স্বামী কি কখনও ধর্ষক হতে পারে?
রাজনীন ফারজানা।। একবার এক মেয়ের কাছে শুনেছিলাম তার প্রথম যৌন অভিজ্ঞতার কথা। পনেরো বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। বাসর রাত, মেয়ের বাড়ি। ছোট মেয়ের প্রতি যেন জুলুম না হয় তাই বিয়ের রাতে বর বউয়ের মাঝখানে মেয়ের বুড়ো দাদী ঘুমাবে এমন সিদ্ধান্ত হয়। গভীর রাতে মেয়ে চিৎকার করতে করতে বাড়ির বারান্দার গ্রিল খুলে দৌড়াতে দৌড়াতে উঠোনে এসে অজ্ঞান হয়ে যায়।
আর একটা মেয়ের কাছে শুনেছি বিয়ের রাতে পিরিয়ড চলছিল তার। গ্রামের মেয়ে। স্বভাবতই কাপড় ব্যবহার করে। বিয়ের সময় তার বয়স পনেরো-ষোল হবে। বাসর রাতে স্বামী তার ‘মাসিকের ন্যাকড়া’ ছুঁড়ে ফেলে সম্ভোগ করে তাকে। পূর্বোক্ত মেয়েটির মত সে অবশ্য বাবার বাড়ি নয়, শ্বশুরবাড়ি ছিল। তাই তাকে চুপচাপ পড়ে থেকে ‘ব্যথা’ সহ্য করতে হয়।
দুজনের সঙ্গেই আমার কথা হয়েছে ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর। মজার ব্যাপার হচ্ছে দুজনই আমাকে বলেছে যৌনতা খুব একটা আনন্দের জিনিস না। অথচ এমন কি হওয়ার কথা ছিল?
দুজন কিশোরী, যারা বাল্যবিয়ের শিকার। নিজের শরীর মন চিনে ওঠার আগেই, যৌনতা কী বুঝে ওঠার আগেই নিদারুণ অপমানজনক ঘটনার শিকার। পরবর্তী জীবনে সন্তানের মা হওয়ার পরেও তারা বোঝেই না যৌনতায় নারীও আনন্দ পেতে পারেন। বিষয়টি শুধুই পুরুষের জন্য সুখের নয়। তারা জানেওনা নারীর জন্ম শুধুই পুরুষের সুখের জন্য হয়নি।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের যৌনতা বিষয়ক জ্ঞানার্জন হয় ‘বড়দের’ উপন্যাস অথবা নাটক সিনেমা থেকে। এটুকু সুবিধাও যারা পায়না তাদের শেখে দাদী-নানী বা বড় আপু, ভাইয়া অথবা ভাবীর থেকে শুনে। যে যেভাবেই শিখুক না কেন, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে একটাই শিক্ষা পায় আর তা হল, যৌনতার নিয়ন্ত্রণ পুরুষের হাতে। মেয়ে মানেই যেন ইচ্ছা করুক বা না করুক, বিয়ে হওয়ার পর থেকেই স্বামী যখন চাইবে তখনই নিজেকে তার নিচে সঁপে দিয়ে চুপচাপ পড়ে থাকতে হবে।
এইসব ভুল শিক্ষার ফলেই এদেশের ঘরে ঘরে মেয়েদের বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হতে হয়। পুরুষ যেমন জানে না, জোর করে যৌন সম্পর্ক অন্যায়, নারীও জানে না বিয়ে মানেই তাকে শরীর বিলিয়ে দেওয়া লাগবে বিষয়টা এমন নয়।
বাল্যবিয়ের কথা তো বললাম। উচ্চশিক্ষিত, কর্মজীবী নারীকেও কি বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে না?
এক ব্যাংকার আপুর কথা শুনেছিলাম যিনি দীর্ঘদিনের ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করে কীভাবে স্বপ্নভঙ্গের শিকার হয়েছিলেন। তার প্রেমিক প্রবর বিয়ের রাতেই তার ভুতপূর্ব প্রেমিকাকে জোর করে ওরাল সেক্সে বাধ্য করে। তিনি বমি করে দেন। কিন্তু তারপরও আবার তাকে সে রাতে একই কাজ করতে হয়। বিষয়টি তিনি সংস্কৃতিগত কারণেই হোক বা যে কারণেই হোক, কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারেননি।
এভাবে অনেক মেয়েকেই তার সম্মতি ছাড়াই স্বামীর সঙ্গে যৌনমিলনে বাধ্য হতে হয়। বিয়ের পরে হোক কি আগে, সম্মতিহীন যৌনমিলন মানেই তা ধর্ষণ। শুধু নারীর ক্ষেত্রেই নয়। একই কাজ যদি কোন নারী করেন তার পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে সেটিও ধর্ষণ বলেই বিবেচিত হবে।
বৈবাহিক ধর্ষণ শুনলেই অনেকেই রে রে করে তেড়ে আসবেন। স্বামী কখনও ধর্ষক হতে পারে? তাই কি হয়? স্বামী মানেই তো অবাধ যৌনতার অধিকার। আর স্ত্রী মানেই সবসময় সব আচরণে সম্মতি দিতে বাধ্য। তাহলে?
আমাদের যৌনশিক্ষার অভাব, কুশিক্ষা, ধর্মন্ধতা, গোঁড়ামি, পিতৃতন্ত্র আমাদের এভাবেই শেখায়। কিন্তু এটাই সত্য, বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া মানেই সঙ্গীকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে যৌনতায় বাধ্য করা না। স্বামী স্ত্রী হলেও সঙ্গীর না মানে এক্ষেত্রেও না। এখানে জোর করার কোন সুযোগ নেই। জোর করলে সেটা ধর্ষণ। তারা বিবাহিত হলেও। এটিই বৈবাহিক ধর্ষণ।
বিয়ে মানেই স্বামী কিংবা স্ত্রী শুধুই যৌনতার জন্য সম্মতি দিচ্ছেন বিষয়টা তা না। দুজন মানুষ একে অন্যের সঙ্গে থাকার জন্য বিয়ে করেন। একটি সার্থক বিয়ের জন্য সব বিষয়েই বোঝাপড়া দরকার। কিন্তু অনেক পুরুষই আছেন যারা যৌনতার ক্ষেত্রে নারীর সঙ্গে কোন ধরনের বোঝাপড়া তো দূরের কথা, তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালো লাগা মন্দ লাগা কিংবা মতামত সম্পর্কে জানতেও আগ্রহী নন। এমনকি ঋতুস্রাব চলাকালীনও স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌন সঙ্গমে তাকে বাধ্য করেন বহু পুরুষ। অনেক ক্ষেত্রে প্রসূতি মাকেও রেহাই দেয়া হয় না। সন্তান জন্মের পর শারীরিক সুস্থতা বা মানসিক প্রস্তুতির আগেই স্বামীর আহ্বানে সাড়া দিতে বাধ্য হন বহু নারী। এটি নিশ্চিতভাবে বৈবাহিক ধর্ষণ। আর এই সমাজ এটি নিয়েই কথা বলতে নারাজ। স্বামীর এই ধর্ষক রূপটিকে বৈধ করা হয় মিথ্যাচার আর অশিক্ষার আবরণে। এমনকি বৈবাহিক ধর্ষণ নিয়ে কোন আইনও নেই। মানে এটিকে অপরাধ হিসেবেই গণ্য করা হয় না। তাই স্বামী দিনের পর দিন স্ত্রীকে জোর করে যৌনতা স্থাপন করলেও তিনি শাস্তির বাইরে। স্ত্রী এক্ষেত্রে অভিযোগ করলেও লাভ নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত স্বামীর বোধদয় না হচ্ছে।
অনেকসময় অনেক নারীকে শারীরিকভাবে মারধোর ও অন্যান্য নির্যাতনেরও শিকার হতে হয় স্বামীর সঙ্গে যৌন মিলনে রাজী না হলে। এটি সারাবিশ্বেই নারীর প্রতি গৃহ সহিংসতার অন্যতম কারণ। স্বামীর যখন ইচ্ছে তখন যৌনচাহিদা হলেই তা মেটাতে বাধ্য না থাকলে বা উদ্ভট কোন দাবি না মেটাতে পারলে অনেক মেয়েকেই অসম্ভব নির্যাতন ও অপমানের শিকার হতে হয়।
আসুন জেনে নেই কোন কোন কাজগুলো করলে তা বৈবাহিক ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হবে-
• জোর করে যৌন মিলন
• শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে
• অন্য নারীর কাছে চলে যাওয়ার হুমকি দিয়ে
• ঘুমন্ত, অচেতন, অসুস্থ অথবা সম্মতি দেওয়ার অবস্থায় নাই এমন শারীরিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে
• নির্ভরশীল স্ত্রীকে টাকা না দেওয়ার হুমকি অথবা নিকটজনের ক্ষতি করার ভয় দেখিয়ে
• স্ত্রী যৌনতায় আনন্দ পান বা না পান, নিজেকে স্বামীর কাছে সপে দেওয়া ছাড়া যখন আর কোন উপায় থাকে না
সম্মতিহীন যৌনতা পুরুষ ও নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই ধর্ষণ। কিন্তু আমাদের সমাজে সাধারণত নারীকেই বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরুষ মনে করে স্ত্রীর সঙ্গে যখন যেভাবে ইচ্ছা যৌন সম্পর্ক করা তার অধিকার। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যৌনতা কোন অধিকার নয়। এটি একটি প্রয়োজন। আর প্রয়োজন মেটানোর জন্য জোরজবরদস্তি নয়, সঙ্গির প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা প্রদর্শন জরুরি। যৌনতায় সম্মতি যেমন বৈবাহিক জীবন সুখের করতে ভূমিকা রাখে, তেমনি সম্মতিহীন যৌনতা একজন নারীর জীবন নরক বানিয়ে তোলে।
রাজনীন ফারজানা: সাংবাদিক