November 24, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

নারীকেই কেবল দেখতে ভালো দেখাতে হয়?

শাফক্বাত আনোয়ার ।। যে ব্যাপারটা নিয়ে লিখতে বসলাম, সে ব্যাপারটা আমাকে আগেও যে কখনও ভাবায় নাই, তা না। করেছে। কোন ব্যাপার? বলছি।

কখনও খেয়াল করেছেন টাকমাথা বলে, ভুড়িওয়ালা বলে, কিংবা উচ্চতায় খাটো বলে কোনো ছেলের বিয়ে আটকেছে? একটা বিয়েবাড়িতে সবাই বউ “দেখতে” যায়। বউ একটা দেখার জিনিস। ইদানিং খুব অল্প ক্ষেত্রে এমন মানসিকতার পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু বেশিরভাগই এখনও ভাবে, একজন নারী একটা দেখার মতো ব্যাপার। দেখনসই না হলে নারী আবার কিসের?

আচ্ছা বিয়ে শাদি এই নিয়ে কথাবার্তা তো ক্লিশে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে?

আমার কাজটা যেমন, তাতে আমাকে বেশি মানুষের সাথে মেশা লাগে। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত। অনেক সিনিয়র পদের অফিসারের গা থেকে ঘামের গন্ধ, কিংবা মুখ থেকে বাজে গন্ধ বের হতে দেখেছি। পুরুষ ছিলেন যারা, তাদের কথা বলছি। তাদের সেইসব অ্যাট্রিবিউট কিন্তু আলাদা করে দেখা হতো। মানে উনার কাজ কিন্তু ভালো, এটাই আগে দেখা হতো। অনেক পুরুষ সিনিয়র অফিসারকে দেখেছি ইস্ত্রী ছাড়া জামা পরে অফিস করতে যেতে। নোংরা জুতো পরে অফিস করতে। সবকিছু ছাপিয়ে, সেই পুরুষ অফিসারকে আগে কাজ দিয়ে যাচাই করা হয়েছে তারপর অন্য কিছু। আর চেহারা? কে কবে যাচাই করেছে পুরুষের চেহারা? কিন্তু না, মেয়েদের বেলায় এটা ম্যাটার করবেই। দেখতে প্রেজেন্টেবল হওয়া বাধ্যতামূলক হলে সেটা ছেলে মেয়ে সবার বেলাতেই হওয়া উচিত। তবু ছেলেদের বেলায়, কোনো এক বেঞ্চমার্কে এইসব তেমন ম্যাটার করে না। কেউ এইসব নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্যও করেনা। কারণ ছেলে মানেই তো অনেক কাজ আছে তার অনেক বড় পারফর্মার, বাই ডিফল্ট!

এই যে এতো এতো মোটিভেশনাল স্পিকার, এতো এতো সেলিব্রিটি, এতো এতো পলিটিক্যাল লিডার, তাদের চেহারা কয়জন দেখে? তাদের গায়ের জামাটা সুন্দর না দামি, না ট্রেন্ডি, না ফ্যাশনেবল সেটা কয়জন দেখে? তাদের কাজটা সবাই আগে দেখে, তাদের কথাটা সবাই আগে শোনে। আসলে সেটাই তো হওয়া উচিৎ। মানুষকে তার কাজের মাপকাঠি দিয়ে মাপতে হয়। তো সেই উচিৎ কাজটা কি কেবল পুরুষের বেলাতেই এক তরফা?

নারীকে সবসময় সুন্দর হতে হয়, সুন্দর হয়ে থাকতে হয়। খাটো হলে হাই হিল পরতে হয়, চুল আঁচড়াতে হয় সুন্দর করে, ভালো অ্যাপিয়ারেন্স একটা লাগেই। কোনো নারী, সে হোক পলিটিক্যাল লিডার কি মোটিভেশনাল স্পিকার, কি একটা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, তার অ্যাপিয়ারেন্স ম্যাটার করবেই। নাহয় সেই নারীকে তার কাজ ছাপিয়ে প্রথমেই শুনতে হয়, “কেমন জামাকাপড় পরেছে, বুয়ার মতো লাগছে!” কিংবা “আশ্চর্য শাড়ির ব্লাউজটা ম্যাচিং করে পরা যেত না?” “এমন মোটা ফিগার, ধুমসী” ইত্যাদি ইত্যাদি। কিংবা ভেবে দেখুন একবার, একজন মহিলা সবার সামনে বক্তৃতা দিচ্ছেন এই বাংলাদেশের কোনো মঞ্চে, তার মাথায় বিশাল একটা টাক। কয়জন তার বক্তৃতা শুনবে, আর কয়জন তার কেশহীনতা নিয়ে জল্পনা কল্পনা করবে?

এই ব্যাপারটা পজিটিভ হিসেবে দেখতে গেলে, এটা বলাই যায় যে নারী মানেই সুন্দর। নারীকে পাউডার ঢেলে, সুগন্ধ মেখে, চুলে উইগ লাগিয়ে বা কলপ লাগিয়ে যে করেই হোক, সুন্দর হওয়াই লাগে। নারীর বেলায় আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী।

তাহলে পুরুষের সৌন্দর্যের দরকার নেই, তাই তো?

যুগ অনেক এগিয়ে গিয়েছে। কাজের ক্ষেত্রে এখন বুদ্ধিমত্তা অনেক প্রাধান্য পাচ্ছে। দেশ নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নারীকে সামনে দেখা যাচ্ছে। তবুও সেই নারীকেই নেতিবাচক মাপকাঠিতে চিহ্নিত করতে বাধেনা আমাদের, যে মাপকাঠির ব্যবহার পুরুষ কাউন্টারপার্টের ক্ষেত্রে করাই হয়না একেবারে। দেখতে ভাল হতে হবে, এই এক্সপেকটেশন মাথায় নিয়ে একজন মেয়ের কত মূল্যবান সময় যে মেকাপ পার্লার এবং শপিং এর পেছনে চলে যায়, আর এমন করতে করতে ভাবতে ভাবতে এটাই ভীষণরকম স্বাভাবিক ব্যাপার বলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়; এটাই হতাশাজনক।

আশাবাদী মানুষ আমি। সামনে নিশ্চয়ই এই অবস্থা বদলাবে। আমাদের আগের জেনারেশন আমাদের জন্য অনেক বদল এনেছেন, আমরা আজ যেসব অসামঞ্জস্যতা তুলে ধরবো, পরের জেনারেশন হয়তো তার মুখোমুখি হবে না।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *