কোথায় দাঁড়িয়ে নারীবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন?
প্রিয়া দেব।। সম্প্রতি জনি ডেপ এবং তার উপর তার সাবেক স্ত্রীর করা ভিত্তিহীন অভিযোগ নিয়ে আমাদের আশপাশের সচেতন জনতার উদ্বেগের সীমা নেই। প্রত্যেকে এবার পুরুষদের প্রতি হওয়া নির্যাতন নিয়ে সরব হচ্ছেন, সেটা হওয়াও উচিত, নারীর পাশাপাশি একটা পরিবারে একজন পুরুষও ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার হলে তা নিয়ে অবশ্যই আলোচনা দরকার এবং এই কাজ সমানভাবে সমালোচিত হওয়া উচিত। কিন্তু এ দেশে ব্যাপারটা আসলে সমালোচনাতে আবদ্ধ থাকেনি, আমাদের দেশে এই বিষয় নিয়ে সমালোচনার পাশাপাশি একটা জায়গাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে খুব আয়োজন করে, সে জায়গাটা হচ্ছে নারীবাদ। আক্ষরিকভাবেই এই আলোচনা শুরু করে ইনিয়ে বিনিয়ে যে প্রশ্নটা তোলা হচ্ছে, তার মূল বক্তব্য হলো – নারীদের অধিকার নিয়ে এত আওয়াজ তোলা হচ্ছে বলেই এমন ঘটনা ঘটছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এ দেশের প্রথম সারির দৈনিকগুলোর অনলাইন নিউজের নিচে এই দেশের সুশিক্ষিত মানুষ যারা কিনা প্রতিদিন ধর্ষণ, যৌতুক, হত্যাসহ ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের সব ক্ষেত্রেই নারীকে দোষ দেন, তারাও খুব যুক্তি দিয়ে বুঝাচ্ছেন “নারী নির্যাতন আইন” কিভাবে সাধারণ পুরুষদের ফাঁসিয়ে দিচ্ছে ভুয়া মামলায়। এদের বক্তব্য অনুযায়ী এদেশে নারীরা সুখেই আছে, অহেতুক এক আইন বানিয়ে রাখা হচ্ছে।
এইসব লোকই এই দেশে মেজোরিটি, আমি তাদের বাদ দিলেও বাকি যারা এলিট থাকেন, তারাও বেশ বড়সড় গলায় প্রশ্ন তুলছেন জনি ডেপের বেলায় নারীবাদীরা চুপ কেন?
হ্যাঁ, প্রশ্নটা করাই যায়, কিন্তু এই প্রশ্নের উপর ভিত্তি করে এই দেশে নারীদের অধিকার আদায় আন্দোলনের পথে কঠিন লড়াইয়ের বিষয়টাকে কি খারিজ করা যায়?
বাংলাদেশের গত কয়েকদিনের চিত্রটাই একটু দেখেন। এই বেশি না মাত্র কদিন আগে একজন নারী এই দেশে টিপ পড়ে হাঁটছিলেন বলে হেনস্থার শিকার হয়েছেন, সেই হেনস্থাকারীকে বাঁচানোর জন্য রীতিমতো বস্তাকে বউ পর্যন্ত বানিয়ে দিয়েছিলেন কয়েকজন সমাজের সংজ্ঞায়নে সুশিক্ষায় শিক্ষিত এলিট পুরুষ। সেই টিপ পড়ার কারণে যত প্রতিবাদ হয়েছে, সবখানে প্রতিবাদকারীরা নানাভাবে হেনস্থার শিকার হয়েছেন। লোকের মতে, এটা নিয়ে এত হইচইয়ের দরকারই নাকি ছিলনা। একজন নারী কী পোশাকে বাইরে যাবে, কপালে টিপ দেবে কি দেবে না এইটা ঠিক করতে আসছে একটা লোক, কিন্তু এটা নিয়ে আওয়াজ তুললে সে আওয়াজকে এই দেশে রীতিমতো প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। একজন নারীর অবস্থান এই দেশে ঠিক কীরকম তা এই ঘটনা দেখলেই বোঝা যায়।
সম্প্রতি আরেকজন শিক্ষিত, বড় ডিগ্রীধারী পুরুষ নিজের স্ত্রীর প্রাইভেসি নিয়ে বিরাট আলাপ দিতে এসেছেন, উনি বুঝিয়েছেন স্বামী স্ত্রী মধ্যে যেহেতু লজ্জাস্থানের গোপনীয়তা নাই, সেজন্য এত প্রাইভেসিরও দরকার নাই। এমনকি নারীকে তার সমস্যায় অপর আরেক নারীর কাছে সহায়তা চাওয়াকে সীমাবদ্ধ করে উনি সমাজে শান্তি আনতে চাচ্ছেন। এই শিক্ষিত পুরুষটির মাথায় একবারও এটা ঢুকছে না যে তার স্ত্রী একজন আলাদা সত্তা, মানুষ, সেই মানুষটার নিজস্ব একটা জীবন আছে। এবং এই না বোঝার ব্যাপারটা নিয়ে রীতিমতো উনি অহংকার করছেন, নিজের স্ত্রীকে কোনো প্রাইভেসি তিনি দিচ্ছেন না এটা তার কাছে বিরাট গর্বের বিষয়।
এই হচ্ছে আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থা। এইখানে একজন নারী তার পারিবারিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে সেই করতে চাওয়ার ইচ্ছাকে ডমিনেট করা হয়। কেন করা হয়? কারণ এইখানে নারী মরুক কিংবা বাঁচুক, পেশায় পাইলট হোক কিংবা গুগলের সিইও হোক, তার সাফল্য বিচার করা হবে তার বিয়ে বাচ্চা আর সংসার দিয়ে, তারে যে কোনোভাবে সংসার করেই বাঁচতে হবে। সেই সংসার সামলানো নারীটির জন্য যতো কঠিনই হয়ে দাঁড়াক না কেন, ওই নারীটিকে সংসার করে যেতেই হবে। এবং ধরেন এই দেশে রোজ ডমেস্টিক ভায়োলেন্সে নারীদের নানাভাবে অত্যাচারিত হওয়ার খবর আমরা পড়ি, সেই খবরেও ওই নারীটিকে বারবার দোষ দেওয়া হবে, অনলাইন নিউজের কমেন্টের মাঝে বারবার বুঝানো হবে দোষ আসলে একমাত্র নারীটির। নারী মরুক কিংবা বাঁচুক তারে সংসার করতেই হবে, সেই নারীটি সংসারে ফেইস করা সমস্যা নিয়ে কোথাও আলোচনা করতে গেলে সুশিক্ষিত স্বামীরা সেই আলোচনাটিও করতে দেবে না।
তো এই হচ্ছে আপনার দেশের বর্তমান চিত্র, এখানে এই সেদিনও পরকীয়ার কারণে ইফতারীতে বিষ মিশিয়ে স্ত্রীকে হত্যার চেষ্টা করেছেন একজন পুরুষ। এমন একটা দেশে দাঁড়িয়ে আপনি জনি ডেপের স্ত্রী কী করেছেন তা দিয়ে নারী অধিকার নিয়ে কথা বলতে থাকা মানুষদের প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেন না, এই আচরণ খুবই অপরিপক্ক এবং এই আচরণ খুব স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে নারীদের অধিকার নিয়া আপনার চিন্তা আসলে কতোটা সংকীর্ণ। অন্য এক দেশে একজন নারী তার অধিকারের অপব্যবহার করছেন বলে আপনি এই দেশে যেখানে নারীরা অধিকার পাওয়ার জন্য দিনরাত লড়াই করে যাচ্ছেন, সেইসব নারীদের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ খুঁজতে পারেন না। এই উভয় ক্ষেত্র এক করে মিলানো খুবই সংকীর্ণ মনোভাবের পরিচয় দেয়। এজন্য নারীবাদকে প্রশ্ন করতে আসার আগে আপনি কোথায় দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা করছেন তা বুঝতে পারা খুবই জরুরি। এই বোধ না হওয়া অব্দি মূর্খের মতো এ দেশে নারীদের নিচে টেনে নামানোর মতো জঘন্য চর্চা বন্ধ হবে না, আজকে কেউ বেঁচে থেকে খুন করলে আপনি বাকি মানুষদের বেঁচে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে আসলেই পারেন না। এই দেশে নারীদের অধিকার আদায়ের লড়াই অনেক কঠিন, এইখানে বাসে মহিলা সিটে পুরুষরা বসে যান আয়েশ করে, নারীদের সেই সিট আদায়ের জন্য পর্যন্ত লড়াই করতে হয়; সেখানে ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের মতো ব্যাপারে জনি ডেপের ঘটনা টেনে এই দেশের নারীদের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো বোকামীগুলো এবার বন্ধ হোক। নারীরা বাঁচুক মানুষ হয়ে, এই বাঁচার পথে ক্রমাগত বাঁধা হয়ে না দাঁড়িয়ে বরং এবার আওয়াজটাই তোলা উচিত, অনেক তো হলো আওয়াজ তোলাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, এবার নাহয় নারীদের ন্যায্য লড়াইয়ে পাশে দাঁড়ানোটাই সংস্কৃতি হোক।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]