November 21, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

ক্ষমতার দাপটে তারা কি পার পেয়ে যাবে?

নাহিদা নিশি।। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের একটি বিশ্রী ভিডিও গত কয়েকদিন ধরেই স্যোশাল মিডিয়ায় ঘুরছে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং তার নাতনি জাইমা রহমানের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কৌতুক করছেন। জাইমা রহমান’কে চরিত্রহীন, লুচ্চা, কুলাঙ্গার বলে গালি দিচ্ছেন। তারেক রহমানের জন্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।

যেহেতু আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই জানেন না যে বর্তমান বিশ্বে সেক্সিজম এবং রেসিজম’কে জঘন্যতম অপরাধ হিসেবে দেখা হয়, যেহেতু জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বহু সংসদ সদস্য এর আগেও আপত্তিকর কখাবার্তা বলে গেছেন, সেহেতু প্রতিমন্ত্রীর এইরকম বক্তব্যে দেশের সাধারণ জনগণ খুব একটা আহত হননি। হাতে গোনা কিছু সচেতন নাগরিক এবং নারীবাদীরা প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছেন। বিএনপির কিছু লোকজন অবশ্য নিন্দা জানাচ্ছেন কিন্তু আমরা জানি তাদের এই অবস্থানের কারণটা শুধুমাত্র রাজনৈতিক। আওয়ামী লীগ কিংবা অন্য কোনো দলের কোনো নারী নেত্রী এরকম সেক্সিস্ট আচরণের শিকার হলে তারা কেউ প্রতিবাদ জানাতেন না বলেই ধারণা করি।

যাই হোক, প্রতিমন্ত্রী এখনো তার বক্তব্যের জন্য কোনোরকম ক্ষমা চাননি। ক্ষমা না চেয়ে চুপ থাকলে তাও মানা যেতো, কিন্তু তিনি চুপও থাকেননি উল্টো নারীবাদীদের গালাগালি করেছেন। গতকাল রাতেও তিনি বলেছেন, তিনি তার বক্তব্যে অটল আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন। কি ভয়াবহ, ভাবা যায়! বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই আমাদের এই প্রতিমন্ত্রীর মতো। নারী-পুরুষ সকলেই এখানে সেক্সিস্ট আচরণ করে, সেক্সিজমকে প্রশ্রয় দেয়। কিন্তু বেশিরভাগ লোকের আচরণ আর প্রতিমন্ত্রীর আচরণ এক হলে তো চলে না। ফেসবুকে আমজনতার কমেন্ট, চার ক্লাস পড়া চায়ের দোকানদারের মন্তব্য আর একজন প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য তো একরকম হতে পারে না। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা প্রতিটি ব্যক্তিকে কথা বলতে হবে হিসেব করে, মেপে মেপে, কারণ তারা আমাদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, গত রাতে  প্রতিমন্ত্রী যখন লাইভে এসে আরেক দফা অভদ্র আচরণ করে গেলেন, তখনই তার একটি কল রেকর্ড ফাঁস হয়ে যায়। চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির সাথে তিনি ফোনে কথা বলছেন। যদিও কারো ব্যক্তিগত আলাপ রেকর্ড করে রাখা চরম অভব্যতা বলে মনে করি কারণ এতে ব্যক্তির প্রাইভেসি নষ্ট করার মতো ভয়াবহ অপরাধ ঘটে যায়, তারপরও কিছু কিছু কল রেকর্ড ফাঁস হলে পৈশাচিক আনন্দ হয়, বিশেষ করে যখন সেটার মাধ্যমে কোনো ভণ্ড মানুষের মুখোশ উন্মোচিত হয়।

পৃথিবীর যেকোনো নারীর সাখে আমাদের এই প্রতিমন্ত্রীর শারীরিক সম্পর্ক থাকতে পারে, এটা একান্তই তার এবং তার পরিবারের ব্যাপার। একসাথে কেউ শত শত নারীর সাথে সেক্সুয়াল রিলেশনশিপে থাকলেও আমাদের আপত্তি করার কিছু নাই (যদি তিনি জনগণনের ট্যাক্সের টাকায় ফূর্তি না করেন)। কিন্তু সমস্যাটা তখনই হয়, যখন তারা একের অধিক নারীর সাথে যৌন সম্পর্ক রেখে অন্যের চরিত্রের দিকে আঙুল তোলেন। আর ঠিক এই কারণেই কিছুদিন আগে মামুনুল হক সমালোচিত হয়েছিলেন। ভণ্ডামির কারণে তার গ্রুপের কিছু লোকজনও তাকে বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন। আমাদের আশপাশ এরকম অসংখ্য মুরাদ হাসান এবং মামুনুল হক দিয়ে ভরা। এইসব পুরুষদের নিজেদের চরিত্রের কোনো ঠিক ঠিকানা থাকে না, কিন্তু সুযোগ পেলেই এরা নারীর চরিত্র বিশ্লেষণ করতে নেমে পড়ে। নিজেরা যৌনতায় মেতে থেকে নারীদের ‘পতিতা’ আখ্যা দেয়। কারণ এটাই সহজ! কারণ এতে পাবলিকের সমর্থন মেলে।

প্রতিমন্ত্রী একজন প্রচন্ড রকমের ক্ষমতাবান পুরুষ, আর  ক্ষমতাবান পুরুষ মানেই ভয়ঙ্কর। এরা এদের চেয়ে কম ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিটি নারী’কে ডমিনেট করতে চায়, দুনিয়ার সব নারীকে এরা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। কোনো নারী যখন এদের সাথে সেক্সে যেতে অসম্মতি জানায় তখন এরা জোরাজুরি করে। ক্ষমতার জোরে এরা “পুলিশ, এনএসআই, ডিজিএফআই, আনসার সব পাঠায়া তোরে তুইলা আনমু” কিংবা “তোরে গুলি করমু” বলে হুমকি দেয়।

মাহির চরিত্র কেমন, সে কয়জনের সাথে শোয়, এটা আমার জানার দরকার নাই। কল রেকর্ড শুনে এটুকু অন্তত বোঝা যায় যে মাহি সেই মুহুর্তে মুরাদ হাসানের সাথে বিছানায় যেতে মোটেও আগ্রহী না, তাকে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। এইসব ক্ষমতাবান পুরুষদের হাতে এরকম কতো মাহি যে জিম্মি হয়ে আছে কে জানে! মুনিয়ার কথা মনে আছে না? মরেই গেল মেয়েটা এক ক্ষমতাবান পিশাচের হাতে। বিচার তো হলোই না, বরং অপরাধী আমার আপনার সামনে সসন্মানে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

এবারে আপনারা বলতে পারেন যে, “মাহি কিংবা মুনিয়ারা এতো লোভী কেন হয়? তারা যায় কেন ক্ষমতাবান পুরুষদের কাছে?”  আসলে ক্ষমতাবান পুরুষদের সাথে এইসব সুন্দরী মেয়েরা কখনো নিজে থেকে শুতে যায় না, নিজে থেকে অ্যাপ্রোচ করে না কখনো।  পুরুষেরাই সিলেক্ট করে দেয়, তারা কখন কাকে নিয়ে আসবে, কাকে নিয়ে খেলবে, কাকে রেপ করবে, কাকে খুন করবে আর কাকে ভালোবাসবে! সুন্দরী নারীরা একবার কোনো ক্ষমতাবান পুরুষের নজরে পড়ে গেলে আর রক্ষা নাই। দুটো রাস্তাই কেবল খোলা থাকে তখন। একটা হলো, সমস্ত কিছু মেনে নিয়ে ক্ষমতাবানদের সাথে শোয়া এবং নিজেরও স্বার্থ উদ্ধার করে নেয়া (এটা তুলনামূলক সেফ)। অন্যটা হলো, পালিয়ে যাওয়া, সমস্ত কিছু ছেড়ে ক্ষমতাবানদের চোখের আড়ালে চলে যাওয়া (মরে যাওয়ার মতো অনেকটা)। প্রতিবাদ করতে গেলে, বাঁধা দিতে গেলে, সব শেষ।

এই ফোনালাপ শোনার পর প্রতিমন্ত্রী’কে চোখ বন্ধ করে একজন ‘পটেনশিয়াল রেপিস্ট’ বলা যায় (রেপিস্টও বলা যায়) যেহেতু তিনি নিজেই ফোনের অপর প্রান্তে থাকা নারীটিকে বলছেন, “তোরে রেপ করমু”! নিজে একজন রেপিস্ট হয়ে অন্য নারীদের চরিত্রের দিকে কাদা ছুঁড়ছেন, শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বলে! হাস্যকর না?

জাইমা রহমান যদি রোজ রাতে ‘কৃষ্ণাঙ্গ’দের সাথে শুয়েও থাকেন, তাতে কারো বলার কিছু থাকে না। কারণ স্বেচ্ছায় কারো সাথে  শোয়ায় কোনো অপরাধ হয় না। অপরাধ তখন হয় যখন আপনি একজন’কে রেপ করতে চান, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে যখন কাউকে সেক্সুয়াল সম্পর্কে যেতে বাধ্য করেন। অপরাধ তখন হয়, যখন আপনারা সেই পার্ভার্টের বিচার না চেয়ে তাকে সাপোর্ট করেন, তার অপরাধ’কে জাস্টিফাই করেন। অপরাধ তখন হয়, যখন একজন রেপিস্ট, পার্ভার্ট, বর্ণবাদী এবং সেক্সিস্ট পুরুষ আমার-আপনার টাকায় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে থাকে, খায়-দায়, ফূর্তি করে।

দিন বদলাচ্ছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার এইসব নোংরা কৌশলকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে থাকা বদ লোকজন’কে এখনই প্রতিহত করতে হবে। আপনি যেই দলেরই হোন না কেনো, যেই মতেরই হোন না কেনো, নারীবিদ্বেষী কথাবার্তাকে ‘না’ বলতে হবে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *