November 22, 2024
কলামফিচার ২

“কেমন করে যে আমার বউ আমাকে এতো সহ্য করে!”

আঞ্জুমান রোজী ।। বাস্তবেও দেখি, এমনকি ভার্চুয়ালিও দেখি, খুব গর্বের সঙ্গে বুক ফুলিয়ে প্রায় সব পুরুষই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বলেন,”আমার অত্যাচার সহ্য করে কীভাবে আমার স্ত্রী এতোটা বছর একসঙ্গে কাটিয়ে দিলো!” এই বলার মধ্যে কিন্তু পুরুষতান্ত্রিকতা চূড়ান্তভাবে বিদ্যমান। স্বামীটি ভালো করেই জানেন, স্ত্রী তার সব অত্যাচার সহ্য করতে বাধ্য। কারণ, নারীকে নির্ভরশীল করে গড়ে তোলা হয়। জন্মদাতা পিতার পরেই স্বামী পুরুষটি হলো নারীর শেষ আশ্রয়। আর সেই দুর্বলতার সুযোগে পুরুষটি তার স্বেচ্ছাচারিতার চরমে উঠে যান এবং দম্ভের সাথে বলেন, স্ত্রী তার অত্যাচার কতটা সহ্য করে। এতে আত্মতুষ্টি যেমন আছে, তেমনই আছে পৌরুষের বাহাদুরি।

আমি এ জীবনে কখনোই কোনো নারীকে বলতে শুনিনি যে, তার স্বামী তাকে কতটা সহ্য করে। বাস্তবে এটা একটা অসম্ভব ব্যাপার। বরঞ্চ বিপরীতটাই ঘটে আসছে বেশি। কিন্তু কেন? কেন নারী পুরুষের সবরকম অত্যাচার সহ্য করবে? এই এখতিয়ার পুরুষকে কে দিয়েছে যে নারীকেই তার অত্যাচার মুখ বুঁজে সহ্য করে যেতে হবে? অনেক সময় সেই অত্যাচার এতই নির্মম হয় যে নারীর সহ্য ক্ষমতার মধ্যে তা আর থাকে না। বলতে গেলে তা অমানবিক পর্যায়ে চলে যায়। পুরুষের অত্যাচার নির্যাতন যেমনই হোক না কেন নারীর ধর্ম হলো তা সহ্য করে যাওয়া এবং সেই ধর্ম সুবিধামতো একচেটিয়াভাবে তৈরিও করেছে পুরুষ। পুরুষের এই মানসিকতার পেছনে কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণি, পেশা, উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই। বলতে গেলে সব পুরুষের মধ্যে এটা একটা সাধারণ বিষয়, যার মধ্যে পুরুষতান্ত্রিকতা শিকড় গেড়ে বসে আছে।

আদি এবং অনন্তকাল ধরে পণ্ডিত, শিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত, সব পুরুষই ভাবেন, নারীর কাজ হলো পুরুষকে সহ্য করে যাওয়া। এভাবে ভাবেন বলে তারা কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, লেখক, গবেষক; যে যে-ই অঙ্গনে কাজ করে জগৎ বিখ্যাত হতে চেয়েছেন, তা হতে পেরেছেন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সৃষ্টিশীল, মননশীল এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে যুগ যুগ ধরে পুরুষেরাই এগিয়ে আছেন। নারীর অবস্থান সেই তুলনায় খুবই নগন্য। নারী যদি তার স্বকীয়তা ধারণ করে এগিয়ে যেতে চান, তখন তাকে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বিশেষভাবে জানিয়ে দেয় তার গণ্ডি চার দেয়ালের মাঝে, যেখানে তার স্বামী সন্তানের সেবা দেয়াটাই একমাত্র কাজ। এই মানসিকতার একটা পুরুষ, নারীকে বাধ্য করে তার সকল প্রকার অত্যাচার সহ্য করতে। যার প্রেক্ষিতে লক্ষ্য করা যায়, কোনোকিছুতেই নারীকে পুরুষ স্বামীটি স্বস্তি দেয় না। পুরুষ স্বামীটি কেবলমাত্র  বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখে স্ত্রী নারীটি তার চাহিদা মতো সবকিছু ঠিকঠাক পালন করছে কিনা!

স্ত্রীর জন্মদিনে কিংবা বিবাহবার্ষিকীতে শুভেচ্ছাস্বরূপ সব পুরুষকেই বলতে দেখেছি, তাকে সামাল দিয়ে কিভাবে সংসার পরিচালনা করে, তারই গুণকীর্তনে মুখরিত হতে। অর্থাৎ স্ত্রী সংসার পরিচালনায় কতটা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারছে, সেটাই হলো বিচার্য বিষয়। স্ত্রীর কোনো নিজস্বতা, স্বকীয়তা যে আছে, তা কখনোই পুরুষগুলো চিহ্নিত করতে চায় না। এখন সেই স্বামী যেমনই হোক না কেন, ভালোমন্দ , অত্যাচারী, অনাচারী, যা-ই হোক না কেন স্বামীকে স্ত্রীর দায়িত্ব সেবা করা এবং স্বামীর সব অত্যাচার সহ্য করে যাওয়া। এমনকি প্রেমের ক্ষেত্রেও নারীকে পুরুষের পছন্দমতো সবকিছুতে সায় দিতে হয়। নাহলে সম্পর্ক টিকবে না। আর সেক্ষেত্রে প্রেমিক পুরুষের কমন অভিযোগ হলো, “আমি যা চাই তা না পেলে সম্পর্ক টিকবে কেমন করে!” অর্থাৎ সব অবস্থায় নারীকে পুরুষের মনের মতো হয়ে থাকতে হবে।

এমনও দেখেছি, যে সমস্ত পুরুষ পরকীয়াতে মশগুল থাকেন, তাদেরকে যদি বলা হয়, “এই অবৈধ সম্পর্কের কথা আপনার স্ত্রী জানলে  ব্যাপারটা কেমন হবে? আপনার স্ত্রী কি স্বাভাবিকভাবে নেবেন!” তখন স্বামী পুরুষটি বুক ফুলিয়ে বলবেন, “আরে, ও কি বলবে! ও তো আমাকে ছাড়া কিছুই বোঝে না!” আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয়া যে, স্বামী ছাড়া স্ত্রীর কোনো গতি নেই, অর্থাৎ কোথাও তার কোনো আশ্রয় নেই। কিছুদিন আগে মহাশ্বেতা দেবীর লেখা পড়তে গিয়ে তাঁর একটা উক্তি মাথায়-বুকে পেরেকের মতো গেঁথে গেল। উক্তিটি হলো, “নারী ছলনাময়ী, নারী জন্ম অভিনেত্রী। কিন্তু সে কি শুধু পুরুষজাতিকে মুগ্ধ করবার জন্যে? বিভ্রান্ত করবার জন্যে? বাঁচবার জন্যে নয়? আশ্রয় পাবার জন্যে নয়?” মহাশ্বেতা দেবীর মতো অনেক মহীয়সী নারীও সমাজে নারীর বৈকল্যকে গভীরভাবে উপলব্ধি করে গেছেন। কিন্তু তাতে কি পুরুষের মানসিকতা বদলেছে! বরঞ্চ বদলায়নি একবিন্দুও;  এখনও দেখতে হয়, শুনতে হয়,  “কেমন করে যে আমাকে এতো সহ্য করে” – পুরুষের এ জাতীয় উদ্ভট মনোবৃত্তি।

নারীকে দুর্বল মনে করে পুরুষ যদি তার অত্যাচার সহ্য করতে বাধ্য করে, তবে সেটা হবে  পুরোটাই অমানবিক। এক্ষেত্রে পুরুষ ভালোবাসার প্রলেপ দিয়ে নারীকে যতভাবেই বোঝাক না কেন,  বিষয়গুলো কিন্তু দিনের পর দিন জটিল হতে থাকে। সবকিছুর একটা সীমা আছে এবং ধারণ ক্ষমতারও সীমা আছে। এভাবে চলতে চলতে ভাঙ্গনের সুর যখন বাজে তখনও সমাজ-পরিবার নারীর দিকে কড়া অঙ্গুলি নির্দেশ করে একচেটিয়া  দোষ দেয়। এই সুযোগটাও পুরুষেরা সযত্নে ব্যবহার করে। তাছাড়া সবসময় ভালোবাসার খাতিরে নারীটি স্বামীর অত্যাচার সহ্য করে এমন ভাবাটাও বোকামি। নারী বাধ্য তাই সহ্য করে, আর কিছু নয়। নারী, পুরুষের সবরকম অত্যাচার সহ্য করে বলে পুরুষেরা যেভাবে গর্বিত হন এবং গর্বিত হয়ে সামাজিক মাধ্যমে স্ট্যাটাস দেন, তাতে তাদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারই পরিচয় পাওয়া যায়।

সেবাই মানব ধর্ম। সেবা অর্থাৎ পরিচর্যা, শুশ্রূষা, পূজা, উপভোগ, ভোজন, প্রণাম; যে অর্থেই ধরি না কেন তা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকলের প্রতি সকলেই দাবি করে। কিন্তু নারী-পুরুষের মধ্যে সেবা দেয়ার বিষয়টা ভিন্নতা রাখে। যদিও নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে একে অপরের প্রতি সেবা দেয়াতে কোনো দায়বদ্ধতা নেই। সেবার বিষয়টা আসে স্নেহমমতা,  ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং ভক্তি থেকে। সেখানে কেউ কারোর প্রতি সেবা বিষয়টা চাপিয়ে দেয়া হলো অমানবিক একটি চাপ। কিন্তু সমাজব্যবস্থা অর্থাৎ সামাজিক রীতিনীতি এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, একতরফা সেবা দেয়ার বিষয়টা নারীর উপর বর্তেছে এবং নারীই একমাত্র পুরুষের সেবক, যার কারণে নারীকেই পুরুষের সব অত্যাচার সহ্য করতে হয়; একথা নির্মম বাস্তবতার ভিত্তিতে অনেকভাবেই উঠে এসেছে। এতে পুরুষের লজ্জা হওয়া উচিৎ এবং তাদের গভীরভাবে ভাবা উচিৎ, জীবনসঙ্গিনীর সাথে দিনের পর দিন তারা কী পরিমাণ অবিচার করে যাচ্ছেন! পৃথিবী সুন্দর হয়, শান্তির হয় নারী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা দেখালে। সেই কাজটা নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে কেন করতে পারে না!

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *