November 24, 2024
সাহিত্যফিচার ৩বই নিয়ে আলাপ

দ্য জয়স অভ মাদারহুড: মাতৃত্ব তখনই মহান, যখন…

উম্মে ফারহানা।। বুচি এমেচেতার দ্য জয়স অভ মাদারহুড উপন্যাসটি নিয়ে লেখার ইচ্ছা ছিল আগেই। এ মাসের দশ তারিখে ‘মা দিবস’ আসাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মা দিবস নিয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মতামত দেখে নিজস্ব কিছু ভাবনা প্রকাশ করার প্রয়াস পাচ্ছি। আন্তর্জাতিক মা দিবসে আর কিছু না হোক, মাতৃত্ব সম্পর্কে নানা রকম আলাপ ওঠে, এতে চিন্তার রসদ পাওয়া যায় বেশ। মাতৃত্ব এমন একটি ধারণা যাকে খুব স্বর্গীয় এবং উচ্চমার্গের একটি ব্যাপার বলে বিবেচনা করা হয়। মাতৃত্বকে কেন্দ্র করে দুনিয়ার সকল দেশে সকল কালে রচিত হয়েছে অনেক গল্প উপন্যাস নাটক। এর মধ্যে এমেচেতার এই গ্রন্থটিকে বিশেষ বিবেচনা করার কারণ হলো, এটি নারীর কলমে লেখা, নারীর চোখে দেখা নারীর জীবনের বয়ান।

নিজেকে নারীবাদী বলে স্বীকার করতে নারাজ ছিলেন বুচি এমেচেতা, তাঁর মতে নারীবাদ একটি পশ্চিমা ধারণা। কিন্তু নিজের জীবনে এবং কাজে তাঁর যে চেতনা প্রকাশিত হয়েছে তাকে নারীবাদী বলা ছাড়া উপায় নেই। এমেচেতার মৃত্যুর পর মাকে স্মরণ করবার সময় তাঁর পুত্র সিলভেস্টার ওনওয়ার্ডি, সাইকোলজিস্ট এবং মেডিক্যাল এনথ্রপলজিস্ট, তাঁকে নারীবাদী বলেই উল্লেখ করেছেন।

দ্য জয়স অভ মাদারহুড পড়ে প্রতিক্রিয়া লিখেছিলাম বইপত্রের একটা গ্রুপে, বলেছিলাম যে, জননীর শ্যামা আর কলকাতার কাছেই-উপকণ্ঠে-পৌষ ফাগুনের পালা ট্রিলজির শ্যামা- দুজনের কথাই মনে পড়েছে। তা দেখে এক পাঠক বিস্মিত হলেন, জিজ্ঞেস করলেন নাম ছাড়া এই দুজনের মিলটা কোথায়? মিল তাঁদের মাতৃত্বের জায়গায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর গজেন্দ্রকুমার মিত্র (শিরোনামে কোথাও না বললেও) তাঁদের শ্যামাদের মায়ের ভূমিকায়ই তৈরি করেছেন।

মা নিয়ে কিংবা মা নামে আমার পড়া আর যা সাহিত্য আছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গোর্কির মা আর ব্রেখটের নাটক মাদার কারেজ অ্যান্ড হার চিলড্রেন । এই সবগুলোতেই মাকে দেখার চোখটি পুরুষের। বলতে পারেন লেখকের কোন লৈঙ্গিক পরিচয় থাকে না, লেখক মানে স্রষ্টা, তিনি লৈঙ্গিক পরিচয়ের উর্ধে। কিন্তু পুরুষশাসিত সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থায় মাতৃত্বের কোন্ রূপটি আমরা দেখি, কিংবা মাতৃত্ব নামের ধারণাটিকে কীভাবেই বা সংজ্ঞায়িত করা হয় সেটি পুনর্বিবেচনা করার দরকার আছে বৈকি!

মায়ের উপর মহানুভবতা আরোপের দায় নেননি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা গজেন্দ্রকুমার মিত্র, শ্যামাদের আমরা দেখি দোষগুণসম্পন্ন, হিংসা-লোভসম্পন্ন সাধারণ মানুষ হিসেবে, কলকাতার কাছেই এর শ্যামাঠাকরুন তো রীতিমতো কুটনি বুড়িই বনে গেলেন শেষ বয়সে। জননীর শ্যামাও নিজের মেয়ের প্রতি ঈর্ষা অনুভব করেন একটা সময়ে। জননীর শ্যামাকে ফ্রয়েডিয় তত্ত্বমতে শিশ্নাসূয়ায় ভোগা এবং তার ফলে শুধুমাত্র পুত্র জন্ম দিয়েই জীবনের পূর্ণতা পাবার আশায় ব্যকুল এবং একই সঙ্গে তাঁর পুত্র বিধানের সঙ্গে সম্পর্কটিকে কী করে ইদিপাস কমপ্লেক্সের এক ‘মোহময়’ প্রয়োগ হিসেবে দেখিয়েছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সে সম্পর্কে উম্মে রায়হানার একটি লেখা আছে নারী ও প্রগতি জার্নালে। আগ্রহীদের জন্য লেখাটির লিংক দিলাম এখানে-
https://www.bnps.org/journal/18/Ummy%20Raihana.pdf

সমাজে মাতৃত্বের যে ধারণা, বলা ভাল যে শোষণমূলক ধারণা, তার সবটুকু ঢেলে দিয়েই গড়া হয়েছে এই মায়েদের প্রতিমা। একজন নারীর জীবনের আর সবকিছু বাদ দিয়ে তার সন্তানের সঙ্গে সম্পর্কটুকুকে ধরে তার মূল্যায়ন করা কতটা যৌক্তিক?

করোনা সংক্রমণের পর খবর শুনেছি এক মাকে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে এসেছে তার সন্তানেরা। এই সকল সন্তানরা অবশ্যই মানুষ হিসেবে ব্যর্থ, যে নিষ্ঠুরতা তারা মায়ের প্রতি দেখিয়েছে সেটি জগতের আর যেকোন মানুষের প্রতিও তারা দেখাতে পারবে বলে আমার ধারণা। তবে মা বাবার প্রতি অন্যায় করলে সেইসব মানুষকে একটি বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়, তাদের বলে ‘কুসন্তান’। আদিকাল থেকেই প্রবাদ আছে, ‘কুসন্তান যদ্যপি হয় কুমাতা কদাচ নয়’। এই প্রবাদের বিপরীত বচনও আবার আছে, কোন কিছুর কৃত্রিমতা বোঝানোর জন্য বলা হয় ‘মাছের মায়ের পুত্রশোক’। মাছ যেহেতু অনেক ডিম পাড়ে, কিছু ছানাপোনা মরলেও তার নাকি কিছু এসে যায় না। খারাপ মা বোঝাতে হলে কোন মাকে ডাকতে হবে ‘মাছের মা’ বলে। ‘কুমাতা কদাচ নয়’ বলার পরেও তাহলে ‘খারাপ মা’ বলে কিছু একটা আছে।

তো খারাপ মা কে বা কারা? যারা প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী মহান হতে পারেন না, নিজের জীবনের সকল ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্নকে সন্তানের জন্য বলি দিতে পারেন না, তাঁরাই কি এই গোত্রভূক্ত? মাতাকুন্তীর কথা ভাবুন, কুমারীকালে জন্ম দেওয়া সন্তান কর্ণকে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন বলে তাঁকে কি কাঠগড়ায় দাঁড় করাননি কর্ণ নিজেই? অথচ সমাজ যদি অবিবাহিত নারীকে সন্তান জন্মের গর্ব আর অহংকারটুকু না দিয়ে শুধু অবিবাহিত হবার লজ্জাটুকুই দেয় তাহলে টিকে থাকার জন্য যে কোন মেয়েই তো তাই করবে। মহাভারতের কাল এখন আর নেই। কিন্তু পৃথিবীর কয়টি দেশে একটি মেয়ে বিয়ে না করেও মা হতে পারে? পুরুষের দেওয়া সার্টিফিকেট, মোহর বা সিঁদুর না থাকলে যদি মাতৃত্ব মহান না হয়ে লজ্জার ব্যাপার হয়ে যায় তাহলে সেই মহানতা কতটা ঠুনকো তা বুঝতে কষ্ট হয়না। মাতৃত্ব তখনই ‘মহান’ যখন কোন পুরুষ পিতা সেই সন্তানের বৈধতা দিয়েছেন, তার আগে নয়।

আবার, মাতৃত্ব হলো একটি ভূমিকা- সন্তান জন্ম দিয়ে কিংবা পালন করে (সন্তান দত্তক নেওয়া মায়েদের নিয়েই বলছি) একজন নারী মা হন। এটি সন্তানের সঙ্গে তার সম্পর্কের সাপেক্ষে একটি ভূমিকা। তাঁর জীবনের সবটুকু নয়, মূল পরিচয় তো নয়ই। এই একটি ভূমিকার উপর অযথা মহানুভবতা আরোপ করে আমরা কি ব্যক্তি নারীকে অসম্মান করি না? মা হতে না পারা কিংবা হতে না চাওয়া নারীদের প্রতি অশ্রদ্ধা বা অসম্মান প্রকাশ করি না? সামাজিক মাপকাঠিতে মাতৃত্বের দায়দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়া নারীদের প্রতি জাজমেন্টাল আচরণ করি না? আস্তাকুঁড়ে ফেলে যাওয়া শিশুদের মায়েরা কোন ধাতুতে গড়া? আমরা বিস্মিত হই, গালিও দেই। এমনকি না জন্মানো শিশু, মানে ভ্রুণহত্যার জন্যেও নারীকে অসম্ভব অপমান সহ্য করতে হয়। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডের দুই চিকিৎসক আমার ও আমার রোগীর সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করেছিলেন শুধুমাত্র রোগী আগে এবরশন করিয়েছেন একথা জেনে।

সামাজিকভাবে তৈরি হওয়া এই সকল মূল্যবোধ শেখায় যে নিজের শরীরের উপর নারীর কোন অধিকার নেই। না চাইলেও তাকে গর্ভধারণ করতে হবে। কেননা মাতৃত্ব যে ‘মহান’! এই মহান ভূমিকাটি অবতীর্ণ হতে না চাইবার অধিকারও নাকি নারীর নেই!

যেটা বলছিলাম, পুরুষের চোখে দেখা মায়ের রূপ কেমন? Asexual, অবশ্যই। কাজী হায়াতের আম্মাজান ছবির অপ্রকৃতস্থ মান্নার বয়ানে ‘পাকপবিত্র মাটি দিয়া গড়া দেহখান’ (অথচ এই মায়ের সেক্সুয়ালিটি নিয়েই পুত্র অত্যন্ত বিচলিত, মাকে ধর্ষিত হতে দেখেই তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে)।

নচিকেতার বৃদ্ধাশ্রম গানের মা পথ চেয়ে আছেন তার নাতি কবে ছেলেকে দিয়ে যাবে এই বৃদ্ধাশ্রমে, সেদিন তিনি সন্তানের মুখোমুখি বসতে পারবেন। পুরুষসন্তান (লেখক, চলচ্চিত্র পরিচালক, গায়ক) ভাবেন মায়ের কাছে সন্তানের সঙ্গ ছাড়া চাইবার কিছু নেই। মানে নাড়ী কেটে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করলেও অদৃশ্য এক আম্বিলিক্যাল কর্ড যেন আটকে রাখে মায়ের সঙ্গে সন্তানকে (হুমায়ুন আহমেদের ভাষায়)।
আসলে কি ব্যাপারটা তাই?

মায়েরা সন্তানকে ততদিন গর্ভে রাখেন যতদিন দরকার, এরপর বিচ্ছিন্ন না করাটাই বিপদের কারণ হয়। ততদিন কোলে রাখেন যতদিন নিজে হাঁটতে না পারে, এরপর কোল থেকে নামিয়ে দেন। জীবনের যে পর্যায় পর্যন্ত সন্তানের মাকে ছাড়া চলছে না, ততদিন আগলে রাখাই যথেষ্ট, প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকে কুক্ষিগত করে রাখা মানে তাকে অথর্ব করে রাখা, আত্মনির্ভরশীল হতে না দেওয়া (নচিকেতার গানের মা যেমন স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন ছেলেকে মুখে তুলে খাইয়ে দেবার কথা। সন্তান স্বাবলম্বী হলে তাকে খাইয়ে দিতে হবে না এইটুকু তো সব মায়ের বোঝার কথা, মেনে নেওয়াও উচিৎ)। আর ভালোবাসার কথা যদি ওঠে, সেটা শুধু মায়ের জন্য প্রযোজ্য কেন হবে? বাবাও একইভাবে ভালোবাসেন সন্তানকে। শাহরুখ খান এক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন “Kids are like pieces of my heart walking outside”, তাহলে বাড়াবাড়ি মহানতার দায় শুধু মায়েদের উপর কেন?

এইজন্যই কি যে এই দায়টা আরোপ করতে পারলে তাকে শোষণ করা, কাঠগড়ায় তোলা, বিচার করা সহজ হয়? কাউকে কাউকে ‘কুমাতা’ তথা ‘কুলটা’ বলে চিহ্নিত করতে সুবিধা হয়? নারীর ‘চরিত্র বিশ্লেষণে’র আরেকটি নিয়ামক বৃদ্ধি পায়?

প্রজাতির প্রয়োজনে মানুষ বংশবিস্তার করে। ব্যক্তি নারী (এবং পুরুষও) এই প্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন। সেটা নিলেই তিনি মানুষ হিসেবে অপূর্ণ হয়ে যান না নিশ্চয়ই।

এমেচেতার কাহিনীর ন্নু এগো একজন মা হবার জন্য মরিয়া নারী হলেও তিনি মোটেই যৌন অনুভূতিহীন সন্তান জন্ম দেওয়ার যন্ত্রটি নন। ভুঁড়িওয়ালা স্বামীকে প্রথমবার দেখে তাঁর যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় সেটি যেমন দেখিয়েছেন, সতীনের সঙ্গে তাকে শুতে দেখে যে জ্বলুনি হয় সেটিও বলেছেন লেখক। সম্ভবত এটিই পুরুষ লেখকের সঙ্গে নারী লেখকের মাতৃআখ্যানের পার্থক্য। পুরুষেরা নারীর মাতৃত্বটুকুকে রাখেন, নারীত্বকে ভুলে যান। আবার নারীকে যখন কাঙ্ক্ষিত, আবেদনময়ী হিসেবে সৃষ্টি করেন তখন ভুলে যান যে ইনিও একজন মা। মাতৃত্ব নারীত্বেরই ফল, ব্যক্তি নারীর জীবনেরই একটা অংশ। খুব আলাদা, খুব পবিত্র আর স্বর্গীয় কিছু নয়।

ন্নু এগো শেষ বয়সে গ্রামে চলে যান, যাবার সময় সন্তানদের বলেন “আমি সারাজীবনে একটা জিনিস শিখেছি, কীভাবে মা হতে হয়, তোমাদের মা হওয়া ছাড়া আর কিছুই হতে পারিনি”। অবিবাহিতা মায়ের সন্তান ন্নু এগোকে গ্রামের মানুষ খুব ভালোভাবে গ্রহণ করেনা, ন্নু এগোর সন্তানদের সবাই যখন নিজের নিজের জীবন বেছে নেয় তখন তিনি হয়ে পড়েন একেবারেই একা।

নারীর জীবনে মাতৃত্ব ছাড়া আর কিছুই না থাকলে তিনি আসলে খুব নিঃস্ব। যদি বলেন এটিই আমাদের সমাজের বাস্তবতা, তাহলে আমি বলবো এই বাস্তবতাকে পাল্টাবার সময় এসেছে।