম-ধ্বংসেই অবদান রাখে না বরং অ্যালেক্সকে তার নিজের ট্রমা থেকে মুক্তির সুযোগ দেয় না। এখানে বারবার আমার মনে হয়েছে একজন মানসিকভাবে শক্তিশালী মা সন্তানের কতটা প্রয়োজন। অ্যালেক্সের মতো স্বাধীনতাকামী  নারীদের পাশাপাশি এই নারী চরিত্রগুলোকে দেখে আমার মনে হয়েছে, কিছু নারী নিজের আত্মসম্মান বুঝতে পারে না বা বুঝতে  চায় না। আর তাই বারবার তারা পুরুষকে তার সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু ভাবে।  পরগাছা হয়ে বেঁচে থাকা যেন।

শনের মুখের একটা ডায়ালগ  আমাকে ছবিতে স্পষ্ট করে পুরুষতন্ত্র দেখিয়েছে-

““Where are you gonna go? I pay all the bills, let you hang out with my friends, let you move into my trailer, you drink my beer, eat my food, let you mooch off me. I do everything for you. If you walk out of here, you’ll have no one!”.

শন  হচ্ছে সেই বিষাক্ত পুরুষতন্ত্রের বাহক যেমন অ্যালেক্সের বাবা। নাটে নামে আরেকটি চরিত্র আছে ছবিতে যে অ্যালেক্সকে পছন্দ করে, যাকে  সহানুভূতিশীল আর আবেগপ্রবণ পুরুষ মনে হয়েছিল। নাটে  আলেক্সকে একটি ছাদ, খাবার এবং যাতায়াতের জন্য একটি গাড়ি অফার করে। কিন্তু যখন সে বুঝতে পারে যে অ্যালেক্স কখনােই তার অনুভূতির প্রতিদান দেবে না তখন সে তার কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নেয়। পুরুষের আসল  চেহারার উন্মোচন এভাবেই হয় এই ছবিতে।

সর্বোপরি মেইড এমন একটা সিরিজ যা মেয়েদের আত্মমর্যাদার  কথা বলে। অ্যালেক্স  হচ্ছে  সেই  শক্তিশালী নারী  যে জেগে উঠতে শিখেছে আর  বলতে পেরেছে- আমি  বেঁচে আছি আমার মেয়ের জন্য। মেইড একজন সিঙ্গেল মায়ের আত্মবিশ্বাসের গল্প। অ্যালেক্স পেরেছে পুরুষতন্ত্রের মুখে কষে চড়  দিতে। মেইড ছবির অ্যালেক্স একজন নারীবাদী যে বলে- “You’ll never ever control me again”.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *