এলিফ শাফাকের তিন উপন্যাস: কুসংস্কার-কুপ্রথা থেকে নারীর মুক্তি কবে?
উম্মে ফারহানা।। ঘটনাটি কাকতালীয় হতে পারে, গত বছরে এবং এ বছরের শুরুতে আমার পড়া উপন্যাসগুলোর মধ্যে প্রায় সবগুলোই নারী লেখকদের লেখা। সম্পূর্ণ তালিকা দিচ্ছি না, যাদের লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি তাদের নাম উল্লেখ করছি।
নাইজেরিয়ান লেখক চিমামান্দা ন’গোজি আদিচি, বুচি এমেচেতা এবং তুরস্কের লেখক এলিফ শাফাক। মার্গারেট অ্যাটউড আর টনি মরিসনের একাধিক উপন্যাস পড়লাম, কিন্তু কিংবদন্তী হয়ে যাওয়া এই লেখকদের সম্পর্কে মুগ্ধতা নতুন করে বলার কিছু নেই। বুচি এমেচেতাসহ আফ্রিকার আরো দুই একজন নারী লেখকের, বিশেষত আদিচির তিনটি উপন্যাস আর একটি গল্প সংকলন নিয়ে আলাদা করে লেখার ইচ্ছা আছে। তাই আজকে শুধুমাত্র এলিফ শাফাকের উপন্যাস নিয়েই একটু আলাপ করবো।
এলিফ শাফাকের প্রথম উপন্যাস দ্য বাস্টার্ড অফ ইস্তাম্বুল, এই বইয়ে আর্মেনিয়ান জেনোসাইড সম্পর্কে লেখার জন্য তিনি রাষ্ট্রদোহী উপাধি পান, একটি মামলাও হয়েছিল। মূল গল্প আসিয়া নামের একটি পিতৃপরিচয়হীন মেয়েকে নিয়ে। চার বোন, তাদের মা আর দাদীকে নিয়ে যে পুরুষবিহীন সংসার সেখানে সবচেয়ে ছোট মেয়ে জেলিহার গর্ভে জন্ম নেয় আসিয়া। অন্যান্য খালাদের মতন মাকেও খালা বলেই ডাকে, যদিও জানেন সবচেয়ে ছোট খালাটি আসলে তার মা। উনিশ বছরের আসিয়া এক বিবাহিত লোকের সঙ্গে সম্পর্কিত, কার্টুনিস্ট ভদ্রলোককে সে খুব ভালোবাসে এমন নয়, কিন্তু জীবন সম্পর্কে তার যে উদাসীনতা, যা প্রায় তাচ্ছিল্যের পর্যায়ে চলে গেছে তাতে বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে তার খালি ফ্ল্যাটে গিয়ে গাঁজা টানা আর সেক্স করা তার জন্য খুব গুরুতর ঘটনা নয়। আসিয়ার একমাত্র মামা, যিনি আমেরিকা প্রবাসী এবং সেখানেই এক মার্কিন নারীকে বিয়ে করে থিতু হয়েছেন, সেই মামার স্ত্রীর আগের পক্ষের মেয়ে ইস্তাম্বুলে বেড়াতে এলে সবকিছু উলটে পালটে যেতে থাকে। আসিয়ার মায়ের পরিবারের কোন পুরুষ চল্লিশ বছরের বেশি বাঁচে না। কোন এক অজ্ঞাত অভিশাপে মারা যান মাঝবয়সেই। সৎ কন্যাকে ফেরত নিতে আসা সেই মামাই যে আসলে আসিয়ার জনক সে কথা বোঝা যায় একেবারে শেষের দিকে।
অনার উপন্যাসের প্লট তুরস্কের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে লন্ডন, কিছু অংশ আরবের মরুতে। এখানে মূল বক্তা এসমা, গল্পটা এসমার মা পেমবে কাদের আর তার যমজ বোন জামিলা ইয়েতেরের। পেমবে আর জামিলার মা পুত্র সন্তান হতেই হবে ধরে নিয়ে একের পর এক কন্যার জন্ম দিয়ে যান। পেমবে নিজের পুত্র ইসকেন্দরের জন্ম নিয়ে খুব উচ্ছসিত ছিলেন, সেই ছেলে যে তাকে ছুরিকাঘাত করে জেল খাটবে তা পেমবে দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। মায়ের সঙ্গে এলিয়াস নামের এক শেফের সখ্য হয়েছে বলে ইসকেন্দর পরিবারের ‘সম্মান’ রক্ষা করতে এই কাজ করে। মা একেবারে মরেই যাবে- এ কথা সে নিজেও ভাবেনি।
টেন মিনিটস থার্টি এইট সেকেন্ডস ইন দিস স্ট্রেইঞ্জ ওয়ার্ল্ড বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র টেকিলা লেয়লা একজন দেহপসারিনী। একটা ময়লার বাক্সে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করা হয়েছে তাকে। লেয়লাকে নিয়ে মোট চারজন বেশ্যা এভাবে খুন হলেন। গ্রাম থেকে ইস্তাম্বুলে এসে বেশ্যালয়ে বিক্রি হয়ে যান লেয়লা। বহু নিপীড়ন আর কষ্টের পরেও বাড়ি ফিরে যাবার কথা মাথায় আসেনা তার। বাড়ির মানুষের কাছে তিনি ততদিনে মৃত। কেউ তার ফোন ধরতেও চায় না। বামপন্থী শিল্পী ডি/আলির সঙ্গে বিবাহিত জীবনের এক বছর লেয়লার জীবনের সবচেয়ে সুখের অংশ। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুরতা ডি/আলিকে কেড়ে নেয়, স্বামীর মৃত্যুর পরে লেয়লাকে ফিরে যেতে হয় আদিম পেশায় কেননা ডি/আলি বহু দেনা রেখে গেছেন। মর্গের লোকেরা লেয়লার বন্ধুদের কাছে তার শবদেহ হস্তান্তর করতে রাজি হননা। বেওয়ারিশ লাশেদের যেখানে দাফন করা হয় সেই কবরস্থানে গোর দিয়ে দেন তাকে। মৃত্যুর পরের দশ মিনিটে লেয়লার পুরো জীবনের স্মৃতি যেভাবে ফিরে ফিরে আসে সেই দিয়ে আখ্যান আরম্ভ। শেষ হয় তার আত্মার মুক্তি দিয়ে।
এলিফ শাফাক একজন সমাজ সচেতন লেখক, নারীবাদী এবং বিভিন্ন সামাজিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর উপন্যাসগুলোতে তুরস্কের বিভিন্ন সামাজিক অবস্থান, ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণি এবং পেশার নারীদের জীবনের গল্প উঠে এসেছে। মুসলিম নারীর সংকট, ধর্মের সামাজিক আচারের সঙ্গে আধ্যাত্মবাদী অংশের সংঘাত, আপাতদৃষ্টিতে উদার এবং পশ্চিমা ধরনের ইস্তাম্বুল শহরের গোঁড়ামি আর সংস্কারাচ্ছন্ন চরিত্র স্পষ্টভাবে চিত্রিত হয়েছে।
বাস্টার্ড অফ ইস্তাম্বুলের জেলিহার কথাই ধরা যাক, তিনি মদ্যপান করেন, আল্লাহ খোদায় বিশ্বাস নেই। গর্ভপাতকে পাপ বলে ভাবেন না, তাহলে ভাইয়ের দ্বারা ধর্ষিত হবার পর গর্ভের সন্তান নষ্ট করতে গিয়েও পারলেন না কেন? মিনিস্কার্ট পরাতে তাকে তার ভাই গালিগালাজ করছিলেন, মারামারির এক পর্যায়ে ব্যাপারটি ধর্ষণে শেষ হয়। অথচ জেলিহা ঘুণাক্ষরেও কাউকে জানতে দেননি কোন প্রেমিক নয়, তার নিজের ভাই-ই এই অবৈধ সন্তানের পিতা। জেলিহার অন্য বোনেরা বিশ্বাসী, একজন পুরুষহীন বাড়িতেও হিজাব পরে থাকেন। আবার এই হিজাবের ব্যাপারটি জেলিহাদের মা একেবারেই পছন্দ করেন না। আধুনিক তুরস্কের নারীরা বহু আগে হিজাবের বন্ধন থেকে নিজেদের মাথাকে মুক্তি দিয়েছে বলে মত দেন তিনি। এই ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার দ্বন্দ্ব কীভাবে মোকাবিলা করেন একজন শিক্ষিত মুসলিম নারী?
অনারের পেমবে কাদের বিশ্বাসী মহিলা, ইংল্যান্ডে বহুদিন থেকেও তুরস্কের ঐতিহ্য থেকে খুব বেশি সরে যাননি। স্বামী আদেমের সঙ্গে অসুখী দাম্পত্যের এক পর্যায়ে এলিয়াসের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেলেও সেটি যৌনসম্পর্কে গড়ায় না। যদিও তার ভাসুর এবং পুত্রেরা একে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। এসমা তার মায়ের সম্পর্কটির ব্যাপারে জানত না। কিন্তু জানলেও হয়তো ভাইদের মতন কঠোরভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করত না মাকে।
এসমা ঘৃণা করে বড় ভাইকে কিন্তু একই সঙ্গে খুব করুণাও হয় তার। ইসকেন্দর তো আসলে এই সমাজের সৃষ্টি, যে সমাজ তাকে শিখিয়েছে মায়ের জীবনের চেয়ে বড় পরিবারের সম্মান। ইংল্যান্ডে বসবাস করেও অনার কিলিংয়ের মত জঘন্য অপরাধ ঘটে মুসলিম পরিবারগুলোতে- এ কি ধর্মের দোষ? নাকি পুরুষতন্ত্রের?
টেন মিনিটস থার্টি এইট সেকেন্ডস ইন দিস স্ট্রেইঞ্জ ওয়ার্ল্ড উপন্যাসে পুরুষশাসিত সমাজের ভয়ংকর চেহারা দেখা যায়। লেয়লা বাড়ি থেকে পালিয়ে ইস্তাম্বুল যাত্রা করেন কেননা বহুদিন ধরে তাকে ধর্ষণ করে আসছিল চাচা, গর্ভবতী হবার পরে এ কথা জানাজানি হলেও বাবা নিজের ভাইকে কিচ্ছুটি বলেন না। নস্টালজিয়া নালান নামের রূপান্তরকামী নারী বেশ্যালয়েও স্থান পান না, যেহেতু নারীদের বেশ্যাবৃত্তির লাইসেন্স দিলেও রূপান্তরকামীকে দেয় না রাষ্ট্র- জয়নাব ১২২ কে খর্বাকৃতি হবার জন্য সহ্য করতে হয় কত কিছু, হলিউড হুমায়রা আর জামিলার গল্পগুলোও শুধু শোষণ আর নিপীড়নের।
এই উপনাসে দেখা যায় সমাজের অন্যায় অবিচারগুলো, যা প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। দেখতে পারা যায় সমাজ কীভাবে স্বাভাবিক করে এনেছে বেশ্যার প্রতি, রূপান্তরকামীর প্রতি, সমকামীর প্রতি ঘৃণাকে। সন্তান জন্মদানে সমর্থ নারীও যেভাবে মাতৃত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত হন (লেয়লার মা), যে পরিবার লেয়লার মৃত্যু নিয়ে মাথা ঘামায়না তাদের অনুপস্থিতির জন্য তার শবদেহ চলে যায় বেওয়ারিশদের গোরস্থানে। অথচ হুমায়রা, জামিলা, জয়নাব, সিনান আর নালান যে রক্ত সম্পর্কিত না হয়েও মানবিক সম্পর্কের ভিত্তিতে লেয়লাকে সম্মানের সঙ্গে সমাহিত করতে চান আর ওইদিকে ধর্ষক চাচার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়ে পারিবারিকভাবে নিষ্পত্তি করতে চাওয়া লেয়লার পরিবার, যাদের কাছে লেয়লা বহুদিন ধরেই মৃত- দেখিয়ে দেয় পরিবার কিংবা রক্তের বন্ধনও আসলে একটি সামাজিক কুসংস্কারই বটে। এসব কুসংস্কার আর কুপ্রথা থেকে নারীর কি মুক্তি নেই? সমকামী ছেলেটিকে নারীতে আগ্রহী করাবার জন্য পরিবারের চাপ কি আদৌ বন্ধ হবে কোনদিন? রূপান্তরকামী ছেলেটিকে জোর করে বিয়ে দিয়ে পুরুষ বানাবার চেষ্টা কবে থামাবে পরিবারগুলো? রাষ্ট্রের মতন পরিবারও কি তাহলে একটি শোষণমূলক কাঠামো?
এসব প্রশ্নের জবাব দেন না লেখক। আখ্যানের রচয়িতা হিসেবে জবাব তার দেবার কথাও নয়। প্রশ্নগুলো তোলা জরুরি- এই জরুরি কাজটিই করেন এলিফ শাফাক, অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে, মমতার সঙ্গে, নিপুন শিল্পীর দক্ষতায়।