ওই ক’টা দিন মেয়েটার যন্ত্রণা বুঝবার চেষ্টা করুন
তানজিয়া রহমান ।। পিরিয়ড মেয়েদের একটি স্বাভাবিক মাসিক চক্র। এটা প্রতিমাসে বেশিরভাগ মেয়েরই হয়। কিন্তু পিরিয়ড এখনো রাখঢাকের বিষয় আমাদের সমাজে। পিরিয়ড শুনলেই মানুষের ভ্রু কুচকানো, চোখ বড় করা, ঘেন্না করা, ছিঃ ছিঃ করা শুরু হয়। এটাকে অপরাধের পর্যায়ে নিয়ে যায়। চুরি, ডাকাতি, ঘুষের থেকেও বড় অপরাধ যেন পিরিয়ড নিয়ে টু শব্দ করাটা। আর এই ভুল বিষয় নিয়ে লজ্জার জন্য মেয়েরা পিরিয়ডের সময় নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এমন নিয়মিত একটা বিষয়ে এখনো এত অজ্ঞতার কারন এটা নিয়ে কথা না বলা।
পিরিয়ড নিয়ে নেই পারিবারিক শিক্ষা, সচেতনতা। বাসার বেশিরভাগ মানুষ পিরিয়ড নিয়ে মুখ খুলতে চায় না। মা, বোনরা নিজেদের সমস্যা প্রকাশ করে না, সেই সাথে যাদের নতুন পিরিয়ড হয়েছে বা হবে তাদের দিকেও নজর দেয় না। বেশির ভাগ মেয়েদের প্রথম পিরিয়ডের অভিজ্ঞতা ট্রমাটিক। পিরিয়ডের সময় কিভাবে নিজের যত্ন নিতে হবে এটা জানে না অনেকেই। অনেক শিক্ষিত, আধুনিক মায়েরাও মেয়েদের এই বিষয়টা এড়িয়ে যায়। স্কুলগুলোতে এই চ্যাপ্টার স্কিপ করে। বাসায় পড়ে নিও বলে টিচাররা। বাচ্চারা বাসা থেকে শিখতে পারে না আবার স্কুল থেকেও শিখতে পারে না। অজানা অনেক প্রশ্ন অজানাই থেকে যায়।
পিরিয়ডের সময় ব্যবহারের জন্য মেন্সট্রুয়াল কাপ, ট্যাম্পুন, স্যানেটারি ন্যাপকিন আছে। আমাদের দেশে স্যানেটারি ন্যাপকিন ব্যবহার বেশি হয় কিন্তু তার থেকেও বেশি এখনো অনেকে পুরোনো কাপড়, নোংরা ন্যাকড়া ব্যবহার করে। টিস্যু, তুলা এসবও ব্যবহার করে অনেকে। কাপড় ব্যবহার করলেও তা ভালো মতো পরিষ্কার করে রোদে শুকায় না। দীর্ঘদিন একই কাপড় ব্যবহার করে। যারা স্যানেটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে তারা দেখা যায় খরচের কথা চিন্তা করে দীর্ঘ সময় একটা প্যাড ব্যবহার করে। কিন্তু পুরোটা নষ্ট হোক না হোক একটা প্যাড ৪-৬ ঘন্টা পর পর পাল্টাতে হবে। বাজারে বিভিন্ন ফ্লোর জন্য বিভিন্ন মাপের প্যাড পাওয়া যায়। যাদের কম ফ্লো তারা সেই অনুযায়ী বাছাই করবে। বেশিক্ষন পরার জন্য মোটা প্যাড নেয়াটা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকির। এসবের জন্য র্যাশ, চুলকানি, ইনফেকশন হয়।
আবার মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার আরামদায়ক, খরচও এককালীন এবং পরিবেশবান্ধব। একটা কাপ কিনলে সেটা কয়েক বছর চলে যায়। আবার ১০- ১২ ঘন্টা পর পর ক্লিন করলে হয়। কিন্তু এতে এখনো মানুষ অতোটা পরিচিত না। অনেকে অভ্যস্থ হতে পারে না। কাপের পরিচর্যা করতে হয় সতর্কের সাথে। প্রতিমাসে প্রথমবার ব্যবহারের সময় পাঁচ মিনিট কাপটাকে ফুটিয়ে নিতে হয়। এটা অনেকে মেন্টেন করতে পারে না। আর ট্যাম্পুনের খরচ তুলনামূলক বেশি আর আমাদের দেশের সব জায়গায় পাওয়ায় যায় না।
পিরিয়ডের সময় বেশিরভাগ মেয়েরই পেটে ব্যাথা, উরু, পা, কোমরে ব্যাথা হয়। কারো কারো ব্যাথার তীব্রতায় মাথা ঘুরানো, বমিও হয়। কিন্তু এই তীব্র ব্যাথাকে উপেক্ষা করে প্রতিদিনের মতো একটা স্বাভাবিক দিন চায় সবাই আমাদের কাছে। যদি জানানো হয় ব্যাথার কথা তাহলে শুনতে হয়,“এটাই স্বাভাবিক। ব্যাথা নিয়েই সব করতে হবে। আমাদেরও হয়, তাই বলে কি বসে থাকি?” অনেক সময় পিরিয়ড শুরু বা শেষ হওয়ার পরেও ব্যাথা কমে না। এমন সময় প্রয়োজন ডাক্তার দেখানো। “পিরিয়ডের ব্যাথার জন্য ডাক্তার!” এমনটাই বলে পরিবারের লোকজন। কেউ বলে, বিয়ে হলে ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ের পর বলে, বাচ্চা হলে ঠিক হয়ে যাবে। আসলে কিসে ঠিক হবে এটা তো ডাক্তার বলবে, না?
পিরিয়ডের সময় মানসিক অবস্থা যে কি খারাপ থাকে বেশিরভাগ মেয়ের। অল্পতেই মেজাজ খারাপ হয়, অনেক সময় সবকিছু বিরক্ত লাগে, সবার মাঝে থেকেও একা লাগে, বিষন্ন লাগে, কান্না পায়, কখনো কখনো কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছা হয় না আবার অনেক সময় আদর, যত্ন, ভালোবাসা পাওয়ার ইচ্ছা হয়। একেক জনের একেক সময় একেক রকম অনুভুতি হয়। এসব ইচ্ছাকৃত কিছু না। এই সময় হরমোনের ওঠা নামার জন্য এমন হয়।
পিরিয়ড চলাকালে অনেক সময় দেখা যায় প্রতিদিন যে খাবার খাওয়া হয় তা খেতে ইচ্ছা হয় না অনেকের। কারো কারো নির্দিষ্ট কোনো খাবারের ক্রেভিং হয়। পিরিয়ডের সময় অনেক বাড়িতেই মেয়েদের বিভিন্ন খাবার খেতে দেয় না। যেমন টক জাতীয় ফল, আচার। অথচ এর বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই, পুরোটাই কুসংস্কার।
পিরিয়ড চলাকালীন সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। প্যাড পাল্টানোর সময় ভালো মতো ভ্যাজাইনা আর তার চারপাশ ধুয়ে নিতে হবে। প্যাড সঠিক সময় পাল্টাতে হবে। পেন্টি যেন ভেজা ভেজা না থাকে খেয়াল রাখতে হবে। পেন্টি ভালোমতো ধুয়ে পরিষ্কার করে রোদে শুকাতে হবে। পিরিয়ড চলাকালে ভারি কাজ না করাটাই উচিত। মনের ও শরীরের যত্ন নেয়াটা জরুরি। তবেই সুস্থ থাকা যাবে।
পিরিয়ড নিয়ে নিজে সচেতন হোন, অন্যকে সচেতন করুন। স্যানেটারি ন্যাপকিন কিনুন, বাসার অন্য কারো প্রয়োজনে তাকে কিনে দিন। এটা একটা প্রয়োজনীয় জিনিস। এটা কিনতে লজ্জার কিছু নেই। বিক্রির জন্যই দোকানে রাখে। নিশ্চয়ই বিক্রেতা এমন কোনো আচরন করবে না যাতে তার ক্রেতা কমে যাবে। যখন কারো পিরিয়ড হয় তখন তার প্রতি যত্নশীল হোন। মাসে ৩-৪ টা দিন না হয় কিছু বিষয়ে সেক্রিফাইস করুন। রাগারাগি, খারাপ আচরন না হয় না করি এই বিষয় নিয়ে। যদি অপশন থাকতো তাহলে মনে হয় কোনো মেয়েই প্রতি মাসে এই যন্ত্রণা সেধে নিতো না নিজের জীবনে। জীবনে বারবার পিরিয়ড হওয়ার পরেও পিরিয়ডের ডেট কাছে আসার সাথে সাথে অনেক মেয়ের আতংক বেড়ে যায়। আপনি দেখছেন এই ব্যাথা, এই মানসিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে মেয়েটা যায়! তার অবস্থা চিন্তা করুন।