November 2, 2024
সম্পাদকীয়

করোনা দুর্যোগে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ নারী, তার পাশে থাকুন!

শারমিন শামস্।। সকালে উঠে অনলাইনে দেশি বিদেশি সংবাদপত্র ঘাটা আমার পুরোনো অভ্যাস। এখন চারিদিকেই করোনা ভাইরাসের খবর। বিশ্বের কোথায় কী পরিস্থিতি, দেখছিলাম। চোখে পড়ল কয়েকটা রিপোর্ট এবং আর্টিকেল। করোনা ভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বেশি ভালনারেবল পরিস্থিতিতে পড়ছে নারী।

তো হিসাবটা সাধারণ। যুদ্ধ, মহামারী, দুর্যোগে নারীকেই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হতে হয়। সব কিছুর দায় সিংহভাগ বহন করতে হয় নারীকেই। বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাটিও সেক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম কিছু করবে না।

করোনা পরিস্থিতিতে নারী কীভাবে বেশি সমস্যাগ্রস্থ হবে, তার অনেকগুলো কারণ বা দিক আছে। অস্ট্রেলিয়ার মেডিকেল জার্নাল The Lancet এ  COVID-19  আউটব্রেকের জেন্ডার ইম্প্যাক্ট নিয়ে একটা প্রবন্ধ প্রকাশ হয়েছে। প্রবন্ধের শেষ কথাটি হল, এর আগে যতগুলো মহামারী দেখা দিয়েছে, তার জন্য সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয়েছে নারীকে। উদাহরণ হিসেবে বলা হচ্ছে ২০১৪-১৬ তে পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলার প্রাদুর্ভাবের কথা। সে সময় নারীকেই রোগীর সেবা করতে হয়েছে বেশি, সেটা পেইড বা আনপেইড দুই ক্ষেত্রেই। ফলে ভাইরাসে আক্রান্তও হয়েছে নারীই বেশি।

চীনের শতকরা ৯০ ভাগ স্বাস্থ্যকর্মীই নারী। এবারের করোনা কান্ডের সময় তাই পুরুষের চেয়ে সেখানে নারীর ঝুঁকি অবধারিতভাবে বেশি। এমনকি নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের বিষন্নতা ও দুশ্চিন্তার হারও বাড়ছে, বলছেন গবেষকরা।

অস্ট্রেলিয়ায় হেলথকেয়ার ও সোশ্যাল অ্যাসিসটেন্স সেকটরে নারী কর্মী শতকরা ৭৯.৯ ভাগ। স্বাভাবিকভাবে আশংকা করা হচ্ছে, এই ভাইরাসে পুরুষের চেয়ে নারীর মৃত্যুহার বেশি হবে।

এ তো গেলো, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নারীর ঝুঁকির কথা। বলা হচ্ছে, অর্থনৈতিকভাবে নারী পুরুষের চেয়ে দুর্বল। ফলে কোভিড-১৯ এ নারী আক্রান্তও হবে বেশি। কারণ ভাইরাস থেকে বাঁচতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া অনেকক্ষেত্রেই সম্ভব হবে না অর্থনৈতিক কারণে। করোনা নারী পুরুষ নির্বিশেষে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলদের চাপে ফেলবে। এই চাপ আরো বেশি নারীর, কারণ বিশ্বজুড়েই নারী পুরুষের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর।

আমরা  করোনা পরিস্থিতিতে ঘরে বসে অফিস করবার কথা ভাবছি। করছিও। কলকারখানায় সরাসরি শ্রম দেন যে শ্রমিকরা, তাদের পক্ষে এটি করা অসম্ভব। উন্নত দেশগুলো করোনায় গৃহবন্দী থাকার সময়টিতে নাগরিকের খাওয়া পরা এমনকি বাড়ি ভাড়ার দায়িত্বও নিচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের মত দেশগুলোতে সরকারের পক্ষে এ দায়িত্ব নেয়া কখনোই সম্ভব হবে না।

ফলে বিরাট অংশ শ্রমিককে পেটের দায়েই বেরুতে হবে বাড়ি থেকে। বিশেষ করে গার্মেন্টস সেক্টরে যে মেয়েরা কাজ করে, কাজের ঘরে গাদাগাদি করে দীর্ঘসময় কাটায়, গণপরিবহন ব্যবহার করে, করোনার ঝুঁকি অবধারিতভাবে তাদের বেশি হবে, বলাই বাহুল্য।

শুধু গার্মেন্টস নয়, সারা পৃথিবী জুড়েই বিপুল অংশ নারী বিভিন্ন কলকারখানায় কাজ করে। নারী কাজ করে দোকানে সেলসে, কাজ করে স্কুলে কলেজে। ফলে কারখানা, অফিস, দোকান, স্কুল বন্ধ হলেও কাজ হারিয়ে বিপদে পড়বে নারী, আবার বন্ধ না হলেও বিপদে পড়বে। বলে রাখি, নারী পুরুষ সবাই এই দুর্যোগে আক্রান্ত হচ্ছে, হবে। কিন্তু নারীর ঝুঁকি ও দায়িত্ব অনেক বেশি পুরুষের চেয়ে।

এখন আসি গৃহস্থালী দায়িত্বের বোঝা বাড়ার বিষয়ে। করোনার প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার পরই আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ায় শাট ডাউন শুরু হয়ে গেছে। একটি বিশাল অংশ জনসাধারণকে সর্বক্ষণ আটকে রাখতে হচ্ছে বাড়িতে। বন্ধ হয়েছে শিশুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিনোদন পার্ক, লাইব্রেরি, সিনেমা হল, প্রার্থণালয়সহ সব কিছু। বাংলাদেশেও বন্ধ ঘোষণা হল স্কুল কলেজ। সেই সাথে অফিস আদালতেও ভিড় কমিয়ে ফেলা হচ্ছে। যতটা সম্ভব বাসা থেকেই অফিস করছেন কর্মীরা, যেসব ক্ষেত্রে সম্ভব আর কি।

নারীকেই যেহেতু সংসারে গৃরস্থালী কাজের বড় অংশ সামলাতে হয়, বিশেষ করে শিশুর দেখাশোনা, তাই করোনার এই দুর্যোগে স্কুলগামী শিশুরা যখন গৃহবন্দী, তখন নারীর ওপর গৃহস্থালী কাজের চাপ বাড়বে। বিশেষ করে আমাদের দেশের পুরুষরা যখন একেবারেই গেরস্থালী কাজ বিমুখ, উল্টো তাদেরই দেখাশুনা আর খেদমত করা লাগে; এদিকে শিশুর পাশাপাশি তারাও যখন ঘরে ২৪ ঘণ্টা অবস্থান করবেন তখন অবধারিতভাবে নারীর ওপর বাড়তি কাজের বোঝা চাপবে, যদি না সঙ্গী পুরুষটি তাকে সাহায্য করেন।

আমেরিকায় চলতি বছর জানুয়ারিতে করা এক জরিপ বলছে, ঘরে শিশুর যত্ন নেয়ার কাজ পুরুষের চেয়ে নারী সাত গুন বেশি করেন। ধারণা করা হচ্ছে, একের পর এক শাট ডাউনের ফলে নারীর এই পরিশ্রম আরো বাড়বে। কারণ স্কুল ও ডে কেয়ার বন্ধ থাকায় শিশুরা সারাক্ষণ বাসায় থাকবে, যাদের পরিচর্যার ভার পড়বে নারীর ওপরই।

নারীর মজুরিহীন গেরস্থালী কাজ তো গুরুত্বই পায় না। বাংলাদেশে আরো বেশি। অথচ নারী ঘুম থেকে ওঠে সবার আগে। পরিবারের জন্য খাবার তৈরি, ঘর পরিস্কার, শিশু পালন, বৃদ্ধদের সেবা, পরিবারের প্রতিটা সদস্যের দেখাশোনার পাশাপাশি শিশুকে স্কুল থেকে আনা নেয়া, বাজার সদাই প্রায় সবই করতে হয় তাকে। নারী কর্মজীবী হোক বা না হোক, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এইসব কাজের ভার সবসময়ই তার। বিশেষ করে গেরস্থালী ও শিশুপালনের কাজগুলো।

এখন এই করোনা পরিস্থিতিতে ঘরের ভেতরে নারীর দায়িত্ব আরো বেশি। ঘরের লোকজন সুস্থ থাকলে তো বটেই, আবার শিশু বা আর কেউ যদি অসুস্থ হয়, তাহলে নারীর ওপর সবচেয়ে বড় দায়িত্বের বোঝা চাপবে। কারণ সেবার কাজটি নারীকে দিয়েই করানো হয়। সেক্ষেত্রে নারী নিজে অসুস্থ হলে কয়টি পরিবারে অসুস্থ নারীটির যথাযথ সেবা হয়, সেটিও অনুসন্ধানের দাবি রাখে বৈকি।

করোনার এই দুর্যোগ মুহুর্তে তাই পুরুষদের বলতে চাই, এটি সামলে নিতে হবে সবাই মিলে। দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হবে নারী পুরুষ সবাইকে। গেরস্থালী কাজকে তুচ্ছ করে দেখার কোন ‍সুযোগ নেই। প্রাগৈতিহাসিক মানসিকতা ধরে রাখারও পরিস্থিতি নেই। সেবা ও শিশু পালনে নারীকে সহায়তা করুন। নারীর শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও নজর রাখুন। ঘরে আছেন মানেই এই না দফায় দফা চা বিস্কিট হুকুম করবেন। ভাল ভাল খাবার চাইবেন লাঞ্চে আর ডিনারে। ঘরে কেউ অসুস্থ হলে নারীকে একাই ঠেলে দেবেন না রোগীর ঘরে। মনে রাখবেন, পুরুষ বা নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে এই কঠিন পরিস্থিতি সামলাতে হবে সবাইকে।

ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।