মানসিক চাপ ও ডিপ্রেশন কমাতে মেডিটেশন কেন করবেন?
বিদেশি প্রবন্ধ থেকে অনুবাদ করেছেন সাদিয়া মেহজাবিন ।।
আমরা হয়তো মানসিক চাপকে ছুঁয়ে দেখতে পারি না, কিন্তু আমাদের শরীর ও মন এর প্রভাব টের পায়। সংক্ষেপে বললে, মানসিক চাপ আপনার শ্বাস-প্রশ্বাস, ব্লাড-প্রেশার ও হৃদস্পন্দনকে বাড়িয়ে দেয়। যখন আপনি অত্যাধিক চাপে থাকেন তখন অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকে হরমোন কর্টিসেলের পরিমান বাড়িয়ে দেয়। এ হরমোনের অতিরিক্ত নিঃসরণ ব্রেইনের কার্যকারিতা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসহ অন্যান্য অঙ্গকেও প্রভাবিত করে। দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ আপনার মাথাব্যাথা, উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, হৃদরোগ ও অকাল মৃত্যুরও কারণ হতে পারে।
যদিও আপনি এই মানসিক চাপগুলোর মূলকে একেবারে উৎখাত করতে নাও পারেন কিন্তু শরীরে এসবের প্রভাব কমাতে চেষ্টা করতে পারেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ ও কার্যকারী উপায় মেডিটেশন, যা এমন এক ব্যবস্থা যেখানে আপনার মনকে স্থির ও গভীরভাবে মনোনিবেশ করতে আপনি মনোযোগী হয়ে উঠবেন ।
যদিও মেডিটেশনের অনুশীলন হাজার বছরের পুরানো তবুও স্বাস্থ্য উপকারিতা নিয়ে এর গবেষণা নতুন যা বেশ বিশ্বাসযোগ্য। জানুয়ারি ২০১৪ সালে ‘জামা ইন্টার্নাল মেডিসিন’ এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, মেডিটেশন আপনার উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, ব্যাথা উপশম করার জন্যে সহায়ক। বিষণ্ণতা কাটাতে মেডিটেশন একটি এন্টিডিপ্রেসেন্ট হিসেবে কাজ করে।
মনে করা হয়, মেডিটেশন স্নায়ুতন্ত্রের উপর তার প্রভাবের মাধ্যমে কাজ করে যা মানসিক চাপের সময় শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃদস্পন্দন ও ব্লাড প্রেসারকে বাড়ায়। হ্যাঁ, মেডিটেশনের আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্যও আছে। ‘এটি খুবই সত্য যে মেডিটেশন আপনার ব্লাড প্রেসার কমানো ছাড়াও আরো অনেক কাজ করবে। আপনাকে সৃজনশীল করে তুলতে, আপনার সত্তার সাথে সংযোগ ঘটাতেও সাহায্য করবে।’ বলেছেন বার্ক লেনিনহান যিনি একজন প্রসিদ্ধ নার্স, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি ফর ওয়েলনেসে মেডিটেশন করান।
মেডিটেশনের ধরণ
নিচে দেওয়া ধরণগুলো ছাড়াও মেডিটেশনের আরো নানা ধরণ রয়েছে
– কনসান্ট্রেশন মেডিটেশন আপনাকে শেখাবে কিভাবে নিজের মনের দিকে নজর দিতে হয়। এটি মেডিটেশনের মূল ভিত্তি যা থেকে বাকিসব মেডিটেশনের সূত্রপাত।
– হার্ট-সেন্টার্ড মেডিটেশন মূলত নিজের মনকে শান্ত করে, যার উদ্দেশ্য মনের প্রতি সতর্কতা বাড়ানো এবং সমস্ত শক্তি নিজের হৃদয়ে সঞ্চয় করা
– মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন আপনাকে নেতিবাচক মনোভাবকে ঝেড়ে ফেলতে উৎসাহিত করে যেহেতু এটি মনের গভীরতাকেও আঁচ করে। তাই আপনি অতি সহজে মনে শান্ত একটি পরিবেশ অর্জন করতে পারেন।
– তাই চি এবং কিগং মেডিটেশনের চলমান ফর্ম যা শ্বাস প্রশ্বাস এবং ফোকাসের সাথে শারীরিক অনুশীলনকে একত্রিত করে।
– ট্রান্সসেনডেন্টাল মেডিটেশন সুপরিচিত যেখানে আপনি কিছু মন্ত্র-বাক্য-শব্দ পুনরাবৃত্তি করেন আপনার মনকে শান্ত করতে ও দীর্ঘমেয়াদী সচেতনতা বৃদ্ধি করতে।
– ওয়াকিং-মেডিটেশন হাঁটার সময় প্রতি নিঃশ্বাসে আপনার মন ও শরীরের দিকে নজর দিতে সজাগ করে।
লেনিনহান পরামর্শ দেন, ক্লাসে বিভিন্ন মেডিটেশন চর্চা করতে, যাতে করে কোনটা আপনার জন্যে সবচেয়ে ভালো তা নিজেই নির্ণয় করতে পারেন। তিনি আরো বলেন, গ্রুপে অনেকের সাথে মেডিটেশন করা ও একজন সহায়কের কথা শোনার ফলে আপনার অভিজ্ঞতা বাড়বে, সাথে এটি আপনার কাছে অনেক বেশি সহজ হয়ে যাবে। অনেক মেডিটেশন ক্লাস ফ্রি অথবা স্বল্প মূল্যের যা প্রমাণ করে শিক্ষক অনুশীলনের প্রতিই বেশি মনোযোগী।
মেডিটেশন শুরু করুন
মেডিটেশনের সৌন্দর্য্য ও সরলতা হলো এটি করতে কোনো সরঞ্জামের প্রয়োজন হয় না। যা মূলত প্রয়োজন তা হলো নিরিবিলি পরিবেশ ও আপনার মূল্যবান সময়। লেনিনহান বলছেন, ‘প্রথমে ১০ মিনিট দিয়ে শুরু করুন, এরপর দিনে কয়েকবার করার জন্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে নির্দিষ্ট সময়ে কিছু সময়ের জন্য মেডিটেশন করুন। এভাবে আপনি দাঁত ব্রাশ করার মতই অভ্যাসটি গড়ে তুলতে পারবেন।’
আপনি কোন মেডিটেশনটা করবেন সেটার উপর নির্ভর করছে মেডিটেশনের নির্দিষ্ট নিয়মনীতি, তবে এখানে কিছু সাধারণ নিয়ম তুলে ধরা হলো –
মেডিটেশনের জন্যে একটি নির্দিষ্ট জায়গা তৈরি করুন। লেনিনহান বলছেন, ‘এটি আপনার মনকে বিশেষ ভাবে তৈরি করবে ফলে দ্রুত মেডিটেশনে প্রবেশ করাতে সাহায্য হবে। মোমবাতি, সতেজ ফুল আপনাকে আরো উৎসাহিত করবে অনুশীলনে। মেডিটেশনের স্থানটি প্রিয় কোনো ছবি, বই অথবা বস্তু দিয়ে আবদ্ধ করতে পারেন।’
পিঠ সোজা রেখে মাটিতে অথবা চেয়ারে বসুন।
চোখ বন্ধ করুন, নিজের বেছে নেওয়া বিষয়ে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিন।
ধীরস্থির ও গভীর শ্বাস নিন।
গভীরভাবে মনোনিবেশ করুন অথবা নির্দিষ্ট বস্তু নিয়ে ভাবুন। যদি অস্থির লাগে তবুও চেষ্টা করুন মূলে ফিরে আসতে।
দীর্ঘ শ্বাস নিন, নিজেকে শান্ত করুন। লেনিনহান বলছেন ‘শ্বাস নেওয়ার সময় ভাবুন আপনার শ্বাস-প্রশ্বাস একটি নদীর মত যা আপনাকে জোয়ারের সাথে দূরে নিয়ে যাচ্ছে।’
আপনি উচ্চস্বরেও মেডিটেশন করতে পারেন। অনেকে সংস্কৃত শব্দ ‘শান্তি’ ব্যবহার করে যার অর্থ নিজের মনকে শান্ত করো। অথবা আপনার ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে একটি শব্দ বেছে নিন। এক্ষেত্রে লেনিনহান বলছে, ‘জোরে জোরে এমন শব্দচয়ন করাও আপনার অভ্যন্তরীণ শব্দগুলো বিলীন করে দিতে পারে।’
নিয়মিত টানা দু এক সপ্তাহ মেডিটেশনের ফলে মেজাজ ও শারীরিক দিক থেকে পরিবর্তন আপনি নিজেই দেখতে পাবেন। ‘মেডিটেশনের ফলে ব্যস্ত মানুষেরা সহজে তাদের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও ভারসাম্য পরিবর্তন লক্ষ্য করবেন,’ বলছেন লেনিনহান।