মানবিক মূল্যবোধ ও আয়নায় নিজেদের মুখ
মনিরা সুলতানা মুন্নী ।। চোখ দুটো বন্ধ করুন এবং ভাবুন, আপনার মধ্যে সৎ কাজের উদ্দীপনা এবং অসৎ অকল্যাণকর কাজ থেকে বাঁচার মত শক্তি আপনি উপলব্ধি করতে পারেন কিনা? যখন আমরা নিজেরাই প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্য যাবতীয় কর্মকাণ্ডের মধ্যে ঠিক এবং ভুলের পার্থক্য করতে পারবো এবং নিজের ভিতর থেকে, ভুল কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার একটা তাড়া অনুভব করবো তখনই আমরা সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারবো। বাইরের যাবতীয় খারাপ আমাদের অন্তরের পবিত্র শক্তিকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করতে পারবে না।
একজন মানুষ হিসেবে আমাদের মুল্যবোধ কী হওয়া উচিৎ?
মূল্যবোধকে অনেকভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, যেমন:
১. মানুষের আচারণ পরিচালনা করে যে নীতি তাকে মূল্যবোধ বলে
২. কিছু ভাবনার সমন্বয়ে গঠিত স্থায়ী বিশ্বাসকে মূল্যবোধ বলে
৩. মূল্যবোধ তৈরি অর্থাৎ মর্যাদাবান বা শক্তিশালী হওয়া। নিজের চেনা পরিচিত অথবা নিজের আয়ত্বে যা কিছু আছে, তার চেয়ে অধিকতর মূল্যবান, যা কিছু অর্জন করে রাখা সেটাই মূল্যবোধ।
আসুন সমাজবিজ্ঞানীদের মতামত জানি।
সমাজবিজ্ঞানী এফ. ই.স্পেন্সার বলেছেন, “মূল্যবোধ হলো একটি মানদণ্ড, যা আচরণের ভালো-মন্দ বিচারের এবং সম্ভব্য বিভিন্ন লক্ষ্য হতে কোনো একটি পছন্দ করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়”।
সমাজবিজ্ঞানী এফ.ই. মেরিল এর মতে, “সামাজিক মূল্যবোধ হলো বিশ্বাসের এক প্রকৃতি বা ধরন যা গোষ্ঠীগত কল্যাণে সংরক্ষণ করাকে মানুষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে”।
জাতির গুরুত্বপূর্ণ জনসমষ্টি হলো তরুণ, কেন গুরুত্বপূর্ণ সে ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। তাই জীবন গঠনে তরুণদের দায়িত্বশীল এবং সর্বোচ্চ সচেতন হতে হবে। যুব সমাজকে গড়ে উঠতে হবে রুচিশীল, বিনয়ী, সুশিক্ষিত জ্ঞান পিপাসু, কর্মনিষ্ঠ, দায়িত্বশীল, সৎ, মানবিক, সাহসী, যুক্তিশীল চিন্তার অধিকারী, মুল্যবোধ সম্পন্ন, সংস্কৃতি মনস্ক, সহনশীল, নিয়মতান্ত্রিক, দেশপ্রেমিক, বিজ্ঞান মনস্ক, শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী। মানবজীবনকে সুন্দর করে পরিচালনা করতে এবং আকর্ষনীয় জীবন গঠনে উল্লেখিত গুণ অর্জন করার বিকল্প নেই। এতোসব গুণ অর্জন করতে হলে নিঃসন্দেহে পরিশ্রম করতে হবে। তারুণ্যের পুরো সময়টা ব্যয় করতে হবে নতুন নতুন দক্ষতা অর্জনে, জীবনের লক্ষ্য অর্জনে এবং অবশ্যই পৃথিবীকে জানতে পৃথিবীর অপার সৌন্দর্য উদঘাটনে।
জাতি হিসেবে আমরা যখন বাঙালি তখন আমরা পরিচিত হতে শিখবো আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে। আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির কিছু রীতিনীতি, নিয়মকানুন, আদর্শ ও লৌকিকতা আছে, যেগুলো আমাদের সমাজের মূল্যবোধ নামে পরিচিত। তাই বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি দরদ থাকতে হবে। সংস্কৃতি চর্চা আমাদের মনকে প্রসারিত করে, প্রশান্তি আনে। ব্যক্তিত্ব গঠনে সংস্কৃতি চর্চার ভুমিকা যেমন অসামান্য তেমনি সম্প্রীতি রক্ষায়ও সমান গুরুত্বপূর্ণ। একে অন্যের মেলবন্ধন তৈরীর অন্যতম মাধ্যম সংস্কৃতি চর্চা। আমাদের ব্যক্তিসত্তার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এসব জীবনদর্শন যা আমাদের আচরণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করে এবং বিশ্বাসের মানদণ্ড হিসেবে কাজ করে সেগুলোকে শ্রদ্ধা করা উচিৎ। আমরা যখন যে সমাজে বাস করবো সে সমাজের খারাপ দিক নিয়ে যেমন রুচিসম্মত এবং যুক্তিশীল সমালোচনা করবো তেমনই ভালো দিকগুলোকে মন দিয়ে উপভোগ করার মানসিকতাও তৈরি করবো।
“যে শিক্ষা আমাদের দেশের লোককে ঘৃণা করতে শেখায় বা তাদেরকে শোষণ করবার প্রবৃত্তি যোগায় সে দুষ্ট শিক্ষা থেকে আমাদের শত হস্ত দূরে থাকা দরকার”। কাজী মোতাহার হোসেন তার দূরদর্শী চিন্তায় সেই গত শতাব্দীতে বলে গিয়েছেন। আমাদের শিক্ষা গ্রহণ অনেকাংশেই নাম এবং টাকা অর্জনের জন্য, জানার আগ্রহে নয়। আমাদের সমাজ, শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের মধ্যে জ্ঞান অর্জনের পিপাসা তৈরী করাতে পারে না। কেন পারে না? কারণ আমরা আমাদের জীবন নিয়ে যতটা হতাশাগ্রস্ত তার অর্ধেক সময় ও সৎ গুণ বা দক্ষতা অর্জনে সময় ব্যায় করতে ইচ্ছুক না। আমরা আমাদের না পারার দায় চারপাশের সমাজ ব্যবস্থার উপর চাপিয়ে দিয়ে আয়েশে দিন পার করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আমরা ভাগ্যের হাতে নিজেকে সমর্পন করে দিতে আগ্রহী। কেননা তাতে আমাদের দুটি জিনিসে সুবিধে হয়, একটা সহজে বলতে পারি ভাগ্যে নেই এবং কোন পরিশ্রম করতে হয় না। চিত্তকে উন্মুক্ত করে বিশ্বকে আবিস্কার করার আকাঙক্ষা নতুনকে জানবার আগ্রহ, পরিবর্তনকে গ্রহণ করার অনুপ্রেরণা এই যুবসমাজের নিজেকেই নিজে দিতে হবে। যুবকদের সঠিক পথ নিজের জ্ঞান এবং চিন্তা কাজে লাগিয়ে নিজেই তৈরি করে নিতে হবে। উপলব্ধি করেন, আপনার জীবনকে সাজানোর দায় শুধুই আপনার। বোধবুদ্ধিকে তীক্ষ করে অন্যের আদর্শ হিসেবে নিজেকে তৈরি করুন।
আমাদের চারপাশের শক্তিশালী ব্যক্তিত্বদ্বারা আমরা খুব সহজেই প্রভাবিত হই। তথাকথিত নেতা শ্রেণির দেখানো পথে জীবনকে পরিচালিত করি এবং গর্বের সাথে নিজের সুবিধা আদায়ে দরকারে অদরকারে নেতার নাম নিয়ে গর্ব করি। আমরা ভেবে দেখি না তাদের এই শক্তির উৎস কী এবং কোন শক্তিতে বলিয়ান তারা। কোন শক্তি আমাদের ব্যবহার করা উচিৎ এবং কোনটা উচিৎ নয়, পরগাছা হতে এই সমাজ এতো আগ্রহ কোথায় পায়? নিজের সততার শক্তি দিয়ে উজ্জ্বল হতে চাই আমরা ক’জন? অন্ধবিশ্বাস যে আমাদের দাসে রূপান্তরিত করতে পারে সেই চিন্তা ও তো মাথাতে আনতে হবে। আপনি এখন যেখানে যাবেন সেখানে দেখবেন নেতা বা ভাইয়ের শক্তির প্রতিফলন, এই বিশেষ শ্রেণির ভাই বা নেতার প্রভাবে সেবা প্রদানের পার্থক্য। এরকম হীনকাজ এখন সিস্টেমে পরিনতি পেয়েছে।
পরিবার, সমাজ, দেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই পরিবার, সমাজ এবং দেশের প্রতি কর্তব্য পালনে সচেতন হতে হবে। পরিবারকে যেমন তাচ্ছিল্য করে পরিবারের সদস্যদের প্রতি দায়িত্ব অবহেলা আমাদের অকৃতজ্ঞ হিসেবে উপস্থাপন করে তেমনি সমাজ, দেশের প্রতি কর্তব্য বোধকে অস্বীকার করলে আপনার মূল্যবোধ আঘাতপ্রাপ্ত হয়। অনেকসময় কিছু অনৈতিক কাজকে বৃহৎ স্বার্থ উদ্ধারে তুচ্ছ মনে হতে পারে। মনের এই অবস্থাকে দমন করতে পারাটাই ব্যক্তিত্বের শক্তিশালী দিক হিসেবে বিবেচিত হয়। জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে আমাদের অবশ্যই নিয়মতান্ত্রিক হওয়া জরুরি।
আমরা নিজেদের ঠিক ভুল বিচারের মানদণ্ড আমরা আমাদের সুবিধা মতো নিজেরা তৈরি করি। আমরা বিশ্বাস করি যে আমার নিজের তৈরী করা পথই একমাত্র নির্ভুল এবং ভালো। আমরা নিজেরাই কেবল নিজেরটা ভালো জানি, ভালো বলি। আচারে ব্যাবহারে আমরা নিজেকেই সর্বৎকৃষ্ট দেখাতে পছন্দ করি। আমাদের নিজের চিন্তায় তৈরি করা মানদণ্ডের বিচারে যেগুলো আমাদের চিন্তার সাথে মেলেনা তাকে আমরা দুমড়ে মুচড়ে পিষ্ট করে অশ্লীলতায়, অমানবিকতায় মুড়িয়ে প্রতিহত করার নির্লজ্জ চেষ্টা করি। এ বিষয়ে আমরা এতোটাই অমানবিক হয়ে উঠি যে, অন্যকে শারীরিক মানসিক থেকে হেন কোনো নির্যাতন নেই যেটা প্রয়োগ করতে পিছপা হই। আমরা অন্যের ব্যক্তি স্বাধীনতায় ঈর্ষাকাতর। আমাদের মতের বিরুদ্ধে যেতে দেখলেই তাকে দমন করবার অভিপ্রায় আমাদের হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে দেয় এবং ভিতরের জঘণ্য এক মানবসত্তা জাগিয়ে তোলে। এই বিধ্বংসী মানবসত্বার দায়ও আমরা তার উপরে চাপাই। এই নির্মম বিধ্বংসী মানবসত্তার অস্পৃশ্য ছায়াও আমাদের মনে উঁকি দেয়ার আগে দমন করতে পারাটাই মূল্যবোধ সম্পন্ন ব্যক্তির আদর্শ হওয়া উচিৎ।।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]
চমৎকার অভিব্যক্তি। অসাধারণ লেখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
Excilent writing, keep it up