এই ‘ইফতেখার আবেদীন’রা আসলে কারা?
সাদিয়া মেহজাবিন ।। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে ফিরে শুভ্র শান্ত এক চেহারা ভেসে বেড়াচ্ছে। ছবিতে দেখে মনে হবে না পিছনের ঘটনা এতটা কুৎসিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী ইলমা চৌধুরী মেঘলা। গত ১৫ ডিসেম্বর জানা গেল, স্বামী মারধর করে হত্যা করেছে মেঘলাকে।
বিভিন্ন খবরের কাগজের সূত্রে জানা যায়, কানাডা প্রবাসী ইফতেখার আবেদীন দেশে এসে স্ত্রীকে মারধর করেন এবং একপর্যায়ে হত্যা করেন। কিন্তু মারধরের ইতিহাস এই প্রথম না। বিয়ের শুরু থেকে নানা দাবি ইফতেখারের। মেঘলাকে নানান রকম শর্ত দিয়েছিলেন ইফতেখার। শর্তের তালিকায় ছিল হিজাব পরা, বন্ধু বান্ধবের সাথে যোগাযোগ না রাখা, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতে বোরকা পরা এবং নিজের পরিবারের সাথে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ করা। জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে অনলাইনে অডিও এবং ভিডিও কলের মাধ্যমে নজর রাখতো ইফতেখার। ময়না তদন্তের ছবিতে দেখা যায়, মেঘলার শরীরে প্রচুর মারের দাগ, রক্তের ছাপ এবং গলার এক পাশে কাটা দাগ।
সমস্ত তথ্য যেন আমাদেরকে এক বড় নিঃশ্বাস ফেলতে বাধ্য করে। অনেকের কাছে এটা স্বাভাবিক ঘটনা আবার অনেকের কাছে আতঙ্কের। কিন্তু এমন ঘটনার শিকার হওয়ার সংখ্যা দিনে দিনে না কমে বরং বেড়ে চলেছে। আমরা নিজেদেরকে যতটা আধুনিক দাবি করি না কেন, আমরা এখনো সে পুরানো পুরুষতান্ত্রিক সমাজেই বসবাস করছি। আর এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মূখ্য চরিত্র এই ইফতেখার আবেদীনরা।
একজন শিক্ষিত মেয়ের সাথে এমন ঘটনা ঘটে যাওয়া সত্যি খুব অবাক করার মত ব্যাপার। কিন্তু মেঘলার মত একজন শিক্ষিত-সাংস্কৃতিক মুক্তমনা মেয়ে কেন এসবের শিকার হয় তার প্রশ্ন ও উত্তর কি আমরা খুঁজেছি? বোধ হয় না, কেননা এখনো আপনারা বলবেন , ‘‘স্বামীর মন জুগিয়ে, তার কথা মেনে নিলেই হতো’’। মেঘলার মা বাবা ও স্বজনেরা কাঁদছেন কিন্তু এখন কেঁদে আসলে কি কিছু হবে? মা বাবা কেন আগে পদক্ষেপ নিলেন না? এমন প্রশ্ন আসলে কতটা যৌক্তিক?
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বেশিরভাগ নিয়ম পুরুষের তৈরি। ‘বিয়ে’ নামক এক প্রথার সৃষ্টিও নারীকে কেবল একগামী করে রাখার প্রয়োজনে এবং তার সব অধিকার থেকে বঞ্চিত করে পণ্য করে পুতুলের মত নাচানোর এক কুৎসিত উদ্দেশে। আমাদের মস্তিষ্ক পুরুষতান্ত্রিক, দীর্ঘ এই শাসনের ছায়া থেকে বের হতে সময় লাগবে যা স্বাভাবিক। কিন্তু এখনো অনেক শিক্ষিত মেয়ে পারিবারিক, সামাজিক, মানসিক চাপে বিয়ে ও বিয়ে পরবর্তী ঝামেলা পোহাতে বাধ্য হন। প্রথমত বিয়ের মত একটা পুরুষতান্ত্রিক ব্যাপারের সাথে পণ্যের মত দর কষার ব্যাপার থাকে। সাথে যৌতুক যেন আরেক পদ্ধতি বশ করার। বিয়ে না করলে লোকে কী বলবে, সমাজে কীভাবে থাকবে ইত্যাদি ভেবে পারিবারিক ও মানসিক চাপে অনেকেই বিয়ে করেন। কিন্তু অ্যারেঞ্জড মেরেজ হলে স্বামীকে না চিনেই সংসার জীবনে ঢুকতে হয়। একে তো বাঙ্গালি এসবই মাথায় নেবে না, তার সাথে তাদের কাছে বিবাহিত জীবনে ধর্ষণ এখনো বোঝার বাইরে। একজন নারী বিয়ে করেন তার পরিবারের শান্তির জন্যে। তাই সে কতটা প্রতিবাদী বা শিক্ষিত নাকি অশিক্ষিত এগুলো আসলে মূখ্য বিষয় না।
মেঘলাসহ যারা এমন অন্যায়-অত্যাচারের শিকার হন, তাদের পূর্বের ভাবনায় থাকে পরিবারের পিছুটান। বিয়ের পর স্বামী অত্যাচার করলে, অন্যায় আবদার করলে অনেকে চাইলেও পরিবার বা কোনো পরিচিত কারো কাছে গিয়ে সাহায্য চাইতে পারে না। যদি চেয়েও বসে সে ক্ষেত্রে তাদের শুনতে হয়, ‘একটু মানিয়ে নাও, এমন সব সংসারে হয়। বাচ্চা নাও, সব ঠিক হয়ে যাবে’। তাহলে দয়া করে কেন মেঘলা বা অন্যরা বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেনি সে প্রশ্নটা হাস্যকর।
অনেকে নিজে সাহস করে এমন টক্সিক রিলেশন থেকে বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করেন এবং সফল হন। সেক্ষেত্রে সকলে তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এবং চরিত্রে আঙ্গুল তোলে। পরিবারসহ মেয়েকে মানসিক চাপ দিয়ে অসুস্থ করে তোলে। মৃত্যুর পর হাহুতাশ করলে তাই মেকি লাগে ব্যাপারটা।
কে কী করলো সে হিসাব কষাও অযৌক্তিক। ইফতেখার আবেদীন কারা? এরা মূলত সাহসী পুরুষতান্ত্রিক পুরুষ, যারা জানেন স্ত্রীকে মারা বৈধ, স্ত্রীর ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে কিছু নেই এবং হত্যা করলেও শাস্তি হবে না। ইফতেখারসহ বাকিরা একদিনে এমন হয়ে যায়নি। ছোটবেলা থেকে তিলে তিলে এরা পুরুষতান্ত্রিক ড্রাগন হয়ে যায়। ছোটবেলায় ছেলে বলে বেশি খাওয়া, বোনকে মারধর করা, বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করার পরেও ‘‘ছেলেরা একটু এমন হয়’’- শুনে বড় হয় তারা। অল্প অল্প করে সাহস বাড়তে থাকে এদের। এরপর রাস্তায় মেয়েদেরকে ইভটিজিং করা, যখন তখন মেয়েদের বুকে হাত দেওয়াকে রাজনৈতিক অধিকার মনে করা এবং বৌকে দাসীর মত খাঁটিয়ে মেরে ধরে মেয়ের বাড়ি থেকে টাকা আনা সবই তাদের কাছে পুরুষ হয়ে জন্মানোর সুফল মনে হয়। সাথে নিজে যতটা বেপরোয়া হোক না কেন, স্ত্রীকে হিজাব-বোরকা দিয়ে পর্দা করে বন্দি করে রাখা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করাও পুরনো উপায়, যেখানে তারা নারীকে নিজের একান্ত সম্পত্তি বলে ভেবে থাকে। নারীকে নিজের সম্পত্তির মত ভোগ করার জন্যে নানান ভাবে এরা চেষ্টা করে বাইরের মুক্ত পরিবেশ থেকে আড়াল করে রাখতে। সবই এদের কাছে একটা সাহসী ব্যাপার। নূন্যতম অনুভূতি তাদের নেই।
যাদের ছেলেরা এমন করে, তাদের পরিবারে খেয়াল করে দেখলে বুঝবেন কেন এরা এত পুরুষতান্ত্রিক। নিজের ছেলেকে যা ইচ্ছে করতে দিয়ে অন্যের মেয়েকে ঘরে পর্দার ভেতর রাখার কৌশল বেশিরভাগ ছেলে পরিবার থেকেই শেখে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ পরিবার চরম পুরুষতান্ত্রিক।
শুধু ইফতেখার আবেদীন একজন না। তারা সংখ্যায় অগণিত। একটু খেয়াল করলেই আমরা আমাদের আশেপাশে দেখতে পাব এসব। আর যারা সমাজের কথা ভেবে চুপ থাকে, পরিবারের কথা ভেবে চুপ থাকে, তারা নিশ্চিত বোকা। কেননা এই সমাজ আদিযুগ থেকেই এমন ছিল। এরকম মেঘলা হাজারটা গেলেও তারা তাদের গর্ভের সন্তান একজন পুরুষই চায়। পুরুষ তাদের কাছে ক্ষমতাসীনের প্রতীক। তারা সমাজ পরিবর্তন না করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে না গিয়ে, নিজের সুবিধার কথা ভেবে গর্ভে একজন পুরুষই চান যে বড় হয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিচ্ছবি ও নেতা হবে।
যেসব নারীরা তুলনামূলক সচেতন এবং শিক্ষার আলো পেয়েছেন তাদের উচিত হবে না এরকম অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। কেননা সমাজ বা পরিবার কেউই আপনাকে বাঁচাতে আসবে না। নিজের তলোয়ার যদি নিজে না ধরেন আপনাকেও মেঘলাদের মত খুন হতে হবে। একজন মানুষ হিসেবে অন্তত নিজেকেসহ বৃহত্তর পরিসরে নারীদের বাঁচানোর একমাত্র উপায় নিজের ভাবনার মুক্তি। নিজেকে শক্ত করে গড়ে তোলা এবং মাথা থেকে পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা বাদ দেওয়া। একজন মানুষ হিসেবে সুষ্ঠভাবে বাঁচার অধিকার সকলের। তাই নিজেকে সচেতন করা, স্বাবলম্বী করা এবং ভাবনার মুক্তি ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। যারা মেকি কান্না কেঁদে আপনার জীবন তছনছ করবে তাদেরকে বর্জন করুন। নিজেকে ভালোবাসুন।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]