নারীবাদ এবং মেকআপ: মেকআপের কাজ কী?
বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত মলি এডমন্ডসের লেখা How Makeup Works প্রবন্ধটি ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য বাংলায় অনুবাদ করেছেন কারিন আশরাফ ।।
১৯৬০ আর ৭০ এর দশক ছিল আমেরিকায় দ্বিতীয় তরঙ্গ নারীবাদের প্রবল জনপ্রিয়তার সময়। তখন নারীকে পণ্যায়ন করা যেতে পারে এমন সবকিছুকে প্রত্যাখ্যান করতে নারীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন নারীবাদীরা। মেকআপ ব্যবহার করা বা পুরুষদের চোখে আকর্ষণীয় হতে পারে, এমন পোশাক পরাটা তখনকার নারীবাদীদের দৃষ্টিতে ছিল অপমানজনক। এতে যেন পুরুষতান্ত্রিক সেই সংস্কৃতির প্রতিই আত্মসমর্পণ করা হয়, যেখানে নারীকে সৌন্দর্য দিয়ে বিচার করা হয়। নারীর বুদ্ধিমত্তাই যেন তার পরিচয় হতে পারে, সেজন্য তাদের স্লোগান ছিল পুরুষদের আকর্ষণের উদ্দেশ্যে প্রসাধনীর ব্যবহার বন্ধ করা।
কিন্তু তাদের এই যুক্তিটি তেমন সাদরে গৃহীত হয়নি। কিছু নারীর শঙ্কা ছিল যে, লিপস্টিকটাও যদি ছেড়ে দিতে হয় – তাহলে সমাজের কাছে বিচ্ছিরি বুড়ি হিসেবে চিহ্নিত না হতে হয়! আবার অনেকের মতে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য বেশভূষার মধ্যে প্রসাধনীর ব্যবহার থাকতেই পারে। কিছু নারী স্বীকার করেন যে, যদিও পুরুষদের আকৃষ্ট করতে তারা লিপস্টিক ব্যবহার করেন, কিন্তু তারা তাদের নিজেদের আনন্দের জন্যও এটি ব্যবহার করেন। শৈল্পিক আর সুন্দর এই কাজটা তারা সহজেই ছেড়ে দিতে চাননি, যদিও এই প্র্যাকটিসের মধ্যে লিঙ্গবাদের একটা আভাস রয়েছে।
আজও নারীবাদীরা মেকআপের ইস্যুতে বিভক্ত। একদিকে, মেকআপ করার অধিকারটা নারীবাদীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, প্রসাধনী ইন্ডাস্ট্রি এবং টেলিভিশন অনুষ্ঠানগুলো যেসব বার্তা দেয় তা তাদের কাছে আশঙ্কার। নারীরা অসম্পূর্ণ ও তাদের মেরামত করা দরকার, এবং তা শুধুই সম্ভব নির্দিষ্ট পণ্য কিনলে – এমন একটি বার্তা দিচ্ছে প্রসাধনী কোম্পানিগুলো।
সমালোচকদের কাছে সবচেয়ে বেশি আশঙ্কাজনক সম্ভবত এইটি, যে দিনে দিনে আরো কমবয়সী মেয়েরা মেকআপ ব্যবহার করছে। যদি সত্যিই মেকআপ পুরুষের চোখে আকর্ষণীয় হওয়ার উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে, তাহলে কি লিপগ্লস আর ব্লাশ ব্যবহার মেয়েদের কম বয়সেই যৌনায়িত করে? যদি প্রসাধনীর ব্যবহার ত্বকের জন্য ক্ষতিকর হয়, তাহলে শিশুদের ত্বকের জন্য তা কতটা বিষাক্ত হতে পারে?
এই প্রশ্নগুলোর ইস্যুতে নারীবাদীদের মধ্যে ঐকমত হবে তা আশা করা যাচ্ছে না। কিছু নারীর জন্য মেকআপ সবসময়ই বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে অবিচ্ছেদ্য। আবার কিছু নারীর কাছে মেকআপ অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু পুরুষেরা মেকআপ নিয়ে আসলেই কি ভাবেন? যদিও র্যাডিকাল ফেমিনিস্টদের মতে এটি পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে করা – আপনি ইতিহাসে মেকআপের প্রতি পুরুষদের প্রতিক্রিয়া জেনে অবাক হবেন।
প্রাচীন রোমান কবি মার্শাল একজন প্রসাধনী ব্যবহারকারী নারীকে লিখেছিলেন : “তুমি মিথ্যা দিয়ে গড়া। কেউ বলতে পারে না, তোমাকে ভালোবাসি। কারণ তোমাকে সে ভালোবাসে না, আর তুমি যা তাকে কেউ ভালোবাসতে পারে না।” (সূত্র: Etcoff)
১৭৭০ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট একটি অদ্ভুত আইন পাশ করে। সেই আইনে বলা হয় মেকআপের ব্যবহার ডাকিনীবিদ্যা বা জাদুবিদ্যার সমতুল্য অপরাধ! এর কারণ ছিল পুরুষরা নারীর যে রূপ দেখে বিয়ে করত, বিয়ের পরে তার সত্যিকারের চেহারা দেখে তারা বিভ্রান্ত হত।
বর্তমানে মেকআপের প্রতি পুরুষের আগ্রহ নারীদের মতই বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত। তবে ২০০৮ সালে করা একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, বারগুলোতে মেকআপ পরিহিতাদের দিকে বেশি দ্রুত আর বেশিবার পুরুষেরা এগিয়ে এসেছে। পুরুষরাও কি তাহলে সেই একই বিউটি স্ট্যান্ডার্ড দ্বারা প্রভাবিত যার কারণে নারীরা মেকআপ ব্যবহার করে?
প্রাচীন মিশরে পুরুষরা যদিও প্রসাধনী ব্যবহার করত, ২০ শতকে তারা মেকআপ ব্যবহার ত্যাগ করেন যাতে তাদের “নারীসুলভ” বলে চিহ্নিত করা না হয়। তখনকার যুগে মেকআপ ব্যবহার করতেন ডেভিড বাওয়ির মত রকস্টাররা, যারা একটা ‘এন্ড্রোজিনাস’ স্টাইল প্রদর্শন করতে চেয়েছিলেন। বিগত বছরগুলোতে অনেক পুরুষকে মেকআপ ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে, যার ফলে সাংবাদিকরা ‘গাইলাইনার’, ‘ম্যানস্কারা’ সহ বিভিন্ন নতুন শব্দ তৈরি করছেন। মেকআপ ইন্ডাস্ট্রিগুলো একটি নতুন সম্ভাবনা দেখছে পুরুষের কাছেও কসমেটিকস বিক্রি করার, তবে বলা বাহুল্য এটি করতে প্রয়োজন আরো সময়।