নিশ্চিন্দিপুরের দুর্গারা হারিয়ে গেছে
রাজনীন ফারজানা।।
সাদা জামাটার সঙ্গে ম্যাচ করে হালকা গোলাপি একটা ওড়না পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অপা। হাতে কাজল নিয়ে বন্ধ দরজার দিকে ইতিউতি তাকাচ্ছে। এই বুঝি মা চলে আসবে আর দরজায় ধাক্কা পড়বে। চোখের কোলে কাজল দেবে কি দেবে না, ভেবে রীতিমত ঘেমে উঠছে মেয়েটা।
অপার মা নীলিমা মেয়ের সাজগোজ করা একদমই পছন্দ করেন না। তিনি মনে করেন কিশোরী মেয়ের সাজগোজ করা প্রেমে পড়ার লক্ষণ। অপা প্রেমে পড়েনি কিন্তু কাজল পরতে তার খুব ভালো লাগে। নিজের চেহারা কেমন সেটা ঠিক বুঝতে পারে না অপা। কিন্তু কাজল দিলে তার অসম্ভব ভালো লাগে। মাঝেমধ্যে বিয়ে বা জন্মদিনের অনুষ্ঠানে চোখে আইলাইনার আর ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়ার সুযোগ পায়। তখন মা কিছু বলে না। কাজল পরা চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে বলিউড নায়িকা কাজল না হয় মাধুরী দীক্ষিত ভাবতে ভালো লাগে ওর। ‘ইস ওদের মত করে সাজতে পারতাম একদিন’, ভাবে অপা।
ক্লাস এইটে পড়ুয়া অপরাজিতাকে বাড়ির সবাই অপা বলে ডাকে। শুধু বাড়ি বললে ভুল হবে। পাড়া, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, স্কুলের শিক্ষক আর বন্ধুরাও তাকে অপা বলেই ডাকে। কেউ জিজ্ঞাসা করলে তাই নিজের নাম অপরাজিতা না বলে অপাই বলে সে। শুধুমাত্র মায়ের অগোচরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা দেখতে দেখতে নিজেকে অপরাজিতা বলে ডাকে সে। নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলে।
‘অপরাজিতা তোমার নাকটা কিন্তু বোঁচা। অবশ্য মন খারাপ কোরো না। কাজলের নাকও বোঁচা। শ্রীদেবীর চেহারা কাটা কাটা হলেও কাজল বেশি মিষ্টি। তোমাকে কাজল পরলে ঠিক নায়িকা কাজলের মতই দেখায় কিন্তু।’ অথবা ‘ঋতুর গায়ের রঙ কাঁচা হলুদের মত হলেও চোখটা কটা। ওকে লোকজন সুন্দর বলে। বলুক গা। তোমার চোখ আর ভ্রু কিন্তু খুব সুন্দর, অপরাজিতা।’
ক্লাস এইটে ওঠার পর থেকে নিজেকে নিয়ে অন্যরকম সচেতনতা শুরু হয়েছে অপার। সারাক্ষন তার মাথায় ঘোরে সে কি সুন্দর নাকি সুন্দর না? তার গায়ের রঙ তো চাপা। লোকজন বলে, মেয়েটা কী মিষ্টি দেখতে। কী সুন্দর চোখ আর চুল। সানন্দা, আনন্দবাজার আর আনন্দলোক ম্যাগাজিন ঘেঁটে ঘেঁটে ভারতীয় নায়িকাদের ছবি দেখে আর নিজের সঙ্গে মেলায়। নাহ, কিছুতেই নিজেকে ওদের সঙ্গে মেলাতে পারে না। ভারতের সব নায়িকার চোখ, মুখ খুব কাটা কাটা। অমন নাহলে কি আর তাকে সুন্দর দেখতে বলে? নিজের চেহারা নিয়ে কিশোরী মনে এমন কত প্রশ্ন আসে!
এদিকে অপরাজিতার মা নীলিমার মনে মেয়েকে নিয়ে বেজায় দুশ্চিন্তা। মেয়ের বাড়ন্ত শরীর। বয়সের তুলনায় বেশ লম্বা। বুকের গঠনও ভরন্ত। চেহারাও খুলছে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে।
পাড়া-প্রতিবেশীরা সারাক্ষণ বলতে থাকে, অপার মায়ের চিন্তা নাই। মেয়ের যে সুন্দর চেহারা, বিয়ে দিতে অসুবিধা হবে না। মেয়ের নিষ্পাপ আর মিষ্টি মুখটার দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে হাহাকার জাগে নীলিমার। বিয়ে তো দূরের কথা, মেয়েটাকে নিরাপদে বড় করতে পারবে তো!
ছেলের বয়স পাঁচ। তাই তাকে নিয়ে চিন্তা নাই কিন্তু একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তার চিন্তার সীমা নাই। তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করেন মেয়ে যেন নিজেকে যতটা সম্ভব আড়াল করে রাখে। মেয়ে মানুষের সুন্দর চেহারা আর ভরভরান্ত শরীরের চেয়ে বড় দুশমন যে আর কিছু নাই, তা তিনি হাড়ে হাড়ে জানেন।
মধ্য তিরিশের নীলিমা নিজেও বেজায় সুন্দরী। একসময় লোকজন দূরদুরান্ত থেকে তাকে দেখতে আসত। এখনও তার কোমর ছড়ানো মেঘের মত ঘন আর কালো চুল। ঘন কালো পাপড়ি ঘেরা বড় বড় দুই চোখে গভীর মায়াবী দৃষ্টি। ছেলেদের যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হয় তাকে। মেয়েটা তার মত নামডাকা সুন্দরী না হলেও আর দশটা মেয়ের মধ্যে সহজেই চোখে পড়ার মত। মেয়েটাকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। অপাকে বড় অফিসার বানানোর ইচ্ছা তার। সারাক্ষণ তাই তার পড়াশোনার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখেন। আর চেষ্টা করেন মেয়ে যেন কিছুতেই না প্রেম করে। এই বয়সে ছেলেদের পাল্লায় পড়া মানেই জীবন শেষ।
তাই সবসময় মেয়েকে কড়া শাসনে রাখেন নীলিমা। তিনি বিশ্বাস করেন এই বয়সে সাজগোজের দিকে ঝোঁক মানেই ছেলেদের চক্কর। তাই মেয়েকে এসব থেকে দূরে রাখেন। নানারকম বই কিনে দেন মেয়েকে। কিন্তু অপার ঝোঁক সিনেমার ম্যাগাজিন আর রুপচর্চার দিকেই বেশি। গোসলে ঢোকার সময় হলুদ বাটা, চন্দনবাটা, দুধের সর নিয়ে ঢোকে আর ঘন্টাখানেকের নিচে বের হয় না।
মেয়েকে কিছু বললেই বলে, ‘তুমিই তো বল ভালো চেহারা মানে ভালো স্কিন। আমি কী সাজগোজ করি? শুধুই স্কিনের যত্ন নিই।’ এরপর এলার্জি, ব্রণের দাগ, নখ পরিষ্কার করা, পা ঘষা এসব একগাদা কাজের ফিরিস্তি দিতে শুরু করবে। নীলিমা আর কী বলবেন! দীর্ঘশ্বাস চেপে মেয়েকে তাড়াতাড়ি পড়তে বসতে বলেন। আজকাল খেয়াল করছেন মেয়ে হালকা করে পাউডার দিতে শুরু করেছে। বিশেষত প্রাইভেট টিউশনে যাওয়ার সময়। সেখানে বিভিন্ন স্কুলের ছেলেমেয়ে সবাই একসঙ্গে পড়ে। মেয়ের এই সাজগোজের প্রতি ঝোঁক দেখে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন নীলিমা। সাজগোজের জিনিস যতটা সম্ভব আড়াল করে রাখেন। কিন্তু পাউডার আর কী আড়াল করবেন। গরমে লাগে। মেয়ে ঘামে অতিরিক্ত। মায়ের ভয়ে পাউডার দিয়ে ভালো করে মুছে ফেলে সেটাও লক্ষ্য করেছেন নীলিমা। থাক এটুকু করুক ভেবে পাউডারটা আর সরাননি।
এদিকে ক্ষয়ে ছোট হয়ে যাওয়া একটা কাজল চুরি করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে অপা। মাকে লুকিয়ে কাজল দেওয়ার একটা উপায় বার করেছে সে। চোখের উপরের পাতার ভেতরের দিকে কাজল দিলে বোঝা যায় না কিন্তু চোখদুটো খুব সুন্দর লাগে। আজকাল মাকে লুকিয়ে সেভাবেই কাজল দেয় মাঝেমধ্যে। আজ প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় হাতে কাজল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর ভাবছে কী করবে। পাউডার মুখে দিয়ে সাবধানতার সঙ্গে মুছে নিয়েছে কিন্তু কাজল দেওয়ার সাহস করে উঠতে পারছে না। দ্রুত একবার ভ্রুজোড়া আঁচড়ে নিতেই দরজায় টোকা। হাতের কাজলটা ব্যাগে ভরেই মা কে সাড়া দিল, ‘আসছি।’
প্রতিদিন মেয়েকে নিজেই কোচিংয়ে দিয়ে আসেন আর নিয়ে যান নীলিমা। সঙ্গে থাকে অপার বান্ধবী সোমা। আজ তার শরীর একটু খারাপ। তাই নীলিমা যাবেন না। মেয়ের হাতে রিকশাভাড়া দিয়ে দুই বান্ধবীকে সাবধানে যেতে বললেন। পই পই করে বলে দিলেন কোচিং শেষ যেন কোথাও না যায় ওরা। সোজা যেন বাসায় আসে।
মা যাবে না শুনেই আনন্দে বুকের রক্ত ছলকে ওঠে অপার। নদী, মাঠ আর ধানক্ষেত ওর অসম্ভব পছন্দ। কিন্তু সেগুলো শহর থেকে সামান্য দূরে। খুব দূরে না। পনেরো বিশ মিনিট হাঁটলেই যাওয়া যায়। কিন্তু মা একা বা বান্ধবীদের সঙ্গে যেতে দেবে না। নিজে নিয়ে যাবে বা বাবা অথবা বড় কারু সঙ্গে যেতে হবে। আজ দারুণ সুযোগ পাওয়া গেছে। বাসা থেকে বের হয়েই সোমাকে বলে, ‘আজ কিন্তু মাঠ দেখতে যাবো।’ সোমাও সাড়া দেয়। বলে, ‘চল কোচিং পালাই।’ কিন্তু মা কাল কোচিংয়ে গেলেই ধরা পড়ে যাবে। তাই কোচিং পালাতে রাজী হয় না অপা। বলে ‘না হয় শেষ ক্লাস মিস দেবো কিন্তু কোচিং বাদ দেওয়া যাবে না। মা জানতি পারলে মেরেই ফেলবেনে।’
কোচিংয়ের ক্লাসে কিছুতেই মন বসে না অপার। মন পড়ে আছে বিশাল খোলা মাঠে। ক্লাস সিক্সে উঠে প্রথমবারের মত আম আঁটির ভেপু উপহার পায় মায়ের কাছ থেকে। সেই থেকে নিজেকে দুর্গা ভাবতে দারুণ ভালো লাগে ওর। অপু আর দূর্গার মতই মাঠ আর বন জঙ্গল টানে ওকে। বাড়ির কাছে ছোট ছোট বাগানে ঘুরে বেড়ায় আর নিজেকে দুর্গা ভাবে। গাছপালাদের সঙ্গে গল্প করে। আর ভাবে কেন যে ওদের এলাকায় একটা রেলগাড়ি নাই। তবে সেও ছোটভাই কল্লোলকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে রেলগাড়ি দেখতে যেত।
একবার ওরা নদীতে বড় কার্গো দেখতে গেছিল। সেদিন নিজেকে সত্যি সত্যি দুর্গা মনে হয়েছিল তার। কল্লোল কিছুটা মায়ের মত দেখতে। বড় বড় টানা টানা চোখ। ওকে সত্যিই অপু মনে হয় অপার। ভাইকে কার্গো দেখিয়ে ঠিক যেন দুর্গার মতই তৃপ্তি পেয়েছিল সেবার। কিন্তু ছোটবেলার মত আর ছুটে বেড়াতে পারে না। গত বছর মাসিক হয়ে যাওয়ার পর থেকে মা কেমন যেন করে। একদম বাইরে যেতে দেয় না। লোকজনের সামনেও তেমন একটা বের হতে দিতে চায় না। আর বারবার বলে, ভুলেও যেন প্রেম না করে। তাকে বড় হয়ে ডাক্তার না হয় ইঞ্জিনিয়ার বা বড় অফিসার হতে হবে। প্রেম করলেই নাকি জীবন শেষ। অপার প্রেম করতে ইচ্ছা করে না কিন্তু তার মাঠে ঘাটে ছুটে বেড়াতে ইচ্ছা করে। কিন্তু মা সেটা বোঝেই না। তাকে কিছুতেই বাইরে যেতে দিতে চায় না। কেমন যেন ভয় ভয় ভাব সারাক্ষন। যেন বাইরে বাঘ ভাল্লুক ঘুরে বেড়াচ্ছে। কই দূর্গাকে তো কখনো বাঘ-ভাল্লুক ধরেনি!
সরল মনের অপা কীভাবে বুঝবে মায়ের চিন্তার কারণ। দুনিয়া তো বদলে গেছে। অপু-দুর্গাদের দিন শেষ। এখন চারদিকে জঙ্গল কমলেও বাঘ-ভাল্লুকের বিচরণ বেড়েছে বই কমেনি। মেয়েদের বিশেষ করে অল্পবয়সী আর সরল মেয়েদের শিকারের জন্য ওত পেতে আছে হিংস্র সব জন্তু জানোয়ার। নীলিমাদের তাই প্রধান চিন্তা নিরাপদে মেয়েকে বড় করতে পারা নিয়ে। তাদের মত যেন মেয়েকে বাঁচাতে অল্প বয়সে বিয়ে দিতে না হয়। মেয়ে যেন নিজের পরিচয় তৈরি করতে পারে। স্বপ্ন হয়ত খুব বড় নয়, কিন্তু নীলিমার মত কিশোরী কন্যার মায়েদের রাতের ঘুম কেড়ে নেয় মেয়েকে শ্বাপদের আড়াল থেকে বাঁচিয়ে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার চিন্তা।
পরিকল্পনামত শেষ ক্লাসের আগে বেরিয়ে যায় অপা আর সোমা। বের হওয়ার আগে বাথরুমে ঢুকে টুক করে চোখের উপরের পাতায় একটু কাজল বুলোয় অপা। সোমা ব্যাগ থেকে হালকা গোলাপি রঙের চ্যাপস্টিক বের করে দেয়। ঠোঁটে দিলে ন্যাচারাল গোলাপি দেখায়। ঠোঁটে মেখেও হাতের উল্টো পিঠে মুছে নেয় অপা। এতটা করতে সাহস হয় না ওর। এমনিতেই ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার জন্য মায়ের কাছে বকা খাবে। এরপর ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়ার বিষয়টা মানতে পারবে না ওর মা।
রিকশা নিয়ে সোজা মাঠে চলে যায় ওরা। বেশ মানুষ আছে। হেমন্তের নরম আলো চারদিকে। বাচ্চারা খেলছে। বড়রা বসে, দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করছে। মাঠ ছাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা দূরে চলে যায় অপারা। মাঠের শেষ যেখানে ধান ক্ষেত শুরু। ধানের ক্ষেত পেরিয়ে দূরে গ্রামের চিহ্ন দেখা যায়। দু’একবার ওদিকে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি গিয়েছে কিন্তু ভালো করে চেনেনা অপা।
ধানক্ষেতের মধ্যে মধ্যে চোখে পড়ে বেশ কয়েকটা মাছের ঘের। ওদের বেশ কিছু আত্মীয়স্বজনের ঘের আছে এদিকে। অপা দু’একটাতে বেড়াতে গিয়েছে। মাঝখানে বড় পুকুর। পুকুরের একদিকে মাচা আর খড়ের চালার হাঁসের ঘর। পুকুরের পাড়ে মুরগির ঘর, কলা গাছের ঝোপ, ফলমূল আর সবজির আবাদ। একদিকে কেয়ারটেকারের থাকার কুঁড়ে। খুব সুন্দর লাগে ঘেরে বেড়াতে। হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটা ঘেরের কাছাকাছি চলে আসে। লোভ হয় কিন্তু ঢুকতে সাহস হয় না। অপা একটু জোর করলেও সোমা রাজী হয় না। জায়গাটা কিছুটা নির্জন।
এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। দুই কিশোরী বাড়ির পথে পা বাড়ায়। মাঠের ধারে ঝালমুড়ি আর ফুচকা খেয়ে হাতের টাকা শেষ তাই রিকশা নেওয়ার উপায় নাই আর। তাই দ্রুত বাড়ির পথে পা চালায় ওরা। মাগরিবের আজানের আগেই বাড়ি পৌঁছাতে হবে। একটা তে’মাথার মোড়ে এসে দু’জনের পথ আলাদা হয়ে যায়। সোমা যায় সোজা দিকে আর ডানদিকের রাস্তায় যায় অপা। বাড়ি পর্যন্ত পুরো পথ রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে অপাকে কিছুটা ঘুরতে হবে। কিন্তু মন্টু কাকাদের বাড়ির পাশের বাগান দিয়ে ঢুকলে তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে। তাই সেদিক দিয়েই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় অপা।
এই বাগান নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। ছোট এই মফস্বল শহরে এই বাগানের কথা সবাই জানে। অনেক দুর্নাম আছে বাগানটার। ভূত-প্রেতের গল্প তো মুখে মুখে ছোটে। বাগানটা বেশ বড়। ছোট-বড় নানা আকারের ঘন গাছের সারি। তিনটা বড় বড় পুকুরও আছে বাগানের মধ্যে। বাগানের চারপাশে বাড়ি থাকলেও একা একা কেউ সাধারণত এই বাগানে ঢুকতে চায় না। শোনা যায়, দেবদারু, হলুদ কিংবা আদার ঘন ঝোপের আড়ালে এখানে ফেন্সিডিল আর গাঁজার আসর বসে। এলাকার যত নেশাখোর তাদের যাওয়া আসা দেখা যায় ওই এলাকায়। ভুতের গল্পের সঙ্গে দুয়ে দুয়ে চার মেলায় তাই অনেকেই।
অপা এসব কথা জানলেও ওর ভয় লাগে না। ছোটবেলা থেকেই ওদিক দিয়ে যাওয়া আসা করে। কত খেলেছে ওই বনের মধ্যে। ফুল কুড়োতে কিংবা হলুদ তুলতেও গেছে বহুবার। ঘাসের মধ্যে কালো কালো কাঁচের বোতল পড়ে থাকতে দেখলেও জানে না ওগুলো কী। আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছানোর জন্য তাই ওই রাস্তাই ধরে সে। ভাবে এক দৌঁড়ে পৌঁছে যাবে। কী আর হবে! ভূত না ধরলেই হল।
এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেও অপার কোন খোঁজ নাই। কেন যে নিজেই গেলেন না আনতে, আফসোস হতে থাকে অপার মা নীলিমার। ভাবেন দুই বান্ধবী মিলে হয়ত সোমাদের বাড়িতে যেয়ে আড্ডা মারছে। আরও আধঘণ্টা পর দুশ্চিন্তা বাড়ে তার। অসুস্থ শরীর নিয়ে ছুটে যান সোমাদের বাড়ি। সেখানে যেয়ে শোনেন সোমা বহু আগেই বাড়ি চলে এসেছে আর অপারও এতক্ষণে বাড়ি পৌঁছে যাওয়ার কথা। তে’মাথার মোড় থেকে দুই বান্ধবী ঘন্টাদুয়েক আগেই আলাদা হয়ে গেছে শুনে পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় নীলিমার। অজানা আশংকায় এমনভাবে বুক কাঁপতে থাকে যেন বাইরে থেকে শোনা যাবে। মুখ থেকে যেন সমস্ত রক্ত সরে যায়। ফ্যাকাসে সেই মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে সোমার মা।
‘ভাবী কী হল’, বলে ছুটে এসে নীলিমাকে ধরেন তিনি। সোমাকে বলেন, দৌড়ে এক গ্লাস পানি আনতে। পানি নিয়ে ছুটে এসে সোমা দেখে নীলিমা ছুটছেন। তার মাও পেছনে পেছনে যাচ্ছে। কী করবে বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে নীলিমা। অপা কই গেল ভেবে তার মনেও দুশ্চিন্তা ভর করে।
নীলিমা আর সোমার মা মিলে আশেপাশের সব বাড়িতে খুঁজতে থাকেন অপাকে। নাহ, মেয়ে কোথাও নাই। নীলিমার দু’চোখ দিয়ে শ্রাবণের বাণ ডেকেছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন আর মেয়েকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তখনও অপার বাবা বাসায় ফেরেনি। পাশের বাসার ভাবির কাছে ছেলেকে রেখে এসেছেন নীলিমা। তাদের বলে এসেছেন অপার বাবা ফিরলে যেন বলে অপা বাসায় ফেরেনি তাই নীলিমা মেয়েকে খুঁজতে গেছেন।
অপার মা, সোমার মা মিলে মন্টু-ঝন্টুদের বাড়িতে যান তারা মেয়েকে এদিকে দেখেছেন কি-না জিজ্ঞাসা করতে। কোথাও নাই অপা। যেন শূন্যে মিলিয়ে গেছে জলজ্যান্ত মেয়েটা। নীলিমার বুকের মধ্যে ছিঁড়ে যায়। শখ করে মেয়ের নাম রেখেছিলেন অপরাজিতা। তার মেয়ে হারবে না। তার মেয়ে সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জিতবে এবং মাথা তুলে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। অপরাজিতারা হারতে পারে না। অপরাজিতা হেরে গেলে নীলিমার জীবনটাও যে অর্থহীন হয়ে যায়।
বুকের মধ্যে কু ডাক ডাকতে থাকে অচেনা কোন পাখি। অসুস্থ নীলিমা পাগলের মত অন্ধকারের মধ্যেই ছোটেন বনের মধ্যে। পেছন পেছন টর্চ হাতে মন্টু আর তার ছেলে সুমন ছোটে। সুমনের মা, কাকী আর বোনদের সঙ্গে তাদের উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকেন সোমার মা। সবার কন্ঠে ফিসফাস। যেন অশুভ কিছু ঘটতে চলেছে। পৈশাচিক আর বেদনাদায়ক কিছু। অন্ধকার বন থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক অন্যদিন সম্মিলিত সঙ্গীত উৎসবের মত মনে হলেও আজ মনে হচ্ছে অসংখ্য হায়েনা একযোগে ডাকছে।
নীলিমারা বনের ভেতরে ঢুকে যায়। কিছুক্ষণ পর আর ওদের সাড়াশব্দ বা টর্চের আলো দেখা যায় না। বনের মধ্যে যেন লক্ষ কোটি প্রদীপ জ্বেলেছে জোনাকপোকার দল। বাকি জঙ্গল ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা। কালিগোলা সেই অন্ধকারে তাকিয়ে সেই উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকের গাঁয়ে কাটা দিতে থাকে। অজানা আতঙ্কে গলা বুঁজে আসে সবার। বন থেকে আসা হেমন্তের শীতল বাতাসে গায়ে কাঁটা দেয় ওদের। কী যেন অশুভ বার্তা বয়ে আনছে ওই হাওয়া। মাঝমধ্যে আর্তকণ্ঠে অপার মায়ের গলা পাওয়া যায়। ‘অপাআআআ…’ ‘অপাআআআআ…’ ‘অপা কই গেলিরে মা?’
এমন সময় উঠোনে ছুটতে ছুটতে আসেন অপার বাবা ফারুক। দৌড়ে আসায় মুখ আর কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে তার। সোমার মাকে দেখে বলে ওঠে, ‘কী হয়েছে ভাবী?’ কণ্ঠ ভেঙে আসে ফারুকের। ঠিক সেসময় জঙ্গল থেকে নীলিমার আর্ত চিৎকার ভেসে আসে। ফারুক ছুটে যায় সেদিকে।
একে একে সোমার মা আর সুমনদের বাড়ির সবাই এগোয় সেদিকে। হলুদ বনের মাঝখানে পড়ে আছে দুটো শরীর। একটা সদ্য অজ্ঞান হওয়া নীলিমা আর অন্যটা সাদা জামা পরা ঘাড় বেঁকিয়ে পড়ে থাকা অপার। একটু দূরে হলুদঝোপের পাশে সাদা পাজামাটা পড়ে আছে।
মটকানো ঘাড়টা উল্টনো। খোলা দুই অপলক চোখ ভয় আর যন্ত্রণা নিয়ে অপলক তাকিয়ে আছে। গোলাপি ওড়না দিয়ে মুখ বাঁধা। নিথর শরীরে প্রাণের কোন চিহ্ন নাই। ‘অপা রে…’ ফারুকের আর্ত চিৎকার যেন ছোট সেই বন পেরিয়ে, বাড়িঘর পেরিয়ে, মাঠ আর ধানক্ষেত পেরিয়ে পৌঁছে যায় দূরের কোন নিশ্চিন্দিপুরে। এই জগতে কোন নিশ্চিন্দিপুর নাই, সেই দুর্গারাও আর নাই।
অন্য জগতে অন্য কোন নিশ্চিন্দিপুরে দুর্গা আর অপরাজিতারা হাতে হাত ধরে ফুল আর কাশের বনে ছুটে বেড়ায় আর প্রজাপতির সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফুলের মধু চুরি করে খায়…