September 20, 2024
ফিচার ৩ফিটনেস ও সুস্থতা

নতুন মায়ের বেবি ব্লুজ: কীভাবে সামলাবেন?

ডা. প্রমা অর্চি।। বলা হয়ে থাকে, একজন মায়ের কাছে নবজাতকের কান্নার থেকে মধুরতম শব্দ আর কিছু নেই। কিন্তু সেই নবজাতককে জন্মদানের দীর্ঘপ্রক্রিয়া থেকে শুরু করে পরবর্তীতে নানা পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ানোটা  সব মায়ের জন্য সহজ হয় না। গর্ভধারণ ও এর পরের সময়গুলোতে হরমোনের উত্থান পতন, শারীরিক পরিবর্তন এবং তার সাথে যুক্ত সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থা, দায়িত্ব বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি নানা কারণে নতুন মায়ের মনোজগতে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বহু মা বিষন্নতায় ভোগেন, সৃষ্টি হয় নানারকম মানসিক জটিলতা। কখনও কখনও এই বিষন্নতা মারাত্মক আকার ধারণ করে। প্রসব পরবর্তী মায়ের মানসিক সমস্যাকে তিনভাগে আলোচনা করা যায়-

বেবি ব্লু/ম্যাটার্নিটি ব্লু/পিউরপেরাল ব্লু/ পোস্টপার্টাম ব্লু (Baby Blues/Maternity Blues/Puerperal Blues/Postpartum Blues)

পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন (Postpartum Depression)

পোস্টপার্টাম সাইকোসিস (Postpartum Psychosis)

এই তিন ধরনের মানসিক সমস্যার মধ্যে ম্যাটার্নিটি বা বেবি ব্লু সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। বলা হয়ে থাকে, শতকরা ৮৫ ভাগ নতুন মা এই বেবি ব্লুতে ভোগেন। প্রসবপরবর্তী হরমোনের পতন, ক্লান্তি, ঘুমহীনতা, সামাজিক চাপ সব মিলিয়ে জন্ম দেয় এক ধরণের বিষন্নতার। এটা সাধারনত বাচ্চা ডেলিভারির পরের থেকে শুরু হয়, উপযুক্ত মানসিক সহায়তা ও পরিচর্যা পেলে দুই সপ্তাহের মধ্যেই বিষন্নতা কমতে থাকে।

বেবি ব্লুজের কারন

বেবি ব্লুজকে খুব কমন হিসেবেই ধরা যায়। অর্থাৎ বেশিরভাগ মায়ের এই সমস্যা হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। কারন হিসেবে মূলত হরমোনকেই দায়ী করা যায়। গর্ভধারণ সময়ে বেশি থাকা দু’টো হরমোন (ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন) হঠাৎ পতন হয় ডেলিভারির পর পরই। এর সাথে যুক্ত হয় মায়ের দীর্ঘ গর্ভকালীন-প্রসবকালীন ক্লান্তি, ঘুমের অভাব, শারীরিক পরিবর্তন ও পরিবর্তিত পারিপার্শ্বিকতা। সব মিলিয়ে বিষন্নতার শুরু।

বেবি ব্লুজের লক্ষণ

খুব সহজে মুড/মানসিক অবস্থার পরিবর্তন (মুড সুইং)

খিটখিটে ভাব

অকারনে কান্না পাওয়া/কাঁদা

মানসিক ভঙ্গুরতা/Mental fragility

অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা

অত্যধিক ক্লান্তি

ঘুমহীনতা (বাচ্চা ঘুমিয়ে থাকা সত্ত্বেও)

কোনো কাজে মনোযোগ দিতে না পারা

নিজেকে অযোগ্য/ অপ্রয়োজনীয়/ Worthless ভাবা

প্রতিকার ও করণীয়

সম্পর্ক মজবুত করুন

একা থাকলেই সময়ই বিষন্নতা বাড়তে থাকে। সেক্ষেত্রে যাদের ভালোবাসেন বা যাদের সঙ্গ আনন্দ দেবে, তাদের সাথে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। নিজের অনুভূতিগুলো চেপে না রেখে প্রকাশ বা শেয়ার করা এক অর্থে বিষন্নতামুক্ত হওয়ার একটা ভালো রাস্তা।

নিজের যত্ন নিন

প্রেগনেন্সি পরবর্তী শারীরিক পরিবর্তন অনেকেই ইতিবাচকভাবে নিতে পারেন না। ফলে লো মুড বা বিষন্নতায় ভোগেন। নিজের শরীর বা স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে। নিজের ভালো লাগার কাজগুলোতে ফিরতে হবে। ইচ্ছে হলে পার্লারে গিয়ে ফেশিয়াল, মেনিকিউর, পেকিকিউর করুন। স্পা নিন।নিজের পছন্দের আরামদায়ক পোশাক কিনুন।

ব্যায়াম ও মেডিটেশন

প্রেগনেন্সি পরবর্তী সময়ে ভারি কাজ এড়িয়ে হালকা ব্যায়াম ও হাঁটাচলা শুরু করা উচিত। ঘরের ছাদে কিংবা বাইরে ৩০ মিনিট হালকা হাঁটা ,স্ট্রেচিং বা ইয়োগা অনেকক্ষেত্রেই ডিপ্রেশনের উপযুক্ত ওষুধ হিসেবে কাজ করে। সেই সাথে মনকে প্রশান্ত করতে মেডিটেশন যথেষ্ট কার্যকরী।

উপযুক্ত খাবারঃ

বাচ্চা বা পরিবার সামলাতে গিয়ে খাবার বাদ দেওয়া যাবে না। উপযুক্ত পুষ্টিকর খাবার এইসময়ে মা ও বাচ্চা দুইজনের জন্যই জরুরি। এ সময় ভাল করে ভিটামিন ও মিনারেলযুক্ত খাবার খান, যথেষ্ট পানীয় পান করুন।

পর্যাপ্ত ঘুম

মানসিক অবসাদ ও স্ট্রেস কাটাতে নিয়মিত ৮/১০ ঘন্টা ঘুম অত্যন্ত জরুরি। একটা রুটিন ফলো করে ঘুমের ছক তৈরি করে ফেললে বিষন্নতা দূরীকরণে তা কাজে দেবে।

নিজেকে সময় দেওয়া

পরিবার পরিজন ও নবজাতকের পাশাপাশি নিজের জন্যও কিছু একান্ত সময় রাখতে হবে। সারাক্ষণ বাচ্চাকে নিজের কাছে না রেখে কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ে শিশুকে অন্য কারু দায়িত্বে রেখে নিজের মত কিছু সময় ব্যয় করুন। পছন্দের বই পড়তে পারেন। গান শুনতে পারেন এক টানা। এছাড়া মুভি দেখতে পারেন। নতুন কিছু বানাতে বা শখের রান্নাও করতে পারেন। বন্ধুদের সাথে বাইরে ঘুরতে যেতে পারে অল্প সময়ের জন্য। প্রিয় বন্ধুদের সাথে আড্ডায় স্ট্রেস রিলিভ হয়। মোট কথা যে কাজটা আনন্দ দেয় তা করার জন্য দিনে কিছু সময় বের করতেই হবে।

সঙ্গীর করণীয়

প্রসব পরবর্তী অবস্থায় স্বামী স্ত্রী দুইজনের উচিত পরবর্তী দায়িত্বগুলো ভাগাভাগি করে নেওয়া। বাচ্চা খালি মায়ের একার নয়। তাই বাচ্চার ও বাসার কাজ দু’জনে ভাগ করে নিলে নতুন মা অনেকাংশেই রিল্যাক্সড ফিল করবে। সহযোগী মনোভাব নিয়ে পাশে থাকা খুবই জরুরি। স্বামীর উচিত স্ত্রীকে সময় ও উৎসাহ দেওয়া যাতে সে কোনোভাবেই একাকী বোধ না করে। মেন্টাল সাপোর্ট এই অবস্থা উত্তরনে সবচেয়ে কার্যকরী।

রেড ফ্ল্যাগ সাইন

সাধারনত দুই সপ্তাহ পরে বেবি ব্লুজের লক্ষণ ধীরে স্তিমিত হতে থাকে। যদি দুই সপ্তাহ পরেও লক্ষণ থেকে যায় কিংবা মায়ের খাওয়া, ঘুম ও সাধারন জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, অথবা মা যদি নিজেকে তার সন্তান/পারিপার্শ্বিকতা থেকে গুটিয়ে নেন, তাহলে বুঝতে হবে তা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের দিকে চলে যাচ্ছে। শতকরা ৪-৫ ভাগ মহিলা এই বেবি ব্লুজে থাকতে থাকতে পোস্টপার্টাম সাইকোসিসে আক্রান্ত হতে পারেন, যেটায় মা আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠতে পারেন। এটি ঘটলে হ্যালুসিনেশন হয়ে থাকে এবং এতে সন্তানের ক্ষতি করার প্রবণতাও আসে মায়ের ভেতরে, যা খুবি আশংকাজনক। সেক্ষেত্রে দেরি না করে অবশ্যই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে জরুরি ভিত্তিতে।