November 21, 2024
কলাম

সংসার ভাঙ্গার দায় কি কেবল নারীর?

আঞ্জুমান রোজী ।। একটা কথা খুবই প্রচলিত যে, ‘একটা মেয়ের সংসার আরেকটা মেয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে।’ যে মেয়েটা আরেকটা মেয়ের সংসার ভেঙ্গে দিচ্ছে বলে মনে করা হয়, তাকে লোভী, ঘৃণ্য কূটকৌশলী, ছলচাতুরী, এমন আরো অনেক নোংরা গালিগালাজ করে নেতিবাচক অর্থে তুলে ধরা হয়। নারীটাকে একতরফা এতোটাই খারাপ ভাবা হয় যে, পাশাপাশি সম্পর্কে জড়ানো পুরুষটিকে একেবারে ফেরেস্তা বানিয়ে ছাড়ে। তার মানে সংসার ভাঙ্গার ক্ষেত্রে পুরুষের কোনো ভূমিকা নেই। সব নারীর কারণেই ঘটছে। সংসারে যে বিবাহিত নারীটি আছে তাকেও দায়ী করা হয় সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার জন্য, কারণ সেই স্ত্রীকে পুরুষ তার মনমতো পাচ্ছে না সেজন্য নারীটি খারাপ; তাই পুরুষ অন্য নারীতে আসক্ত হয়। আর যেই নারীতে আসক্ত হচ্ছে সেই নারীটিও খারাপ।  কারণ সে জেনেশুনে বুঝে পুরুষের দুর্বলতায় ডুব দিয়েছে। এতে এই নারীরও বিশাল দোষ। এমতাবস্থায় পুরুষটি থেকে যাচ্ছে নান্নামুন্না বাচ্চা অবস্থায় অর্থাৎ নিষ্পাপ এবং নিষ্কলঙ্ক।

সংসার ভেঙ্গে দেয়ার কাজ নারীপুরুষ উভয়েই করে। পুরুষও ছলেবলে কৌশলে এবং তীব্র আবেগঘন অনুভূতির ফাঁদে ফেলে অনেক নারীকে করায়ত্ত করে; তারা বিবাহিত হয়েও অন্য নারীতে মজে। এতে পুরুষের কোনো দোষ নেই। দোষটা হলো নারীর। যে নারীর প্রতি পুরুষটি আসক্ত হচ্ছে সেই নারীটি কেন তাকে প্রশ্রয় বা সুযোগ দিলো? নারীটি যদি পাত্তা না দিতো তাহলে বিরূপ পরিবেশ তৈরি হতো না। এই হলো, অধিকাংশ মানুষের মানসিকতা। তাছাড়া বদ্ধ ধারণাটা হলো, পুরুষের স্বভাবই এমন, তারা বিভিন্ন নারীতে গমন করবে, যেভাবেই হোক পছন্দের নারীটিকে বশ করে ফেলবে; এসব পুরুষের জন্য সহীহ্, এতে তাদের কোনো পাপ নেই। বিষয়টা যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার প্রতিফলন, তা অনেক নারীও বুঝতে পারে না। এই মানসিকতায় যুগ যুগ ধরে দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র-পরিবার চলছে।

অন্যায়, অবৈধ, অসামাজিক বলতে যা বুঝায় তা নারীপুরুষ যে-ই করুক না কেন, উভয়ের ক্ষেত্রেই তা সমানভাবে বিচার হবে। আইন তো আর নারীপুরুষ দেখে করেনি! আইন সবার জন্য সমান, এটাই আমরা বিশ্বাস করি। তাই পৃথিবী জুড়ে আলোড়িত হলিউড অভিনেতা জনি ডেপ এবং অভিনেত্রী অ্যাম্বার হার্ডের বিচারকার্যটি এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্পন্ন হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি সত্যের জয় হয়েছে। বিচার প্রক্রিয়ায় সত্য-মিথ্যা যাচাই-বাছাইয়ের ভিত্তিতে প্রমাণ সাপেক্ষে রায় ঘোষিত হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি, বিচারকার্য সম্পন্ন হওয়ার পর দুনিয়াব্যাপি মানুষ অ্যাম্বার হার্ডকে নির্মমভাবে কাদা ছুঁড়ছে। আমি অবশ্যই অ্যাম্বার হার্ডের মিথ্যাচারকে সমর্থন করছি না। যখন ওদের সম্পর্ক হয় তখন হৃদয়ঘটিত আবেগঘন মুহূর্তে দুজন দুজনার কাছে ধরা দেয় এবং শেষে সম্পর্ক স্থায়ী রূপ নেয়। কিন্তু স্থায়ী সম্পর্ক বেশিদিন গড়ায়নি তাদের ভেতরকার নানা জটিলতার কারণে। এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার৷ মানুষের জীবনে এমন অহরহ ঘটছে।  শেষপর্যন্ত জনি ডেপ এবং অ্যাম্বার হার্ডের বিষয়টা কোর্টকাছারি  পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু সম্পর্কের শুরুতে জনি ডেপ কি বাচ্চা ছেলে ছিলেন? একজন পঞ্চাশোর্ধ বিবাহিত পুরুষ, তার উপর  সন্তানের বাবা তিনি; বুদ্ধিদীপ্ত মেধাবী এবং মুভি জগতের জনপ্রিয় এমন পুরুষ আবেগের বশবর্তী হয়ে তার চেয়ে ঢের কমবয়সী এক নারীর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। এতে তার পরিবারের কি ক্ষতি হয়নি! এই ক্ষতির কারণেও অ্যাম্বার হার্ডকেই দায়ী করা হচ্ছে। কারণ বলা হচ্ছে, সে লোভে পড়ে ছলচাতুরী করে জনি ডেপকে হাত করেছে। এর সব কিছুই  সমাজে বৈধতা পাচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার জোরে।

সত্য যে ভালোবাসা নিয়ে কোনো যুক্তিতর্ক বা ভালোমন্দ বিচার করার ক্ষমতা কারোর নেই। প্রেম ঐশ্বরিক, প্রেম চিরন্তন এবং প্রেম একটি সত্য রূপ। এমন প্রেমের সম্পর্কে বৈধ অবৈধ বলে কিছুই থাকে না এবং এক্ষেত্রে কোনো পক্ষকেই দোষারোপ করা উচিৎ নয়। কারণ, আবেগের কাছে সবই অর্থহীন থাকে। তাই আইনও বিষয়টিকে প্রশ্রয় দেয়। কিন্তু সংসার যখন ভেঙ্গে যায় তখন দেখা যায় যত জটিলতা। আর সেই জটিলতার সমস্ত দায়ভার এসে পড়ে একটি নারীর উপর। নারীকে এসব ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দোষী সাব্যস্ত করে খারাপ বলে প্রতিপন্ন করছে, সেইসাথে পুরুষকে প্রকারান্তরে ভালো ভেবে সমর্থন করে যাচ্ছে। সেইসাথে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে আরো উসকে দিচ্ছে। এ কাজ শুধু পুরুষই করে না, অনেক নারীও এই পুরুষের কাতারে আছে।

সম্পর্কে জড়ানোটা নারীপুরুষ দুপক্ষের সমান সমর্থনে হয়। তাহলে সংসার ভাঙ্গার দায় শুধু নারীর ক্ষেত্রে বর্তায় কেন? পুরুষটাকে এতো নিষ্পাপ ভাবার তো কোনো সুযোগ নাই? তাহলে বাস্তবতা এমন কেন? পুরুষের স্বভাব হলো প্রকৃতিপ্রদত্ত, পুরুষের নিজেদের উপর নিজের কন্ট্রোল নেই, পুরুষেরা তো এমন করবেই; এই বুলশিট জাতীয় কথা বন্ধ করতে হবে। এসব কথা পুরুষেরাই প্রচার করেছে তাদের ভোগের সুবিধার্থে। যুগ যুগ ধরে আসছে বলে এসব ধারণা মানুষের মধ্যে মজ্জাগত হয়ে গেছে। এখন সময় এসেছে এই ধারণা উপড়ে ফেলার। কারণ, নারীরও প্রকৃতি প্রদত্ত স্বভাব আছে, যেমনটা আছে পুরুষের। উভয়ের চাহিদাই সমান। শুধু পুরুষের চাহিদাকে বড় করে দেখে আপনি কিংবা আপনারা পুরুষের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে স্থায়ী এবং বৈধ করে দিচ্ছেন। এই মানসিকতা বর্জন করা উচিৎ।

কোনো সংসার যদি ভেঙ্গে যায়, সেই দায় নারীপুরুষ উভয়েরই সমান। একতরফা নারীকে দায়ী করাটা অমানবিক পর্যায়ে পড়ে। আমি অনেক নারীকে দেখেছি এসব ক্ষেত্রে নারীকেই দোষারোপ করতে। আপনারা সমস্যার গভীরে যান, তখন বুঝবেন গলদটা কোথায়। আর যদি পুরুষ কোনো অন্যায় না-ই করে তাহলে আইন সেখানে কথা বলে ন্যায়টা পুরুষের পক্ষে নিয়ে আসবে। তবে নারীকে একচেটিয়া দোষারোপ করা বন্ধ হোক।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *