November 2, 2024
মুক্তমত

কানের ‘স্টপ রেপিং আস’ বনাম নরসিংদীর ‘বেপর্দা নারী’

সাদিয়া মেহজাবিন ।। যখন রাস্তায় চলাফেরা করি, নিজের অবচেতন মনে সচেতন থাকতে হয় কখন কী হয়ে যাচ্ছে ভেবে। ধরুন, বাসে যাতায়াত করছেন। আপনি নিশ্চিত সতর্ক থাকছেন কে কোথায় সুযোগে বিকৃত যৌন আচরণ করে বসলো! কিন্তু আমি এইসব অসুস্থ লোকদের থেকেও বেশি ভয় পাই বাসে বসে থাকা অসুস্থ পুরুষতান্ত্রিক মস্তিষ্কের নারীদের।

একটি অভিজ্ঞতা বলি। বাসে মহিলা সিট নামক একটি অদ্ভুত আসনের ব্যবস্থা আছে, যা ঠিক দরজা দিয়ে উঠতেই হাতের বা পাশে। পুরো বাসে পুরুষদের জায়গা করে দিয়ে এই ক্ষুদ্র আসন নিয়েই যত প্যারা সহ্য করতে হয়। যেহেতু সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এখন নারীরাও কর্মসংস্থানে সে বাস যাত্রাই করেন। একত্রে বাসে থাকাকালীন একটু দাঁড়িয়ে যাওয়াতে আমার কোনো সমস্যা নেই। মূল সমস্যা হয়, বাসে নারীদের সিট অনেক সীমিত, তার উপরে দাঁড়িয়ে যাওয়ার সময় বিকৃত মনমানসিকতা সম্পন্ন পুরুষেরা তাদের যৌন অঙ্গ দিয়ে অহেতুক ঘষা-মাজা করে অথবা হাত বুকে লাগিয়ে নাহয় কনুই দিয়ে গুতো মেরে মজা পান। তারা এই কম সময়ে অর্গাজমের মত আনন্দ পান বলে আমার ধারণা হয়। কিন্তু একদা চার নাম্বার বাসে মহিলা সিট প্রায় ভর্তি; একজন বোরকা পরা আপু শেষে উঠেছেন এবং অনেক কষ্টে সিট এ বসে গরমে পুরো ক্লান্ত হয়ে খুব সম্ভবত রাতেই বাড়ি ফিরছিলেন। কিছুক্ষণ পর দেখলাম বাসে আরো লোক এসে এত ভর্তি হলো যে একজন লোক দাঁড়িয়ে প্রায় মহিলা সিটের উপর এসে উপচে পড়ছে। সে লোকটি অনেকক্ষণ ধরেই তার পুরো শরীর এলিয়ে দিয়ে বেশ সময় দিয়েই যৌন অঙ্গের মাধ্যমে আপুটাকে বিরক্ত করছেন। কিছুক্ষণ পরই আপু তা বুঝতে পেরেছেন এবং বেশ অস্বস্তি নিয়ে পিছনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছেন তবুও প্রতিবাদ করছেন না। আমি দেখেই লোকটার উপরে রেগে গেলাম এবং বেশ বকা দিয়ে বললাম যে, উনি এমন আচরণ কেন করছেন। লোকটা হুট করে এমন প্রতিবাদ দেখে খানিক ভীত ছিলেন। কিন্তু পরেই উনার সে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চরম সৃষ্টি অতি বোকা পুরুষতান্ত্রিক এক নারী সৈনিক রীতিমত আমার উপর রেগে গেলেন। সে বোকা মহিলাটা বেশ দূরেই বসে ছিলেন, ঘটনা না জেনেই রেগে গিয়ে বললেন, ‘আপনাদের বেডা নিয়ে এত সমস্যা হলে বাসে উঠলেন কেন? বাসে তো ধাক্কাধাক্কি হবেই। বেডা নিয়ে এত সমস্যা হলে রাতে বের হইছেন কেন? ঠিকই তো বেডা নিয়ে ঘুরতে যান।’

আমি মোটেও এসবের জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। কেননা প্রথমত তিনি জানেন না এই পাশে কী হয়েছে আর স্বয়ং নারী হয়ে উনার জানার কথা আমরা প্রায়শ এমন ঘটনার সম্মুখীন হই। তাছাড়া যাকে ব্লেম করছি তিনি উল্টো কথা বললেও মানতাম, কিন্তু উনার কথা বলার যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পেলাম না। কিছু কথা শুনিয়ে আপাতত চুপ হয়ে গেলাম। কিন্তু সে মহিলার একটি কথার সাথে একমত না হয়ে পারলাম না তা হলো ‘যার সাথে হইছে তার তো কোনো কথা নাই, আপনাদের মত বেহায়া বেপর্দা মেয়েদের নাকি সব সমস্যা!’

আসলেই তো! যার যার প্রতিবাদ তো তারই করার কথা, কেননা এই খারাপ অনুভূতি তো একান্ত তারই। আমার এক হাত শিক্ষা সেবার হয়েছে। আমি বরং পরে ভেবে যতদূর বুঝেছি, সে আপুটি এমন কিছুর শিকার হয়েও পুরুষতান্ত্রিক পুরুষের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করতো না, কেননা সে এই সমাজের পুরুষদের মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তুলেছে; বরং ভয় পাচ্ছিল লোকে তো তাকেই দোষী করবে। সত্যি তো! হয়েছেও তাই। মহিলাটার এভাবে তেড়ে এসে লোকটার পক্ষ নেওয়ার পিছনে অন্যতম কারণ, ‘বোরকা পরা মেয়েদের সাথে এমন হওয়ার কথা নয়, এসব কেবল বেপর্দা নারীদের সাথে হয়, হওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত পুরুষেরা বাসে আধ একটু এমন করবে, এ আর এমন কি!’

সে মহিলার মানসিক অবস্থা আমার বোধগম্য, কেননা, আজ বহুকাল ধরে পুরুষতান্ত্রিক যাতাকলে পিষে নিজের মস্তিষ্ক বলতে সব কিছুই পিষে গেছে। তার পক্ষে এর বাইরে চিন্তা করা সম্ভব ছিল না। তবুও আলোর যাত্রী অন্ধকারেই তাদের আলো ছড়ান। তাই পুরুষতান্ত্রিকতার বাইরে গিয়ে কেউ কেউ মানুষের মত নিজের ভাবনা তৈরি করেন।

এতসব ঘটনা মনে করার অন্যতম কারণ নরসিংদীতে হয়ে যাওয়া এই বিরাট ঘটনা। নিজের ইচ্ছাতে পোশাক পরার দায়ে একজন নারীই, ঘুরতে আসা একটি মেয়েকে হেনস্থা করেন এবং পরবর্তীতে তাতে যোগ দেন মূল হোতারা। এর দায়ে আসামীদেরকে পাকড়াও করা হয়েছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন এত সহজ সমাধান আমরা চেয়েছিলাম আদৌ? ঘটনাটা কি এতই সহজ ছিল বা জেলে পুরেই সমাধান হবে?

আসামি নারীটি মূলত একজন নন, একটি পুরুষতান্ত্রিক বিকৃত যৌনরুচিকর সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। সে নারীও সেই বাসের মহিলার মত চিন্তা করেন – বেপর্দা নারীদের সাথে এমন হওয়া জায়েজ। পুরুষেরা আসলে উত্তেজিত থাকবেই, এভাবেই তাদের সৃষ্টি। খাবার খোলা রাখলে মাছি আসবে। বেপর্দা নারীরাই পুরুষদেরকে উত্তেজিত করে সমাজের মহা ক্ষতি করে ফেলছে।

মূলত যাতাকলে পিষে যাওয়া সে নারীর থেকে এরচেয়ে বেশি আশা করা অন্যায়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেও কোনো না কোনো অন্যায়ের শিকার, বরং হাল ছেড়ে দিয়ে এখন নারীদেরকে দমন করে সমাজকে ‘‘ভালো পথে’’ আনতে ব্রতী হয়েছেন।

তাহলে এত কথার শেষ কথা কী? প্রতিবাদ হবে না? প্রয়োজন নেই? প্রতিবাদ হলেও কেমন হওয়া উচিত?

সদ্য চলমান কান উৎসবে একজন ইউক্রেনীয় নারী আচমকা তার সমস্ত কাপড় খুলে চিৎকার দিচ্ছে। তার উদাম বুক জুড়ে লেখা ‘stop raping us’; এবং যৌন পথে প্রতীকি রক্তপাত। একটু ভেবে দেখুন! ইউক্রেনের যুদ্ধ, এরমাঝে কানের মত উৎসবে একজন নারী এসে এভাবে প্রতিবাদ! আসলে প্রতিবাদ এভাবেই করতে হয়। পাগলেকেও  অসুস্থ মানুষ খুবলে খায়। কিন্তু সুশীল সমাজের লাল গালিচায় বৃদ্ধ্বাঙ্গুলি দিয়ে বলা হয়েছে রেইপ বন্ধ করুন। এই রেইপ কি কেবল শারীরিক? মানসিকও বটে। সারাক্ষণ পৃথিবীর প্রত্যেক প্রান্তে হয়ে  যাওয়া রেইপ! স্টপ রেপিং আস। তাই হয়তো আমার এই বাক্য বলতে একবারও লজ্জা হয়নি, পৃথিবীর প্রত্যেক নারী জানা-অজানায় নানাভাবে একবার হলেও এই অপ্রীতিকর ঘটনাগুলোর শিকার হয়েছেন; তা হোক শারীরিক কিংবা মানসিক।

দেখুন পটচিত্রটি কিন্তু ভাইস-ভার্সা। নরসিংদীতে দুজন মেয়ে একজন নারীর হাতেই হেনস্তা হয়েছেন এবং অন্যত্র কানে একজন নারীই প্রতিবাদের ধরণ শিখিয়ে গেলেন। আসলে পুরুষতান্ত্রিক চিত্রের এই যাতাকল থেকে যারা তাদের একটু মস্তিষ্কক বাঁচিয়ে রেখেছে তারাই কোনো না কোনো সময় গিয়ে প্রতিবাদের স্মারক হয়েছে।

তবুও প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে একটি প্রশ্ন না করলেই নয়। যারা হিজাব ইস মাই চয়েজ বলে এতকাল নেচেছেন এবং বাকিদেরকে উৎসাহ দিয়েছেন, তারা কোথায়? কেননা হিজাব যদি আমার চয়েস হয় তাহলে টিশার্ট, হাতকাটা জামা পরা এসব কার চয়েস? হিজাব ইজ মাই চয়েজের মূল হোতারা একটু সাবধান হোন। একদিন সত্য খুলে বেড়িয়ে পড়বেই।  আর এর মাঝে যারা ‘এইসব ক্ষেত্রে আমাদের প্রিয় নারীবাদী বন্ধুদের প্রতিবাদ’ না দেখতে পেয়ে মরে যাচ্ছেন তারা কান উৎসবে কান দিন, সাথে আরেকটু মনযোগী হোন।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *