প্রথম প্রজন্মের ‘প্রো-ফেমিনিজম’: আরব ও মুসলিম পুরুষের ভূমিকা
বাংলা ভাষার ব্লগার, সামাজিক – রাজনৈতিক বিশ্লেষক, এক সময়ের সক্রিয় বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার, যিনি স্বপ্ন দেখেন একটি লৈঙ্গিক সমতাভিত্তিক সংস্কৃতি ও সমাজের। নারীবাদ তাই তার চিন্তা, পড়াশোনা ও লেখালেখির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য তিনি ধারাবাহিকভাবে লিখছেন – ইসলামী নারীবাদ: মুসলিম পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিশ্বাসী মানুষের সংগ্রাম। আজ পড়ুন এর চতুর্থ পর্ব।।
ইসলাম ও নারী এই প্রসঙ্গে ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনার চত্বরে ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক পণ্ডিতদেরকে তিনটি বর্গে ভাগ করেছেন অনেকেই। এই শ্রেণিবিভাগ করেছেন ইসলামী ধর্মতাত্ত্বিক পণ্ডিতরাসহ আরও অনেকেই। ধরা যাক ইসলামী নারীবাদী ও নৃতাত্ত্বিক জেবা মীর হোসেইনীর মতে ইসলাম ও লৈঙ্গিক অধিকার প্রসঙ্গের আলোচনায় ইসলামী পণ্ডিতদের এই তিন বর্গের প্রথম বর্গ হচ্ছেন প্রথাগত সংরক্ষনবাদী (Conservative traditionalist) ইসলামী আলেমগন। এই দলের আলেমদের বোঝাপড়ার প্রধান উৎস হচ্ছে ইসলামের প্রথম দিকের নানান গ্রন্থাদি এবং এই বর্গের আলেমদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সেই সকল গ্রন্থের বোঝাপড়াকে স্থান-কাল ও প্রেক্ষিতের সংযুক্তি ছাড়াই আত্মস্থ করা ও ব্যবহার করা। এঁরা সাধারণত মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন না বা করতে চান না। ইসলামের প্রথম দিককার এই সকল গ্রন্থের বোঝাপড়াকে পরিবর্তিত সময়ের সাথে প্রেক্ষিতায়ন করতে চান না।
দ্বিতীয় ধারায় রয়েছেন ইসলামের বিশ্বাসের সাথে আধুনিকতাবাদ ও পার্থিবতাবাদের সমন্বয়ে আরও অধিক অন্তর্ভুক্তিমূলক বা ইনক্লুসিভ বিশ্বাস ব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষের পণ্ডিতেরা। এই ধারার পণ্ডিতেরা পশ্চিমা আধুনিকতাবাদের সমালোচনা করেন এর অন্তর্গত সঙ্কট নিয়ে আলোচনা করেন। একই সাথে এঁরা মনে করেন ইসলাম আধুনিক দুনিয়ার সাথে কোনোভাবেই সাংঘর্ষিক তো নয়ই বরং ইসলামের মূল চেতনা মানুষের মাঝে সাম্য ও কল্যাণের ভিত্তিতে একটি সমাজ গড়ে তোলা যা অনেক আধুনিক সমাজেরও লক্ষ্য। এঁরা আধুনিকতাবাদ, গণতন্ত্র, পার্থিবতাবাদসহ আধুনিক সময়ের আরও বহু বিষয়ে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ব্যাখ্যা ও অবস্থান হাজির করেছেন, সেই অর্থে এঁদেরকে অনেকেই আধুনিকতাবাদী বা Modernist হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
তৃতীয় ধারায় রয়েছেন উদারনৈতিক ও সংস্কারপন্থী (Liberal and reformist) ইসলামী পণ্ডিতেরা। এই ধারার পণ্ডিতেরা মনে করেন Text বা পাঠ্য, ‘পাঠ’ (reading) এবং পাঠজনিত ‘ভাষ্য’ (interpretation) পরিবর্তনশীল। ভাষ্য বা interpretation নির্ভর করে কে পড়ছেন তার নিজের প্রস্তুতি ও তার চারপাশের আবহের উপরে। অর্থাৎ এঁরা মনে করেন সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা আর ইসলামের পবিত্র গ্রন্থের পাঠ ও পাঠজনিত বোধ, ভাষ্য এক কথা নয়। স্রষ্টার ইচ্ছা কেবল সৃষ্টিকর্তা নিজেই জানেন, মানুষের পক্ষে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাকে সম্পূর্ণ বোঝা, তার অনুবাদ করা সম্ভব নয়। ইসলামের মূল চেতনাকে ব্যাখ্যা করার জন্যে তাই কেবলমাত্র পাঠজনিত ভাষ্য বা প্রচলিত অর্থে ‘তাফসীর’ যথেষ্ট নয়। কেননা তাফসীর হচ্ছে পার্থিব মনুষ্য বয়ান, যার ভিত্তি হচ্ছে ব্যক্তির পাঠজনিত বোধ ও ভাষ্য।এই ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের মতে ‘তাফসীর’ কখনোই সৃষ্টিকর্তার ভাষ্য বা ইচ্ছা নয়, তা কেবলই মনুষ্য অবনুধাবন এবং সকল অর্থেই তা সীমাবদ্ধ।
শুরু থেকেই ইসলামী নারীবাদের প্রায় সকল বোঝাপড়া গড়ে উঠেছে এই তিন শ্রেণির বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধারার নানান বয়ানের উপরে। বলাই বাহুল্য যে ইসলামী নারীবাদীদের যে সকল বয়ান হাজির রয়েছে আমাদের সামনে তাদের বেশীরভাগেরই বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিপক্ষ হচ্ছে ইসলামেরই উপরে উল্লেখিত প্রথম ধারার বুদ্ধিবৃত্তিক বয়ানসমূহ। সে কারণেই ইসলামী নারীবাদের পরের আলোচনায় যাবার আগে উনিশ ও বিংশ শতকের এই সকল আধুনিকতাবাদী ও সংস্কারপন্থী (Modernist and reformist) ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কয়েকটি মূল আলাপ সম্পর্কে খানিকটা জানা জরুরি।
এই আলোচনাকে এগিয়ে নেয়ার জন্যে ইউরোপ ও পশ্চিমের নারীবাদী চিন্তার বিকাশের ইতিহাসের সাথে একটি সমান্তরাল তুলনা হাজির করা যেতে পারে। ব্রিটিশ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিলের জন্ম হয়েছিল ১৮০৬ সালে। এর তিন বছর পরে অর্থাৎ ১৮০৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেন পার্কার পিলসব্যারী, দাসপ্রথা বিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা ফ্রেডরিক ডগলাস জন্মেছিলেন ১৮১৭ সালে।এই অধ্যায়ে এঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত আলাপ করা হবে না, বরং এঁদেরকে উসিলা করে আরব ও পারস্যের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের এক বিশেষ আধুনিকতাবাদী ও মুক্তিমূখীন রূপান্তরকামী কয়েকজন উল্লেখযোগ্য এক্টিভিস্ট বা সক্রিয়তাবাদীর সম্পর্কে আলাপ হাজির করবো। ধর্ম পরিচয়ে এঁরা মুসলিম ও খ্রিষ্টান কিন্তু এঁদের সবারই উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল আরব ও পারস্য ভূখণ্ডে নারীর অধিকারের প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে। মিল, পিলসব্যারী কিংবা ডগলাস এঁরা সকলেই নানান ধরনের রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন কিন্তু পশ্চিমা নারীবাদী আন্দোলন ও নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামের সাথে এঁদের সংযুক্তি এঁদেরকে ঐতিহাসিক খ্যাতি এনে দিয়েছিল। পশ্চিমের নারীবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে তাই এঁদের নাম উল্লেখযোগ্যভাবে লেখা হয়েছে। তুলনাটি আপাতভাবে খুব যথাযথ মনে নাও হতে পারে কিন্তু ঐতিহাসিক বাস্তবতায় এটা সত্য যে – ঠিক একই সময়কালে মুসলিম অধ্যুষিত ভূখণ্ডগুলোতেও একদল পুরুষ ইসলামী স্কলার বা বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষ জন্মেছিলেন যাদের সংস্কারবাদী ভূমিকা আরব অঞ্চলে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে এসেছিল। তবে এই সকল ইসলামী বুদ্ধিজীবীদের সংগ্রামটি মিল কিংবা পিলসব্যারীর মতো রাজনৈতিক-আইনি লড়াই ছিল না বরং এঁদের লড়াই সংগ্রাম ছিল আরও জটিল; কেননা রাজনৈতিক বা আইনি লড়াইয়ের প্রেক্ষিত তৈরির আগে এঁদেরকে লড়াই করতে হয়েছে নিজেদেরই সগোত্রীয় ইসলামী আলেমদের বিরুদ্ধে, শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে, ইসলামী ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে। এঁদের সংগ্রামকে বরং ফ্রেডরিক ডগলাসের সংগ্রামের সাথে তুলনা করা যায়, যিনি একই সাথে দাসপ্রথা বিরোধী আন্দোলনে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, আবার পাশাপাশি নারী অধিকারের সংগ্রামীদের সাথে সেনেকা ফলস সম্মেলনের মিছিলে হেঁটেছেন। অর্থাৎ ইসলামের অনুসারী এই সকল রূপান্তরকামী পণ্ডিতেরা যেমন একদিকে ইসলামের অনুশীলনের ও চর্চার নানান গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন তেমনি লৈঙ্গিক পরিচয়ে পুরুষ হলেও নারীর স্বাধিকারের প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে এনেছিলেন মোল্লাতন্ত্রের রক্তচোখকে উপেক্ষা করে।
এমনটি নয় যে এই সকল আরব ও পারস্যের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক সক্রিয়তাবাদী পুরুষেরা খুব সরাসরি, খুব গুছিয়ে নারীমুক্তির প্রশ্নটি তুলেছিলেন। না, তা নয়। বরং এই সকল ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষেরা ইসলামী আইন বা ‘শরীয়াহ’র নানান দিক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন যা অবধারিতভাবেই ইসলামী সমাজে নারীর অবস্থানের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছিল। এঁরা প্রশ্ন তুলেছেন কুরআন ও সুন্নাহ’র ভাষ্য বা interpretation বিষয়ে। এঁরা দাবি তুলেছিলেন কুরআন ও সুন্নাহ’র উপরে ভিত্তি করে সমকালীন ভাষ্য (Contemporary interpretation) তৈরি করার। এঁদের সকলেই বিশ্বাসী মানুষ ছিলেন শুধু তাই নয়, এঁরা ইসলামী বোধকে কেন্দ্র করে সমাজ ও জনজীবনের জন্যে নতুন বয়ান তৈরি করার জন্যে অজস্র লেখালেখি করেছেন। সেখানে ধর্ম ও জাতীয়তার মোকাবিলা কিভাবে হবে থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনা ও সমাজের আরও বেশ কিছু মৌলিক প্রশ্নে বড়সড় আলাপগুলো উত্থাপন করেছিলেন।
ইতিহাসের ঠিক যে সময়টিতে জন স্টুয়ার্ট মিল বা ফ্রেডরিক ডগলাস এর মতো রাজনৈতিক চিন্তক ও সক্রিয়তাবাদীরা হাজির হয়েছেন পশ্চিমের রাজনৈতিক চিন্তার জগতে, ঠিক একই সময়ে আরব পারস্যের রাজনৈতিক চিন্তার জগতে হাজির হচ্ছেন বেশ কয়েকজন চিন্তক যাদের চিন্তা পরবর্তীতে ও ইসলামী সমাজগুলোতে লৈঙ্গিক সমতার প্রশ্নটি নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে, আলোচনা করার প্রেক্ষিত তৈরি করেছিল। প্রথম প্রজন্মের এই বুদ্ধিজীবীরা দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বিস্তার করেছিলেন পরবর্তী বেশ কয়েক প্রজন্মের ইসলামী চিন্তকদের। এই আধুনিকতাবাদী ও সংস্কারবাদী (Modernist and reformist) ইসলামি তাত্ত্বিকদের অন্তত তিনটি সময় পর্ব বা তিন প্রজন্মের বুদ্ধিজীবীদের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে ইসলামী নারীবাদের আলোচনার প্রসঙ্গে।
প্রথম প্রজন্মের ইসলামী বুদ্ধিজীবীদের সময়কাল ছিলো আঠারোশ শতকের একেবারে শেষ সময় থেকে উনিশ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত। এই পর্বে উল্লেখ করা যেতে পারে প্রথম প্রজন্মের আধুনিকতাবাদী লেবাননের আহমাদ ফারিস আল সিদিয়াক (১৮০১ – ১৮৮৭), মিশরের রিফাহ রাফি আল তাতাওই (১৮০১ – ১৮৭৩), তিউনিসিয়ার খাঁয়ের আল দ্বীন (১৮২০ – ১৮৯০), লেবাননের খ্রিষ্টান পাদ্রী বুট্রাস আল বোস্তানী (১৮১৯- 1883) ও আরও কয়েকজনের নাম। দ্বিতীয় প্রজন্মের সংস্কারবাদী বুদ্ধিজীবীদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন আফগান তুর্কী বুদ্ধিজীবী জামাল – আল দ্বীন (১৮৩৮ – ১৮৯৭), মিশরের ধর্মীয় নেতা ও ইসলামী তাত্ত্বিক মুহাম্মদ আব্দুহু (১৮৪৯ – ১৯০৫), মিশরের আইনবিদ কাশিম আমিন (1863 – 1908), মিশরের ধর্মতাত্ত্বিক নেতা রাশিদ রিদা (১৮৬৫ – ১৯৩৫), আফগানিস্তানের মাহমুদ তারজি (১৮৬৫ – ১৯৩৩)। আর তৃতীয় পর্যায়ের আধুনিকতাবাদী ও সংস্কারবাদী ইসলামী চিন্তকদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত অধ্যাপক ফজলুর রহমান (১৯১৯ – ১৯৮৮), ইরানের ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক আব্দুল করিম সোরৌশ (১৯৪৫ – ), এঁদের কাজ ও লেখালেখি পরের প্রজন্মের ইসলামী নারীবাদী চিন্তা ও সংগ্রামের উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। এই তালিকাটি কোনো অর্থেই সম্পূর্ণ নয়, এই তালিকাটি সম্পূর্ণ হওয়া সম্ভবও নয়। ইসলামের ইতিহাসের এই চিন্তকদের চিন্তা ও তৎপরতা নানানভাবেই গত দুই শতকের ইসলামী সমাজগুলোতে নারীর সংগ্রামের তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। নিশ্চিতভাবেই এমনটা নয় যে এঁরা সকলেই সরাসরি নারীবাদী তত্ত্ব রচনায় ভূমিকা রেখেছিলেন, বরং এঁদের উত্থাপন করা নানান সংস্কারবাদী প্রস্তাবনাকে পরবর্তীতে বিশ্বাসী নারীবাদীরা ব্যবহার করেছেন।
এই সকল আধুনিকতাবাদী ও সংস্কারপন্থী ইসলামী চিন্তকদের সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনার আগে বলে নেয়া ভালো এঁদের অনেকেরই জন্মসাল সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন উৎসের তথ্যের মাঝে তফাত রয়েছে। এঁদের কেউ কেউ শুরু থেকেই মুসলিম ছিলেন না, বরং পরবর্তী জীবনে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছেন এবং এঁদের অন্তত একজন উল্লেখযোগ্য চিন্তক বুট্রাস আল বোস্তানী ছিলেন একজন প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান এবং তিনি নিজেও জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে খ্রিস্ট ধর্মের মাঝেই নিজেকে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদে দীক্ষিত করেছেন। এই সাধারণ বিষয়গুলো এঁদের চিন্তাকে জানার জন্যে গৌণ হলেও এই বিষয়গুলো জানা থাকা দরকার।
তবে এই সকল চিন্তকদের সম্পর্কে একটি আপাত কাকতালীয় কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা থাকা দরকার, তা হচ্ছে এঁদের প্রায় সকলেই জীবনের কোনো একটি অংশ ইউরোপে বসবাস করেছেন। এঁদের চিন্তাভাবনার উপরে ইউরোপে বসবাসপর্ব ঠিক কেমন বা কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল সেটা হয়তো খুব শক্তভাবে বলা কঠিন, কিন্তু ইউরোপের নানান বিষয় এঁদের লেখালেখির উপাদান হিসাবে হাজির হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।
লেবাননের আহমাদ ফারিস আল সিদিয়াক (১৮০১ – ১৮৮৭) প্রথম জীবনে ছিলেন মেরোনাইট খ্রিষ্টান, পরে তিনি ধর্মান্তরিত হন প্রোটেস্টান্ট খ্রিষ্টান হিসাবে এবং আরও পরে তিনি ধর্মান্তরিত হন মুসলিম হিসাবে। আহমাদ ফারিস আল সিদিয়াকের জীবনকাল কেটেছিল অটোমান শাসিত লেবাননে। যদিও তখন অটোমান সাম্রাজ্য প্রায় ক্ষয়িষ্ণু কিন্তু তখনও লেবানন ফরাসী উপনিবেশ হয়ে ওঠেনি।আনুষ্ঠানিকভাবে লেবানন ফরাসী উপনিবেশ হয়ে ওঠে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে, মূলত ১৯২০ সালের পর থেকে। সুতরাং ঐতিহাসিক সময়কালের বিচারে আহমাদ সিদিয়াক ঔপনিবেশিক ফরাসী শাসনকে প্রত্যক্ষ করেন নি। বরং তিনি নিজেই তাঁর পেশাদার জীবনের একটা বড় অংশ বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে কাটিয়েছেন এবং সেখানকার সমাজব্যবস্থা নিয়ে লিখেছেন। আহমাদ সিদিয়াক ফরাসী নারীদের জীবন পর্যবেক্ষণ করে বিস্মিত হয়েছিলেন ঘরে ও বাইরে উভয় স্থানে ফরাসী নারীদের সক্রিয়তার মাত্রায়। তিনি ফরাসী নারীদের পোশাক সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করলেও সমাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণকে সদর্থকভাবে দেখেছেন এবং মতামত প্রকাশ করেছিলেন যে ইসলামী সমাজব্যবস্থাতেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি জরুরি এবং প্রয়োজনীয়।
নারী অধিকারের সপক্ষের সক্রিয়তাবাদী হিসাবে সেই সকল পুরুষ রাজনীতিবিদদের মাঝে বুট্রাস আল বোস্তানী সম্ভবত সবচাইতে উল্লেখযোগ্য নাম হিসাবে উল্লেখিত হবে। বুট্রাস আল বোস্তানী জন স্টুয়ারট মিলের একযুগ পরে জন্মেছিলেন, ১৮১৯ সালে অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক দুশো বছর আগে।
বুট্রাস বুস্তানী তাঁর বহুমাত্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার জন্যে আরব ভূখণ্ডে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, প্রকাশক এবং অনুবাদক। আরব ভূখণ্ডের অব্যাহত অসম সমাজ কাঠামোর বিরুদ্ধে তিনি সবসময় লিখেছেন। তিনিই ব্যক্তিগত ধর্ম বিশ্বাসের দিক থেকে মুসলিম ছিলেন না। তিনি মেরোনাইট গোত্রের খ্রিষ্টান ছিলেন, পরবর্তীতে প্রোটেস্টান খ্রিষ্টান হিসাবে দীক্ষিত হন। অর্থাৎ সেই অর্থে তিনি ছিলেন ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান। ইসলামী নারীবাদের আলোচনায় আল বোস্তানী প্রাসঙ্গিক এই কারণে যে মোটের উপরে তাঁর সক্রিয়তাবাদীতা সেই সময়ের আরব নারীবাদের মাঝে এক ধরনের সচেতনতা তৈরি করেছিল যা পরবর্তীকালে লেবানন, সিরিয়া ও পারস্য অঞ্চলের নারীবাদীদের নিজেদের জন্যে সমতা ও ইনসাফের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আরব পুরুষ হিসাবে তিনি একজন উল্লেখযোগ্য মানুষ যিনি প্রথম থেকেই সাংস্কৃতিকভাবে আরব পিতৃতন্ত্রকে প্রশ্ন করেছেন, আরব জনগণ, বিশেষত আরব নারীর পিছিয়ে থাকা নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনার সূত্রপাত করেছেন। এই শতকের মাঝামাঝি সময়ে আল বোস্তানী একজন গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষ হয়ে ওঠেন তাঁর বর্ণিল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জন্যে। একই সাথে লেখক, অনুবাদক, সাংবাদিক, শিক্ষক ও রাজনৈতিক সক্রিয়তয়াবাদী হিসাবে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন।
নারী প্রসঙ্গে আল বোস্তানীর অবস্থানকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার মূলে রয়েছে আরব নারীর শিক্ষা নিয়ে তাঁর একটি বিখ্যাত বক্তৃতা এবং পরবর্তীকালে আরব নারীর শিক্ষা নিয়ে তাঁর নানান সক্রিয়তাবাদী তৎপরতা। তিনি খুব সরাসরি আরব পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে না দাঁড়ালেও খুব জোরালো যুক্তিতর্ক হাজির করেছিলেন নারীর শিক্ষা ও তার ফলে নারীর সামাজিক অর্জন প্রসঙ্গে। শুধুমাত্র নারীর শিক্ষা প্রসঙ্গে নয়, তাঁর লেখালেখির একটি প্রধান দিক ছিল প্রাচ্যের সমাজগুলোর পিছিয়ে পড়ার কারণ বিশ্লেষণ নিয়ে। আরব সমাজের এই পিছিয়ে পড়ার জন্যে শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে পড়াকেই একটি প্রধান কারণ হিসাবে হাজির করেছিলেন তিনি। তাঁর সময়ে সিরিয়া ও লেবাননের ভয়ংকর সম্প্রদায়গত হানাহানি ও গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষিতে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ঠিক কী কারণে একটি দেশের জনগণ, যারা একই উৎসের পানি পান করেন, একই বাতাস নিঃশ্বাস হিসাবে গ্রহণ করেন, একই ভূমি কর্ষণ করে ফসল উৎপাদন করেন, আবার তারাই নিজেদের মাঝে দীর্ঘমেয়াদী হানাহানিতে লিপ্ত হতে পারে? শিক্ষাদীক্ষায় আরব সমাজের এই পিছিয়ে পড়ার পেছনে নারীশিক্ষার অনুপস্থিতি একটি প্রধান কারণ হিসাবে তিনি উল্লেখ করেছিলেন। নারী শিক্ষা নিয়ে ১৮৪৯ সালের চৌদ্দ ডিসেম্বরের “তা’লিম আন-নিসা” শিরোনামের বক্তৃতাটি খ্রিষ্টান ও মুসলিম উভয় ধর্মীয় সমাজের নারীদের মাঝে ব্যাপক সাড়া তৈরি করে। তিনি তুলনামূলকভাবেই বিশ্লেষণ করেন যে খ্রিষ্টান নারীদের ‘অবরুদ্ধ’ অবস্থা মুসলিম নারীদের চাইতে খানিকটা কম হলেও শিক্ষা দীক্ষায় উভয়ের পশ্চাদপদতা প্রায় একই রকমের।
নারীর সমানাধিকারের পক্ষে আল বুস্তানী’র তৎপরতা কতটা তার ‘ব্যক্তিগত নারীবাদী’ অবস্থান থেকে আর কতটা মোটের উপর আরব আধুনিকতাবাদের সমর্থক হিসাবে ছিল তা নিয়ে গবেষকদের মাঝে বিতর্ক রয়েছে। গবেষকদের কেউ কেউ মনে করেন নারীর সমানাধিকারের প্রশ্নে আল বুস্তানীর উপরে আমেরিকান খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রভাব খুব সুস্পষ্ট ছিল। তবে সেই প্রভাব খ্রিষ্টান রিপাবলিকানদের মতো ছিল না যারা নারীর শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হিসাবে দেখতেন ‘শিক্ষিত মা’ হিসাবে নারীর ভূমিকাকে, বরং বুস্তানী মনে করতেন শিক্ষিত নারী মানেই অধিকার সচেতন আর অধিকার সচেতন নাগরিক মোটের উপরে সমাজের কল্যাণকর রূপান্তরে ভূমিকা রাখতে পারেন। সেই অর্থে আরব সমাজের যে চরম পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো, সেই কাঠামোতে গুনগত পরিবর্তন আনার জন্যেই নারীর শিক্ষার কোনও বিকল্প দেখেননি তিনি। সিরিয়া, মিশর, তিউনিসিয়া ও অন্যান্য আরব সমাজে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে একদল শিক্ষিত পুরুষ রাজনৈতিক সক্রিয়তাবাদী যাদের পরবর্তীকালে নারীবাদের সমর্থক বা ‘Pro-feminist’ বলে উল্লেখ করেছেন কেউ কেউ। এমন কয়েকজন বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষের দ্বারাও ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত ছিলেন আল বুস্তানী। লেবাননের আহমাদ ফারিস আল সিদিয়াক (১৮০১ – ১৮৮৭) কিংবা মিশরের রিফাহ রাফি আল তাতাওই (১৮০১ – ১৮৭৩) ছিলেন এই ধরনের নারীবাদী সমর্থক বা Pro-feminist।
রিফা তাতাওই ছিলেন আল আজহার পড়ুয়া মেধাবী ইসলামী স্কলার। আহমাদ সিদিয়াক কিংবা রিফা তাতাওই’র মতো মুসলিম বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষেরা মূলত আধুনিকতাবাদী ছিলেন। শহুরে পড়াশুনায় শিক্ষিত এই ইসলামী বুদ্ধিজীবীরা মনে করতেন গোত্রভিত্তিক আরব সমাজের শহুরে রূপান্তর আরব সমাজের ‘তমুদ্দন’ বা নাগরিক সভ্য হয়ে ওঠার জন্যে জরুরি। এই দলের বুদ্ধিজীবীরা আধুনিকতাবাদের সমর্থক হলেও, ছিলেন পশ্চিমের আধুনিকতার ধারণার কট্টর সমালোচক। আধুনিকতার নামে পশ্চিমের অনুকরণের ঘোরবিরোধী ছিলেন তাঁরা। তাদের প্রস্তাবনা ছিল – আরব আধুনিকতা হবে আরব সমাজ ও সংস্কৃতির নানান প্রেক্ষিতকে সাথে নিয়েই, বাদ দিয়ে নয়। আরব সমাজের পিছিয়ে থাকার একটি অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে এঁরা চিহ্নিত করেছিলেন নারীর পিছিয়ে থাকাকে। সামগ্রিকভাবে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে নারীর অগ্রসরমানতাকে আবশ্যকীয় হিসাবে দেখেছেন এঁরা। আল বুস্তানীর উপরে আহমাদ সিদিয়াক ও রিফা তাতাওই’র মতো বুদ্ধিজীবীদের প্রভাব তাঁকে নারী শিক্ষার বিষয়ে একজন তৎপর সক্রিয়তাবাদী হিসাবে ভূমিকা রাখতে উদ্বুদ্ধ করে। জুরীহ নিকলা বাজ (১৮৮১ – ১৯৫৯) তার গবেষণার একটা বড়ো অংশই ব্যয় করেছেন আরব নারীবাদের সমর্থক বা ‘Pro-feminist’ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে। আল বুস্তানী প্রসঙ্গে তার গবেষণায় তিনি উল্লেখ করেছেন – আল বুস্তানীর নারী শিক্ষার প্রচারক হিসাবে গড়ে ওঠার পেছনে তার মাতা’র ভূমিকা উল্লেখযোগ্য এবং পরবর্তীকালে আরও অনেকেই লিখেছেন নারীর সমানাধিকার প্রশ্নে আল বুস্তানীর বোঝাপড়া গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তাঁর স্ত্রী সারাহ’র ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। অর্থাৎ সব মিলিয়ে আমেরিকান মিশনারি পাদ্রীদের প্রভাব, সিরিয়া ও মিশরের ইসলামী আলেমগণের প্রভাব এবং পরিবারে মা ও স্ত্রীর প্রভাবে আল বুস্তানী হয়ে ওঠেন নারী মুক্তির একজন সক্রিয় প্রচারক।
ইসলামের স্বর্ণযুগ থেকে শুরু করে প্রাক আধুনিক ও আধুনিক যুগে নানান সময়ে ইসলামী আলেম ও বুদ্ধিবৃত্তিক পণ্ডিতেরা প্রভাবিত হয়েছেন ভিন্ন ধর্মের এবং ভিন্ন সমাজের বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা। ইসলামী স্বর্ণযুগের খ্রিষ্টান ও ইহুদী অনুবাদকদের দ্বারা প্রভাবিত হবার কথা আমরা জানি, বায়তুল হিকমাহ’র অনুবাদযজ্ঞে খ্রিষ্টান ও ইহুদী পণ্ডিতদের ভূমিকার কথা ইতিহাস থেকে জানা যায়। ঠিক একইভাবে আঠারোশ’ ও উনিশ শতকের আরব পণ্ডিতদের মাঝে পশ্চিমের প্রভাব স্পষ্ট হতে শুরু করে। আবার উল্টোটাও ঘটেছে সমগ্র ইতিহাস জুড়ে। ইসলামী আলেমগণ প্রভাবিত করেছেন খ্রিষ্টান, ইহুদী এমন কি ভারতীয় উপমহাদেশের স্থানীয় বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষদের। ইসলামের ইতিহাসে এই আদান প্রদান ঘটেছে প্রায় সর্বত্রই। আহমাদ সিদিয়াক এবং রিফা আল তাতাওই’র উপরে ফরাসী প্রভাব সুপষ্ট। দুজনেই জীবনের একটি সংক্ষিপ্ত অংশ কাটিয়েছেন প্যারিসে। দুজনেই বিস্তারিত লিখেছেন ফরাসী জীবন, রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে এবং প্রশ্ন তুলেছেন আরব সমাজ, বিশেষত মুসলিম সমাজ কিভাবে ফরাসীদের কাছ থেকে কিছু কিছু বিষয় শিখতে পারে। আল বুস্তানী’র উপরে আমেরিকান মিশনারিদের প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। আহমাদ সিদিয়াক, রিফা তাতাওই, খায়ির আল দ্বীন কিংবা আল বুস্তানীর মত একদল আধুনিকতাবাদী আরব বুদ্ধিজীবী’র কাছে একটি প্রধান প্রশ্ন হয়ে উঠেছিল আরব সমাজ কিভাবে নিজ নিজ ধর্ম বিশ্বাস অটুট রেখে আধুনিক হয়ে উঠতে পারে। এই বুদ্ধিজীবীরা এঁদের প্রত্যেকের লেখালেখির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় করেছেন আরব সমাজের কল্যাণ ও সমতাভিত্তিক রূপান্তরে ইউরোপের কাছ থেকে শেখার প্রসঙ্গ নিয়ে। এঁদের কেউই প্রথাগত অর্থে সেকুলার সমাজের কথা ভাবেন নি, বরং এঁরা সকলেই ভেবেছেন, প্রস্তাবনা হাজির করেছেন মুসলিম বা খ্রিষ্টান হিসাবে নিজেদের বিশ্বাস অটুট রেখেও সমাজের কল্যাণকর রূপান্তর অর্জন করা যায় সেই প্রসঙ্গে। সমাজের কল্যাণকর রূপান্তরের প্রশ্নেই নারী পুরুষের সমতার বিষয়টিকে তাঁরা আলোচনা করেছেন। ইউরোপের নারীর পোশাকরীতিকে তাঁরা স্বাগত জানাননি কিন্তু কর্মক্ষেত্রে ইউরোপের নারীর অংশগ্রহণের প্রশ্নটিকে তাঁরা স্বাগত জানিয়েছেন। ইউরোপের কাছ থেকে শেখার ক্ষেত্রে এই ঘরানার পণ্ডিতদের প্রধান যুক্তিটি ছিল – আজকের ইউরোপ অকপটে শিখেছে মধ্যযুগের ইসলামী সমাজগুলোর কাছ থেকে। ইসলামী স্বর্ণযুগের যা কিছু অর্জন তাঁর একটা বড়ো অংশ থেকেই ইউরোপ শিক্ষা গ্রহণ করেছে, ইসলামী সমাজ যেখানে থেমে গেছে, স্থবির হয়ে গেছে সেখান থেকেই ইউরোপ শুরু করেছে। অর্থাৎ ইউরোপ যদি আরব ও পারস্যের মুসলিম প্রধান সমাজের কাছ থেকে শিখতে কোনও দ্বিধা না করে থাকে তাহলে উনিশ শতকের আরব তথা মুসলিম অধ্যুষিত সমাজেরও কোনও দ্বিধা থাকা উচিত নয় আধুনিকতাবাদী ইউরোপের কাছ থেকে শেখার বেলায়।
ইউরোপের কাছ থেকে শেখার প্রশ্নে এই সকল আরব বুদ্ধিজীবীদের অবস্থানকে অনেকেই হয়তো ঔপনিবেশক আচ্ছন্নতা হিসাবে দেখতে চাইবেন, কিন্তু বাস্তবতায় এঁদের প্রায় সকলেই ছিলেন এক ধরনের জাতীয়তাবাদী। আরব অঞ্চলগুলোতে মুসলিম ও খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর মাঝে চলমান দ্বন্দ্ব সংঘাতের একটি সমাধান হিসাবে এঁরা জাতীয়তাবাদকে হাজির করেছিলেন। আরবি শব্দ ‘ওয়াতান’ এর অর্থ জাতীয় বা বৃহত্তর সমাজ। ধর্মীয় হানাহানি থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে রিফা তাতাওই হাজির করেছিলেন ‘মিশরীয়’ ধারনার আর বুস্তানী হাজির করেছিলেন ‘সিরিয়ান আরব’ ধারণার। অর্থাৎ জনগণ যখন নিজের ধর্মীয় পরিচয়ের উপরে নিজেদের ‘ওয়াতান’ বা জাতীয়তার পরিচয়কে ভাবতে শিখবে ধর্মীয় বিদ্বেষ হানাহানি ততটাই নিরপেক্ষ হয়ে উঠবে। আল বুস্তানী ১৮৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত করেন তাঁর নিজের স্কুল – ‘ আল মাদ্রাসা আল ওয়াতানিয়া’ যে স্কুলে শিক্ষার ধারণার সাথে ধর্মীয় পরিচয়ের চাইতেও অনেক বেশী ছিল ‘আরব’ জাতিগত প্রভাব। আজকে যেমন মাদ্রাসা বলতেই আমরা ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বুঝি, মাত্র দুশো বছর আগেও বিষয়টি তেমন ছিল না।
সরাসরি নারীবাদী না হয়েও সমাজের কল্যাণকর রূপান্তরের প্রশ্নে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের বিষয়টিকে হাজির করেছিলেন এই সকল আরব বুদ্ধিজীবীগণ। পরবর্তীতে এঁদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন আরও অনেক পুরুষ ও নারী আরব বুদ্ধিজীবী যারা আরও সক্রিয়ভাবে নারী পুরুষের সমানাধিকারের প্রশ্নে ইসলামী আইনের সংস্কার দাবি করেছিলেন। লৈঙ্গিক পরিচয়ে পুরুষ এই আরব বুদ্ধিজীবীদেরকেই বলা হচ্ছে ‘প্রো-ফেমিনিস্ট’ আরব বুদ্ধিজীবী। আর এরা রাজনৈতিক সক্রিয়তায় জাতীয়তাবাদী হলেও সাংস্কৃতিকভাবে ছিলেন প্রবল ইসলামী ও আরব, কিন্তু এই সকল প্রভাবকে ছাড়িয়ে এরা নারীপ্রশ্নে অবলীলায় ইউরোপের কাছ থেকে শিখতে চেয়েছেন। সেই অর্থে ইসলামী নারীবাদের ইতিহাসের সাথে নিশ্চিত ভাবেই ইউরোপীয় নারী সচেতনতার প্রভাব খুঁজে পাওয়া যাবে। ইসলামী নারীবাদের উৎসবিন্দুর সাথে জড়িয়ে আছে ইউরোপের সমাজ প্রগতির ধারণা ও ইউরোপীয় নারীদের সংগ্রামের ইতিহাস।
ইসলামী নারীবাদের ইতিহাস তাই একই ভাবে কৃতজ্ঞ এই সকল আরব ‘প্রো-ফেমিনিস্ট’ পুরুষদের কাছে আর তাদের উপরে প্রভাব সৃষ্টি করা ইউরোপের সেই সময়ের নারীসচেতনতার রাজনৈতিক সংগ্রামের কাছে।
[চলবে]