পৌনঃপুনিক [পর্ব – ০৬]
ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী ।।
টানা চারদিন বৃষ্টির পর দারুণ ঝলমলে রোদের সকাল। এমন রোদেলা দিন দোলনের প্রিয়।
ভোরে দীর্ঘ সময় ধরে স্নান সারলো সে। খুব সকালে স্নানের অভ্যাস তার ছোটবেলা থেকেই।
স্নান না সেরে দিন শুরু হয় না তার। ভেজা চুলে বারান্দায় বসে কফির মগে চুমুক দিতে দিতে দিনের সব পরিকল্পনা করে নেয়ার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। সকালের নাশতায় দোলনের পছন্দ টোস্ট-বাটার-জ্যাম, সাথে সেদ্ধ ডিম আর কোনোদিন কলা। কফিটাও নিজে বানিয়ে নেয়া সহজ। দিপ আর দিয়াও মায়ের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ঝামেলাহীনভাবে নিজেরা গুছিয়ে নেয়া যায়। আদি বাড়িতে থাকলে ঝামেলা করে। তার এখনো হাতে-বেলা রুটি, পরোটা, ভুনা মাংস, বুটের ডাল, ডিম ভাজা, সুজির হালুয়া – এসব না হলে নাশতা হয় না। একটা সময় অফিস থেকে ফিরে রান্নার পেছনে প্রচুর সময় দিতো দোলন। রান্নাটা তার শখ ছিল, কিন্তু যে কোনো শখে যদি বাধ্যবাধকতা চলে আসে তখন আর সেটা “শখ” থাকে না, একঘেয়েমি চলে আসে। এখন মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হলে করে বা সাপোর্ট স্টাফ ছুটিতে গেলে। নাজমা খালা ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়ে বসে আছে আজ তের দিন। ফেরার নাম নেই। আদি থাকলে এতোক্ষণে ফোন দিয়ে খালার খোঁজ খবর নিতো। এইসব সাংসারিক দায়িত্ব পালনে আদির তুলনা হয় না। অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে সে এগুলো পালন করে। কালে কালে সে ঘোর সংসারী হয়ে উঠেছে। দীপ আর দিয়া স্কুল, কোচিং, গানের ক্লাস, ছবি আঁকার ক্লাস – নিজেরাই সামলে নিতে শিখেছে অথচ এই তো সেদিন পর্যন্ত দীপ আর দিয়াকে নিয়ে ছোটাছুটির অন্ত ছিল না!
ষোলো মাসের ছোট-বড় দীপ আর দিয়া। প্রায় জমজের মতো দুই বাচ্চাকে বড় করতে হয়েছে। আদির তখনো সংসারে “মন” বসেনি। সেলসে চাকরির সুবাদে মাসের মধ্যে দুই-তিন সপ্তাহ ঢাকার বাইরে থাকতে হতো। কখনো কখনো সে বাড়ির দায়িত্ব এড়াতেও ট্যুর নিয়ে নিতো। ফিরে এসে তার প্রচুর বিশ্রাম আর বিনোদনের প্রয়োজন। তাই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে, ঘুরতে গিয়ে নিজের মন মেজাজকে ফূর্তিতে রাখতো। দোলন কীভাবে একা হাতে চাকরি সামলাতো, দুই বাচ্চার খেয়াল রাখতো, নিখুঁতভাবে সংসার গুছিয়ে রাখতো সেসব আদি জানতে চেষ্টাও করেনি। বিশ দিন পর যখন আদি বাড়ি আসতো, ওয়াশরুমে ধবধবে তোয়ালে থেকে শুরু করে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, সর পড়া তরকারির বাটি, টিভির রিমোট – প্রয়োজনীয় সব কিছু হাতের নাগালে পেতো। বন্ধুমহলে দোলনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকতো আদি। আদি দুধ, ডিম, ফল আর প্রচুর বাজার আনতো, বাচ্চাদের জন্যে তার আদর ছিল, কেবল দোলনের মনের ক্ষতটা দেখেও দেখতো না। এতোটা বৈপরীত্য বোধহয় একমাত্র মানুষের চরিত্রেই দেখা যায়।
দিয়া হওয়ার পর দোলন ভীষণভাবে বিষণ্ণ হয়ে পড়তো। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বড়জোর দুই ঘন্টা ঘুমাতে পারতো। মনে হতো, পৃথিবীর কেউ তার কষ্ট বুঝতে পারছে না। সেটা যে “বেবি ব্লুজ”, তাও বোঝেনি তখন। একবার আদির এক বাল্যবন্ধুর বড় বোন রুনু’দি দিয়াকে দেখতে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, তোমার এই সময়টা আমিও পার করেছি– “নীল মাতৃত্ব”। নিজের খেয়াল রেখো, কেমন?”
সেইসব দিনে দোলন কোনো দাওয়াতে, অনুষ্ঠানে যেতে পারেনি। আদি অবলীলায় একা সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতো। দোলন মা হয়েছিল সবটুকু দায়ভার নিয়ে। কেবল নয় মাস গর্ভে ধারণ করেই নয়, মনপ্রাণ সঁপে দিয়ে মা হয়েছিল। আদি যেন বাড়ির অতিথি, আপ্যায়িত হওয়াই যার কাজ! আদির বাবা হয়ে উঠতে সময় লেগেছে। ভালোবাসার বিয়ে, তাই মায়ের কাছে আদির অবহেলার কথা কোনোদিন বলতে চায়নি সে। আর আদির পরিবারের কেউ আদির অন্যায় আচরণগুলো ধরিয়ে দেয়নি।
রুনু’দির স্নেহার্দ্র কথাগুলো শুনে স্বল্প পরিচিত মানুষটাকে বড় আপন মনে হয়েছিল সেদিন। বুকের ভেতর কান্নাগুলো সব উপচে আসছিল। সেই রুনু’দির কথা আজো ভোলেনি দোলন। “নীল মাতৃত্ব” শব্দটাও না।
[চলবে]
ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী : সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা। এই মুহূর্তে শিল্পকর্ম এবং স্বাধীন লেখালিখিতে ডুবে থাকাতেই স্বচ্ছন্দ। মিশ্র মাধ্যমে শিল্পকর্মের বিষয় হিসেবে জানালার গল্পের আড়ালে আসলে ফেলে আসা সময়, স্মৃতির সঞ্চয় অথবা জীবনের কোনো চেনা গল্প রয়ে যায়। জীবনের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় নানা ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে যে বিষয়গুলো বিশেষভাবে ভাবায় : নারী – পুরুষের সমতা, সম্পর্কের টানাপোড়ন ও জটিলতা। পারিবারিক – সামাজিক নির্যাতন ও বৈষম্য। শিশুর নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আড়াই লক্ষাধিক বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী জীবন সংগ্রামের ইতিহাস।