দৈহিক নির্যাতন মেনে নেবেন না, নির্যাতককে শাস্তি দিন
নাহিদ শামস্।। মানবাধিকার সংস্থায় কাজ করার সুবাদে একবার একজন নারী (নিরক্ষর ও নিম্নবিত্ত) আমার কাছে এসেছিলেন তার স্বামী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে। নারীটি তার কথা বলবার ফাঁকে হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করে বসলেন “আফা আপনের স্বামী আপনারে মারে না? কন মারে না?’’
আমি তাকে জবাব দেবার আগেই সে বলে উঠলো, ‘‘স্বামী আমাদের মারতেই পারে। হেইডা তার অধিকার। তয় সে তার মা বাপের কথা হুইনাই আমারে মাইর দেয়। হেরাও আমারে মারে। হে মারলে আমি কুন দোষ দেখিনা। হে তো রাইত হইলে সোহাগও করে।’’
সলজ্জ হাসি তার।
আমি তার কথা শুনে কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। সে এসেছিল তার স্বামীর পরিবারের লোকেরা যেন তার গায়ে হাত না তোলে, এটি নিশ্চিত করতে, তবে স্বয়ং স্বামীর মারধোরে খুব একটা আপত্তি তার নেই।
উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত অধিকাংশ নারীই মনে হয় এই ধারনাটি পোষণ করি। না হলে কত সংখ্যক নারী যে আমরা এই নির্যাতনের শিকার আমাদের প্রতি বছরের পরিসংখ্যান তা বলে দেয়। নারীদের নীরবতা, সহ্য করবার অসীম ক্ষমতা পুরুষদের নির্যাতক রূপে তৈরি করছে দিনে দিনে। পুরুষ তার দৈহিক ক্ষমতা দেখিয়ে কোন শাস্তি ভোগ না করেও নারীকে তার অধীনে রাখছে কি অবলীলায়। এর জন্য দায়ী নারীর মূর্খতা, মানসিকতা, সামাজিক অবকাঠামো, দারিদ্র্য আর পরিবারের কাছে সাহায্য না পাওয়া। আমি নারীদের নিয়ে কাজ করেছি আর করে যাচ্ছি, আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে। নিরক্ষর নারীটি বরং অবলীলায় তার মনের কথাগুলো বলতে পেরেছে। কিন্তু আমরা যারা উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত তারা কেউই বলতে পারিনা। চেষ্টা করে যাই শরীরে স্বামী নামক মানুষটির আঘাতের চিহ্নগুলো লুকিয়ে রাখবার।
আমাদের দেশের নারীদের অধিকাংশরই কম বয়সে বিয়ে হয়। লেখাপড়া শেষ করবার বা শেষ হলেও বাইরে কাজ করবার সুযোগ ক’ জনের হয়। সেখানেও কাজ করবার আদেশ স্বামী অথবা তার পরিবার থেকেই নিতে হয়। যার ফলে আর্থিক অসচ্ছলতা সবচাইতে বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায় দৈহিক নির্যাতন সহ্য করবার। এমনকি ডিগ্রিধারী অনেক নারী উচ্চপদে থেকেও নির্বিঘ্নে মারধোর ভোগ করে। সেখানেও নারীদের মানসিকতায় কাজ করে সন্তান আর সাজানো সংসারের মায়া। আমি অনেক ভুক্তভোগী নারীকে এ কথাগুলো বলতে শুনেছি।
আমাদের চেনাজানা খুব কাছের পুরুষদের দেখেছি নারীর শরীরে হাত তুলতে বা ঘর থেকে বের করে দিতে দ্বিধা বোধ করেনা। নারী যে কত কত অপরাধ করে! রান্না করেনা ঠিকমত, সন্তানদের যত্ন করেনা, শ্বশুর শাশুড়ির খেদমত করেনা! এই যে কত কিছু নারী সংসারে করেনা, আর এইজন্য তো নারী মার খাবেই! পুরুষের মনমতো না হলেই পুরুষ মারবে আর নারী মার খাবে! নারী সহ্যও করবে!
এই শতাব্দীতে এসেও নারী একই রকম দৈহিক নির্যাতনের শিকার। হয়তো কিছু নারী শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী হচ্ছে। তবে তাকে মার খেয়ে অসম্মানিত হয়েই ঘর থেকে বেরোতে হচ্ছে। আমাদের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার পুরুষেরা মনে করেন নারীর ভালো লাগা মন্দ লাগা ইচ্ছা অনিচ্ছা সব জলাঞ্জলি দিয়েই তাকে সংসার করতে হবে। তবেই সে মার খাবে না।
নারী মানুষ, তার অধিকার মানবাধিকার – এই সত্য আমরা ক’জন মানি। নারীকে দৈহিকভাবে নির্যাতনের অনেক কারণ আমরা জানি বা আলোচনায় আনি। আরো একটি বিশেষ কারণ রয়েছে সমাজ এবং পরিবারে যার দ্বারা নারীকে ঘৃণ্য অপরাধের মাপকাঠিতে মূল্যায়ন করা হয়।
বিবাহিত জীবনের স্ত্রীকে আলাদা করে সময় দেবার প্রয়োজন বোধকরি খুব কম পুরুষ উপলব্ধি করেন। নারীর জন্য আলাদা সময় কেন? ঘরে ফিরলেই তো সেই মানুষ!
বিয়ের সময় যে স্বপ্ন থাকে আমাদের- সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর দাম্পত্য জীবন পার করবো, তা আর পরবর্তীতে মেনে চলার ইচ্ছেটাও হয়তো ফিকে হয়ে আসে। পুরুষ তার কাজ আর অন্যান্য বিষয়ে জড়িয়ে পড়ে ভুলে যায় দাম্পত্য শুধুমাত্র শারীরিক নয় মানসিকও বটে। হয়তো কোন নারী দিনরাত পরিবারের কাজ করে, ক্ষেত্র বিশেষে হয়তো বাইরের কাজও তাকে সামলাতে হয়। কিন্তু স্বামী নামক মানুষটির সময় হয় না স্ত্রীকে দেবার। কিন্তু স্বামী তার নিজের জৈবিক চাহিদাটি মেটাবার প্রয়োজনে স্ত্রীকে বিছানায় নিতে ভোলেন না। ঐ নারীটি ভুলে যেতে বসে নিজের ভালোলাগা শখ আর আনন্দ। এই নারীটি এই অপ্রাপ্তির কারণেই হয়তো ধরা দেয় অন্য পুরুষের প্রেমে। শরীরে মনে ভালোবেসে ফেলে। নারীর দীর্ঘ জীবনের অপূর্ণতা পূর্ণতা পায় নতুন পুরুষটির কাছে। নারী ভুলে যায় সংসার আর সমাজের রোষানলে পড়বার ভয়। দাম্পত্য জীবনে ঝড় ওঠে। আবার সেই দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন। নারী বিতাড়িত হয় সংসার থেকে। এ আমার শোনা খুব সত্য ঘটনা।
আমাদের নারীরা প্রতিনিয়ত নিগ্রহের শিকার মানসিক ও শারীরিকভাবে। এমনকি স্বামীর কাছ যৌনতার আস্বাদন থেকে বঞ্চিত বছরের পর বছর। আর এই কারণগুলো যদি নারীকে আরেকটা সম্পর্কে প্রভাবিত করে তবে নারী হয় চরিত্রহীন নষ্টা মেয়েমানুষ।
আমাদের দেশের পুরুষদের খুব সুস্থ ভাবনার জায়গা তৈরি হবে বলে আমার মনে হয় না। খুব কম পুরুষই বেরিয়ে আসতে পেরেছে তাদের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে। আর নারীও পারছে না প্রতিবাদ করতে। ঘর থেকে বেরোতে। সংসার ধরে রাখবার সংগ্রামে নারী তার আমিত্বকে ভুলে যায়। তার কি কখনো সখনো মনে পড়ে “একটি মেয়ে বাসতো ভালো ভোরের আলো”।।
নারীর শরীরে আঘাত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইন বিরুদ্ধ। নারীর জন্য রয়েছে আইন। বর্তমান আইনে নারীকে সহায়তা দেবার জন্য রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান। রয়েছে প্রচারণা। কম সংখ্যক নারী এ সুযোগ নিচ্ছেন। নারীরা পুলিশি ঝামেলা থেকে আদালতের কাঠগড়ায় স্বামীকে নিতে আগ্রহী হন না। কিন্তু কেন?
আপনি নির্যাতিত হলে নির্যাতককে শাস্তির আওতায় আনুন। প্রতিবাদ করুন। নতুবা আপনার কাছ থেকেই আপনার কন্যা শিশুটি শিখবে “সহ্য করতে হয়, প্রতিবাদ নয়।” নীরবতা ভাঙার সময় এসেছে। আপনাকে দৈহিক নির্যাতনের সুযোগ আর পুরুষকে দিয়েন না। “আপনি অপরাধী” এ চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসুন । আপনার ন্যায় অন্যায় বিচারের দায়ভার কাউকে দেবেন না।
সমাজের গভীরে মিশে থাকা পশ্চাদপদতা, প্রথা, আইন এবং কুসংস্কার কেবল নয়, বিরাজমান পুরুষতন্ত্র নারীকে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার করে তোলে। নারীর অগ্রযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
নারীর পক্ষে যে ইতিবাচক আইন রয়েছে তা আমাদের পুরুষতন্ত্রকে কিছুটা হলেও যোগ্য জবাবটি দেবে। সীমাবদ্ধ চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসুন। নারী নয়, মানুষ হিসেবে অধিকার ভোগ করুন। দৈহিক নির্যাতন অন্যায়, পাপ, অপরাধ। রুখতে হবে এখনি।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]