November 3, 2024
জীবনের গল্প

পর্ব-১: ব্যাডারা আমারে সোন্দর কইতেই থাকে, তাগোরে বিশ্বাস করি না!

শাহাজাদী বেগম পেশাগত জীবনে একজন উন্নয়নকর্মী, ১৮ বছর ধরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। উনি বাংলাদেশে যৌনকর্মী ও শিশুদের মানবাধিকার রক্ষা, এইচআইভি ও এইডসসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, পাচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে গবেষনার কাজ করছেন। এই কাজগুলোর জন্য তাকে দেশের যৌনপল্লীগুলোতে অসংখ্যবার যেতে হয়েছে।  সেই অভিজ্ঞতাগুলোকেই গল্পে রূপান্তর করে লেখা  হয়েছে “গুহান্তরাল”। আজ থেকে ধারাবাহিক আকারে প্রকাশ হবে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর প্রথম পর্ব।।

 

“সমাজ কারে কয়, আফা?”

সাতখন্ড রামায়ন পড়ে সীতা রামের মাসি- এমন ভাবতে ভাবতেই ঘাড় ঘুরায় সুরমা। কিছুটা বিরক্তি আর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সামনে তাকায়, ১৪-১৫ বছরের একটি মেয়ে তার দিকে সরাসরি  তাকিয়ে  আছে।  না, তার চাহনি দেখে মোটেই মনে হচ্ছে না যে সে প্রশ্নটির উত্তর আশা করছে। আজ দুদিন ধরে সমাজ, সামাজিক চালচলন, বেশভুষা এসব নিয়ে নারী যৌনকর্মীদের ২০ জনের একটি দলের ট্রেনিং চলছে। যদি কেউ  অন্য পেশা নিয়ে সমাজে বাস করতে চায় তবে  তার জন্য কিছুটা ধারণা দেওয়া। আজ শেষ দিন। আশ্চর্য ! গতকাল তো এই মেয়েটি ছিল না! আজ এলো, কিন্তু সারাদিন চোখেই পড়েনি! সুরমা অস্বস্তি বোধ করছে, মেয়েটি তার দিক থেকে চোখ সরাচ্ছে না।

“আফা, কইছিলাম কি, আমার নানী বিক্রি হইয়া আইছিল এই পল্লীতে, মায় জন্মাইছে এইখানে, আমিও জন্মাইছি এইখানে। এই পল্লীডা ছাড়া আমি কিছুই চিনি না। এইডাই আমার সমাজ, এইডাই আমার দুয়িন্যা গো আফা।”

এইবার  সুরমা বড় ধরনের ধাক্কা খেলো। মনে মনে কথা হাতরাচ্ছে, সহসাই যুতসই কোন উত্তর দিতে পারে না। স্থানীয় সহযোগী সংস্থার ম্যানেজার রব্বানী সাহেব কিছুটা অপ্রস্তুত। গলা বাড়িয়ে ধমকের স্বরে বলে “তোমাকে না বলেছি চুপ থাকতে। দু’দিন ধরে এতবার করে সবকিছু পড়ানো হল আর এখন তুমি বল সমাজ কারে কয়?”

“ভাইয়া, বকা দ্যান ক্যান? কাইল আমি আছিলাম না। আইজ নেত্রী আমার মায়েরে ২০০ টাকা দিয়া আমারে ট্রেনিং এ আনছে। আমি যে কাস্টমার নিতাম তার পয়সা। আফায় তো কইছে না বুজলে জিগাইতে, তাই জিগাইছি।”

“সমাজ কি তুমি জানো না?” রব্বানী সাহেবের গলার স্বর বাড়ে।

“ঐ যে আপনাগো যেই সমাজ থাইক্যা ব্যাডাগুলান পয়সা দিয়া আমাগো কাছে থাকতে আসে সেই সমাজের কথা কইতাছেন? এইডা আবার শিখনের কি আছে, আমরাতো জানি। তয় ক্যান যে  নিজেগো ঘরে ভালা ভালা বউ থুইয়া আমাগো কাছে আসে সেইডা বুঝি না, আপনেরা জানেন? তয় তারা খুব ভাল। তারা আসে বইলা আমরা খাইয়া পইড়া বাঁচতে পারি। নইলে কই  যাইতাম কন। আহা! ভালা সমাজের ভালা ভালা মাইনষেরা!!”

রব্বানী সাহেব মনে মনে প্রমাদ গোনে। চাকরীটা এবার তার শেষ, কি কুলক্ষনে সংখ্যাপূরনের জন্য মেয়েটাকে সে আনতে বলেছিল।

এবার কিছু একটা না বললেই নয়।

“তোমার নাম কী?”

গলাটা একটু কি কেঁপে গেল সুরমার? নিজের গলাটা নিজের কাছেই অচেনা লাগে তার।  কি অবাক কান্ড! সবাইকে আপনি করে বলে অথচ এই মেয়েটিকে সে তুমি  করে বলল কেন!

গলায় কিছুটা জোর এনে বলে “কই বললে নাতো কী নাম তোমার?”

“প্রিন্সেস! এইখানে আমারে প্রিন্সেস নামেই চিনে।” বলেই হাসিতে ঢলে পড়ে মেয়েটি। হাসি আর   থামতেই চায় না।  হাসতে হাসতেই বলে  “আফা আপনের হাসি পাইতেছে না আমার মতন এমন কালা মাইয়ার নাম প্রিন্সেস দেইখা? কালা হইলে কি হইবো, আমার কিন্তু অনেক কাস্টমার। আর এই যে মোটা এতবড় আমারে দেখতাছেন, আমি কিন্তু আসলে এত বড় না। আমার বয়স ১১ বছর, মায় ট্যাবলেট খাওয়াইয়া আমারে মোটা তাজা কইরা এত বড় করছে। আমার অহনও মাসিক হয় নাই গো আফা, বিশ্বাস করেন।”

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে মেয়েটি। হাসতে হাসতে আবারো গড়িয়ে পড়ে।  নেত্রী এবার খেঁকিয়ে ওঠে, “ওই ছেমড়ি থামবি এবার, ঢাকার আফার সামনে কি শুরু করছস, এমন থাবড়ান দেব না, বাপের নাম ভুলায়ে দেব।”

প্রিন্সেসের হাসির দমক আরো বেড়ে যায়, “ও মাসি কও কি গো,  আমারতো বাপ নাই, মায় মনেই করতে পারে না কোন ব্যাডায় আমারে তার প্যাডে ঢুকাইছে”!

হাসির দমকে প্রিন্সেসের চোখে পানি চলে আসে। সুরমার নিজেকে খুব  অসহায় লাগে। বলে “প্রিন্সেস, তুমি অনেক সুন্দর।” মেয়েটি হাতের পিঠে চোখ মোছে, বলে, “ব্যাডারা আমারে সোন্দর কইতেই থাকে, তাগোরে বিশ্বাস করি না। তয় আপনে যে কইছেন, পরানডা জুড়াইছে। আফা আমি যদি আপনের মত ভালো জায়গায় জন্মাইতাম, তাইলে আপনের মত পড়তে পারতাম, আপনে কি সোন্দর  কইরা কথা কন, কইলজাডা ঠান্ডা হইয়া যায়! আমিও সোন্দর কইরা কথা কইতে পারতাম, ফডর ফডর ইংরাজি কইতাম, চাকরি করতাম, ঐ রকম বড় গাড়িতে কইরা ঘুরতাম! আমি এইখানে জন্মাইলাম  ক্যান? আমার কি দোষ কইতে পারেন?”

সুরমার অসহায়ত্ব বাড়তে থাকে, মেয়েটা কি তাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করছে? গলা শুকিয়ে আসছে, হাত বাড়িয়ে পানির বোতলটা নেয়। এক চুমুকে পুরোটা শেষ করে। এত তেষ্টা পেয়েছিল!

“সুরমা আপা, সাংবাদিক আশিক সাহেব আপনার সাথে দেখা করতে চান, অফিস  রুমে বসে  আছেন।”

অফিস সহকারী মেয়েটির কথায় সুরমা সম্বিৎ ফিরে পায়।

“বসতে বলেন নীরা,  সেশনটা শেষ করেই আসছি।”

সুরমা সেশন শেষ করে অফিস রুমের দিকে পা বাড়ায়। পিছন থেকে প্রিন্সেস গান ধরে, “উড়িয়া যাইবো শুয়া পাখি পড়িয়া রইবো কায়া…”

মেয়েটার গানের গলা এত মিষ্টি!

ট্রেনিং রুমের দুই ঘর পিছনেই অফিস রুম। আশিক সাহেব, স্থানীয় তরুন সাংবাদিক, প্রেসক্লাবে তার ভালো হোল্ড আছে। আশিক অফিস সহকারি মেয়েটির সাথে টুকটাক কথা বলে

– আপনার নাম কি?

– নীরা, মেয়েটি মিষ্টি হেসে উত্তর দেয়

– সুনীলের নীরা?

– না না…

– তবে নীরবে নীরা?

– নুসরাত ইয়াসমিন নীরা

– হা হা হা! আশিক জোরে হেসে ওঠে। আশিকের প্রাণখোলা হাসি নীরার খুব ভালো লাগে।

– কতদিন এই অফিসে?

– এইতো ছয় মাস

– কেমন লাগছে এদের সাথে কাজ করতে?

– প্রথম দিকে খুব অস্বস্তি হত।  সকালে এখানে ঢুকতে খুব খারাপ লাগতো, মনে হত আশে পাশের লোকজন আমাকে দেখে কীসব ভাবছে। এখন কিছুটা ঠিক হয়েছি। আরো অনেকে এখানে কাজ করে, আরো কয়েকটা সংস্থাও আছে।

– নিবেদিত প্রাণ হোন নীরা, দেখবেন টিকে গেছেন।

আশিক আবেগ দিয়ে বলে। কথাটা নীরার খুব ভালো লাগলো।

এমন সময় সুরমা অফিস রুমে ঢোকে। আশিক দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। এর আগেও তাদের কয়েকবার দেখা হয়েছে, মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়। প্রজেক্টের কিছু কিছু ইভেন্টের মিডিয়া কাভারেজ উনিই দেখেন। অনেক সাহসী। এলাকার লোকজন, ডিসি অফিস এসপি অফিসেও ভালো যোগাযোগ আছে।

– দু’দিন ধরেই দেখা করব করব ভাবছি, পেরে উঠছি না। শেষমেশ এখানেই চলে এলাম। ট্রেনিংয়ে কোন অসুবিধা হল না তো?

আশিকের বিনীত জিজ্ঞাসা

-না, আজ সেশন শেষ। রব্বানী সাহেব গুছিয়ে আসছেন, সুরমার উত্তর।

– আজই ঢাকায় ফিরছেন?

– না, কাল সকালে নতুন ডিসি সাহেবের সাথে মিটিং আছে। ওটা সেরে রওয়ানা দেব। চলেন আমরা যেতে যেতে কথা বলি।

রব্বানী সাহেব এসে ঢোকেন। ওনাকে সবকিছু গুছিয়ে নিতে বলে সুরমা আর আশিক অফিস থেকে বেরিয়ে পরে। কয়েকটা ঘর আর দুটো এনজিও অফিস পেরিয়ে ঘাটের মুখে এসে পরে। এটি সি এন্ড বি ঘাট নৌবন্দর, ফরিদপুর জেলার পদ্মা নদীর পাড়ে। খুব ব্যস্ত এলাকা। যৌনপল্লীটা একেবারে ঘাট লাগোয়া, প্রায় ৫ বিঘা আয়তনের জায়গায় কাঁচা ঘর তোলা। এর  ঠিক পিছনেই গোরস্থান। কবে তৈরি হয়েছিল, স্থানীয়রা কেউ আজ আর বলতে পারে না। সাধারনত বন্দরে আসা মানুষগুলো সাময়িক সুখের জন্য এখানে ঢুঁ মারে। তবে  এখানে শহরের বেশ কিছু গন্যমান্য মানুষের যাতায়াত আছে। আছে গোটা দশেক বাবুও। গেটে কর্তব্যরত পুলিশকেও দেখা গেলো। পুরো পল্লীটা থানা থেকে সরাসরি দেখাশোনা করা হয়। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ট্রলারগুলো তখনো আসছে। অনেক লোকজন। ভিড় কাটিয়ে তারা বড় রাস্তায় এসে ওঠে। অফিসের গাড়িটা সেখানে দাঁড় করানো। আশিককে সাথে উঠতে ইশারা করতেই সে বলে ওঠে, “আপনার সমস্যা  না হলে আমরা হাঁটতে হাঁটতে যেতে পারি।” সুরমাও রাজী হয়ে যায়। ড্রাইভারকে হোটেলে ফিরে যেতে বলে তারা দুজন নদীর পাড় ধরে হাঁটতে থাকে।

জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহ। বিকেলের নরম রোদ। শীত শীত ভাবটা এখনো বেশ আছে। সুরমা শালটা একটু টেনে নেয়। আশিকই কথা শুরু করে, “কাল ডিসি সাহেবের ওখানে কি একা যাবেন?”

– না,  সহযোগি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ও রব্বানী সাহেব যাবেন।

– শুধুই কি সৌজন্য সাক্ষাৎ নাকি বিশেষ কোন এজেন্ডা আছে?”

– নতুন এসেছেন, পরিচিতি, প্রকল্প নিয়ে বলা। আর সাথে নির্দিষ্ট একটা সমস্যার বিষয়ে জানানো। গেল বর্ষায় পদ্মার এইপাড় ভাঙ্গা শুরু হয়েছে। কয়েকটা ঘর বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঠেশ দেওয়া আছে। এভাবে ভাঙ্গতে থাকলে এবার অর্ধেক জায়গাই নদীর ভিতরে চলে যাবে। তাই বর্ষা আসার আগেই কিছু একটা যদি করা যায়!

‘‘এদের জন্য আপনার অনেক মায়া?” আশিকের আচমকা প্রশ্ন।

আশিকের এমন প্রশ্নে সুরমা সরাসরি তার দিকে তাকায়। একটু দম নিয়ে বলে, “প্রথমত এটি আমার পেশা। আমার দায়িত্ব এদের মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করা। মৌলিক সেবাগুলো নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করা আর নির্যাতন, নিপীড়ন, স্টিগমা কমানোতে কাজ করা। নতুন নতুন যৌনকর্মী যেন তৈরি না হয় সেই ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করা। দ্বিতীয়ত  এদের এই অবস্থার জন্য এই সমাজই দায়ী। এদের কাছে  আমাদের ঘরের মানুষেরাই আসে । কাজেই আমি আমার দায় অস্বীকার করতে পারি না। আমি এই সমাজের প্রতিনিধি হয়ে সেই দায় কিছুটা হলেও শোধ করতে চাই।”

বলতে বলতে সুরমা কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে, তার চোখ ভিজে ওঠে। সে বলতে থাকে, “একজন নারী একবার কাজ করলে ২০০ টাকা পায়, গড়ে একেকজন দিনে ৮০০ টাকা পায়। সেখান থেকে প্রতিদিন ঘড়ভাড়া, বিজলীবাতি, পানি, গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠানো, সাজগোজ এমন অনেক খরচ আছে। আর যদি ছুকরী হয় তাহলেতো তার কোন কথা নেই, সে তো কেনা দাস। মাসি যা দেবে শুধু তাই খেয়ে বছরের বছর পুরুষের সাথে শুয়ে যেতে হবে যখন বলবে, যতবার বলবে, যার সাথে বলবে। কত সময় বেশি টাকা পেয়ে কনডম ব্যবহার করতেও দেয় না। কথা না শুনলে অকথ্য শারীরিক নির্যাতন।”

একটু থেমে আবার শুরু করে “জানেন, এদের জীবনে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেই একই ঘটনাগুলো যদি আমার জীবনে  ঘটতো তাহলে আমিও এখানেই থাকতাম। আজকের এই ‘আমি’র জন্য আমার নিজের কোন কৃতিত্ব নেই।”

আশিক অবাক হয়ে সুরমার কথা শুনতে থাকে। কথাগুলো সে জানে কিন্তু  এভাবে সে অনুভব করেনি আগে কখনো। তার গায়ে কাঁটা দেয়। সে কথা ঘোরানোর জন্য বলে, জসীম মেলা হচ্ছে , যাবেন?

– কোথায় হচ্ছে? সুরমা জানতে চায়

– এইতো কাছেই অম্বিকাপুরে, পল্লী কবির বাড়ীর সামনে “জসীম উদ্যানে” ।

সুরমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। যখন সে কেবল গোটা বাক্য বলা শিখেছে আম্মু তখন শিখিয়েছিল  পল্লীকবির কবর কবিতা। প্রথম ছয় লাইন এখনো মনে আছে।

এইখানে তো দাদীর কবর ডালিম -গাছের তলে,

তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।

এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মত মু্‌

পুতুলের বিয়ে ভেঙ্গে গেলো বলে কেঁদে ভাসাইতো বুক।

এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,

সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর  ছড়াইয়া দিল কারা।

সুরমা আর আশিক একটা ব্যাটারীচালিত অটোরিক্সা নিয়ে নেয়। অম্বিকাপুরে পৌঁছে দেখে মহাসমারোহ, বিশাল মেলার আয়োজন আর হরেক পসরা । পল্লী কবির বাড়ির উঠোন, কবর, ঘরগুলোতে ছেলে মেয়ে নাতি নাতনির ছবি। সুরমা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে।

হোটেলে ফিরতে রাত ৮টা হয়ে গেল। গোসল সেরে রুমেই রাতের খাবার দিতে বলে বাসায় আম্মুকে ফোন দেয়। সারাদিন কী কী হল সব খুঁটে খুঁটে জানতে চাইলো। ডিনার শেষে ডিসি সাহেবের মিটিংয়ের টুকটাক প্রস্তুতি, রাতের প্রসাধন শেষে ঘুমুতে গেল রাত ১০ টায়। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই প্রিন্সেসের কথা মনে হল। মেয়েটাকে একাধারে সে ভয় পাচ্ছে, আবার মেয়েটি তাকে টানছেও। কি করছে এখন মেয়েটি?

সুরমার মনে পড়ে যায়  ১১ বছর বয়সে সে ক্লাস ফাইভে পড়তো, স্কুল ড্রেস জুতা মোজা পরে, দুই বেনী দুলিয়ে সে স্কুলে যেত। বিকালে কম্পাউন্ডের মধ্যে অন্য বাসার বাচ্চাদের সাথে খেলতো। তখনো আম্মু তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিত। প্রিন্সেস মেয়েটারওতো তেমনটি করার কথা অথচ… সে আর ভাবতে পারে না, তার গলা ধরে আসে।

সকালে ডিসি অফিসে গিয়ে দেখে সহযোগি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রাকীব ভাইয়ের সাথে আশিকও এসেছে। জনাব আতিকুল ইসলাম পদোন্নতি পেয়ে ডিসি হয়ে প্রথমেই ফরিদপুরে পোস্টিং। কাঁটায় কাঁটায় ১০টায় ওনারা ডিসি সাহেবের রুমে ডাক পেলেন। পরিচিতি পর্বেই মনে হল ইনি বেশ ইতিবাচক মানুষ। চা নাস্তার কথাও বললেন, সুরমার মনে হল ভদ্রলোক সময় দেবেন। কথা বলার বিষয় জানানোর পর তার মনে হল তিনি সুরমাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, হয়তো কিছুটা জাজ করতেও চাচ্ছেন। সরাসরি প্রশ্ন করলেন,

– আপনি কি বিবাহিত?

সুরমা জানে এই প্রশ্ন অবান্তর,  অন্য সময় হলে কঠিন জবাব দিত, কিন্তু এখন সে তা করবে না। বরং কথা বলে যদি ডিসি সাহেবকে কিছুটা সহমর্মী করা যায় তাতে এই  প্রোজেক্টের কাজে আসবে। তার শান্ত উত্তর- জি না।

– বাবা কি করেন?

– বাবা রোডস এন্ড হাইওয়ে’র ইঞ্জিনিয়ার। মা কলেজে পড়ান।

– ও আচ্ছা, ভেরি গুড।

– পরের প্রশ্ন করলেন না? মানে স্যার, বাবা রোডস এন্ড হাইওয়ে’র ইঞ্জিনিয়ার শুনলেই সবাই প্রশ্ন করে “তাহলেতো তোমাদের বাসায় বস্তায় করে টাকা আসে, তাইনা?” সুরমার জিজ্ঞাসা।

ডিসি সাহেব হেসে ফেলেন, বলেন, পড়াশোনা কোথায় করেছেন?

– পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন, চিটাগাং উনিভার্সিটি

– বলেন কি! আমিওতো চবি’র, মাস কমিউনিকেশনে ছিলাম। আপনি তো প্রশাসনে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারতেন!

একই বিশ্ববিদ্যালয় শুনে সুরমা কিছুটা ভরসা পায়।  বলে, জি স্যার, সেই প্রস্তুতিই নিচ্ছিলাম। মাস্টার্সের পরে একদিন ডিপার্টমেন্টের এক শিক্ষক বললেন একটা রিসার্চের জন্য নারী এসিস্ট্যান্ট খুঁজছেন। আমিতো রেজাল্টের অপেক্ষায় ছিলাম। রাজী হয়ে গেলাম। সেই প্রথম একটি যৌন পল্লীতে রিসার্চের কাজে গেলাম। ১৫ দিন একটানা কাজ করলাম, আগে পরে প্রচুর  পড়াশোনা করতে হল। আর এটাই আমাকে বদলে দিল। বাসায় ফিরে আমি অস্থির হয়ে পড়লাম। বারবার মনে হচ্ছিল আমি যখন ম্যাজিস্ট্রেট হবার স্বপ্ন দেখছি, তখন অন্য নারীকে যৌনকর্মকে পেশা হিসাবে নিতে হচ্ছে। দুই সপ্তাহ পর আমি স্থির হলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম আমি এই নারীদের জন্য কাজ করব।  একটা  আন্তর্জাতিক সংস্থায় ঢুকলাম, সেই থেকেই আছি।

– এবার বলেন আমি আপনাদেরকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি? আমি নতুন এসেছি, এখনো এখানকার সবকিছু জানিনা। সাংবাদিক আশিক এবার মুখ খুললেন,

– স্যার, ফরিদপুর শহরে ২টা যৌনপল্লী, একটা শহরের কেন্দ্রে- রথখোলা যৌনপল্লী, আরেকটা সি এন বি ঘাটে। আমরা এই মুহুর্তে সি এন্ড বি ঘাট যৌনপল্লীর সমস্যা নিয়ে বলতে এসেছি। গেল বর্ষায় পদ্মার এইপাড় ভাঙ্গা শুরু হয়েছে। কয়েকটা ঘর বাঁশের খুঁটি  দিয়ে ঠেশ দেওয়া আছে। এভাবে ভাঙ্গতে থাকলে এবার অর্ধেক জায়গাই নদীর ভিতরে চলে যাবে। ওপাশে ঘর বাড়ানোর কোন জায়গা নাই কারন সেখানে গোরস্থান।  তাই বর্ষা আসার আগেই যদি কিছু একটা ব্যবস্থা করা যায় সেই জন্য আপনার কাছে আসা।

ডিসি সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, যৌনপল্লীর পাশে গোরস্থান? মেয়েগুলোর ভয় করে না? এই যে এত পাপ কাজ করছে , সেগুলোর হিসেব? গোরস্থান দেখে ওদের মরার কথা মনে হয় না?

– খদ্দেরগুলোকে গোরস্থানের দিকে তাকিয়েই মেয়েদের ঘরে ঢুকতে হয়, স্যার। পাপবোধ তাদের হয় না?

সুরমার স্থির গলায় প্রশ্ন।

– কিন্তু মিস সুরমা, গোরস্থানের দাফন করা আত্নাগুলোরতো কষ্ট হচ্ছে। দোয়া-কলেমার পরিবর্তে পাপকাজ সারাক্ষণ তাদেরকে দেখতে হচ্ছে। এমন কী করে হয়?

ডিসি সাহেব অস্থির হয়ে উঠলেন।

এবার রাকীব ভাই বললেন, কবে কিভাবে যৌনপল্লী তৈরি হয়েছে কেউ বলতে পারে না, স্যার। তবে বিষয়টা ভাবলে অন্যরকম লাগে। একপাশে বন্দর, জীবন্ত মানুষের চুড়ান্ত ব্যস্ততা, আর অন্য পাশে মৃত মানুষের শেষ ঠিকানা।

– বিষয়গুলোর কি দেখার কেউ নেই? ডিসি সাহেবের আবার প্রশ্ন

– স্থানীয় থানার দায়িত্বেআছে, রাকীব ভাই বললেন।

আমার অন্য একটা মিটিং আছে, আপনাদের কাছে কাগজপত্র যা আছে দিয়ে যান। আমি ওগুলো স্টাডি করি। পরে আপনাদের ডাকব। ডিসি সাহেব সুরমাকেও বললেন, কোন প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবেন।

সুরমাও ধন্যবাদ জানানোর জন্য উঠে দাঁড়িয়ে বলে, স্যার অনেকগুলো শিশু আছে এখানে। তার মধ্যে মেয়েও আছে। এরা মাদক পাচারের সাথে জড়িয়ে যাবে, চুরি করবে আর মেয়েগুলো আবার নতুন যৌনকর্মী হবে। এই শিশুগুলোকে রক্ষা করারও ব্যবস্থা করা দরকার। আমরা আবার আসবো আপনার সহযোগিতার জন্য।

ধন্যবাদ জানিয়ে সবাই বেরিয়ে আসে।

হোটেলে ফেরার আগে সি এন্ড বি ঘাট হয়ে যাবে, প্রিন্সেসের সাথে একবার কথা বলতে চায় সে। রাকীব ভাইও আশিক সাহেবসহ ওইদিকে রওয়ানা হয়।  ঘাটের কাছে গাড়ি থেকে নামতেই মনে হল কে যেন তার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে, “সুরমা আন্টি  দাঁড়ান, আমি আসতেছি।”

হোটেলে ফেরার আগে সি এন্ড বি ঘাট হয়ে যাবে, প্রিন্সেসের সাথে একবার কথা বলতে চায় সে। রাকীব ভাইও আশিক সাহেবসহ ওইদিকে রওয়ানা হয়।  ঘাটের কাছে গাড়ি থেকে নামতেই মনে হল কে যেন তার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে, “সুরমা আন্টি  দাঁড়ান, আমি আসতেছি।”

সুরমা  খেয়াল করে দেখলো ব্রোথেলে ঢোকার মুখের কাছে নদীতে কয়েকটি ছেলেমেয়ে গোসল করছে। তাদের থেকে একটি মেয়ে চিৎকার করছে। সে বুঝতে পারে এটা স্বর্না, রুবিনা নামে এক যৌনকর্মীর মেয়ে।  ক্লাস ফোরে পড়ে এনজিও স্কুলে, সুরমার খুব ভক্ত। অফিস রুমে বসতেই রুবিনা আসে।

– আফা আপনের লগে একটু কথা কইতে চাই।

আশিক আর রাকীব ভাই অন্য রুমে চলে যেতে চায়। কিন্তু সে তাদেরকে থাকতে বলে।

“আফা, আমার স্বর্নারে বাঁচান, স্যার  আমার মাইয়াডারে বাঁচান। হুরীর ঘরের বাবুর চোখ পড়ছে আমার মাইয়াডার উপ্রে। অহন কি করতাম বোজদে পারি না। গেরামেও তেমন কেউ নাই যার কাছে পাডাইতে পারি।”

বলেই সে কান্না শুরু করে। সুরমার  অস্থির লাগে। রাকীব ভাই পরিস্থিতি বুঝে কথা বলে, “রুবিনা আপা, আমরা দেখছি কি করা যায়। এখানে সরকারি আশ্রয় কেন্দ্র আছে, আবার অনেক জায়গায় বেসরকারি আশ্রয় কেন্দ্রও আছে। আমরা যোগাযোগ করে জানাব।”

এর মধ্যে স্বর্না কাপড় বদলে অফিস রুমে এসে ঢুকেই সুরমাকে জড়িয়ে ধরে, চুল থেকে তখনো টপটপ করে পানি পড়ছে।

প্রিন্সেসের সাথে আর দেখা হয়না। তার আজ অনেক কাস্টমার।

কিছুটা অস্থিরতা নিয়েই হোটেল থেকে চেক আউট করে ঢাকার পথে রওয়ানা হয় সুরমা।

(চলবে…)

পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব- পর্ব-২: খানকিগো আবার দাফন কীসের?

পর্ব-৩: টাঙ্গাইলের পুণ্যভূমিতে পাপীষ্ঠাদের আর জায়গা হবে না

পর্ব-৪: ‘ভালো হইতে চাইছিলাম, দিলেন কই?’

পর্ব-৫: ‘আমরা তো খারাপ কাজ করি, তাই দোয়া চাই আল্লাহর কাছে’

পর্ব-৬: ‘পিন্দনের কাপড় খুইলা টাকা কামাই, পিন্দনেরই কাপড় কেনার লাইগা’

পর্ব-৭: ‘সমাজে যেমুন ব্যাডারা বউরে পিডায়, আমাগোও বাবুরা মারে’

পর্ব-৮: ‘সারাদিন ভালবাসলো, সন্ধ্যায় যৌনপল্লীতে নিয়া বেইচা দিয়া গেল’

পর্ব-৯: ‘‘এই যৌনপল্লীর মাইয়াগো উন্নতি করতে চাই”

পর্ব-১০: “একজন খদ্দের না পাইলে ভাত পাবো কোম্মে”

পর্ব-১১: ‘আমি ভালোবাসি মাইয়াগো, ব্যাডাগো সাথে শুইলে আমার গা গোলায়!’

পর্ব-১২: “এসএসসি’র নিবন্ধনের সময় মাইয়ারে নিজের বইলা স্বীকৃতি দিলো”

পর্ব-১৩: “যৌনপল্লী না থাকলে সমাজে কোন পরকীয়া, সুইসাইড থাকবে না”

পর্ব-১৪: টিকে থাকাই জীবন, বেঁচে থাকাই জীবন

পর্ব-১৫: যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, বঙ্গবন্ধুরে মারল; এইসবের মইধ্যেও ওগো মাইয়া মাইনষের শরিল লাগে

শেষ পর্ব: আমার আকাশে পাখি হয়ে উড়বেন?