November 1, 2024
জীবনের গল্পফিচার ৩

“পুরুষ, তবু নিস্তার পাইনি…”

সাদিয়া মেহজাবিন।। নারীর সাথে ঘটে যাওয়া শারীরিক নিপীড়ন এখনো বুঝতে চায় না আমাদের সমাজ। অথচ প্রতিনিয়ত এসব ঘটছে।আবার পুরুষও শৈশব থেকে তারুণ্যে শিকার হচ্ছেন এমন কিছু ঘটনার যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। নারী যেমন বলতে চান না চক্ষুলজ্জায়, ভয়ে; তেমনি পুরুষও বলতে ভয় পাচ্ছেন তাদের সামাজিক অবস্থানের জন্যে।

দেখা যায়, অনেক পুরুষের কাছে এসব ব্যাপার তুচ্ছ কিংবা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে শক্তি বজায় রাখতে তারা তাদের এসব বিষয়কে লুকিয়ে রাখেন। কেননা তারাও জানেন, এ সমাজ মেনে নেয় না সমাজের কালো দিক। তবে এটি সত্য যে, পুরুষের সাথে এমন নিপীড়ন তাদের মনোবিকল ঘটাতে পারে, বিকৃত যৌনতার দিকে আগ্রহী করতে পারে, যার ফল অন্যদের ভোগ করতে হয়।

কিছুদিন আগে আমার এক পরিচিত ব্যক্তির সাথে খোলামেলা কথা হচ্ছিলো তার জীবনের কিছু কালো স্মৃতি নিয়ে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিনি, কেবল তার নামই নয় তার সাথে যারা এমন করেছেন তাদের নামও প্রকাশ করতে চান না। তিনি মনে করেন তারা যা করেছে তা অন্যায়, তবে তার জন্যে অন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হোক তা তিনি চান না। আমি এখানে তার দেওয়া বর্ণনা অবিকল তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

“আমার বাবা একজন সরকারি কর্মকর্তা। আমরা সবাই মিলে ঢাকা থাকতাম। সে সময়ে অল্প বেতনে ঘর চালানো মুশকিল। আমার কাকা পরামর্শ দেন আমাদেরকে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যেতে, তাহলে ব্যয় কিছু কমবে এবং সঞ্চয় হবে। আমরা চলে যাই গ্রামের বাড়ি। ছোটবেলা থেকেই খুব আদুরে দেখতে লাগত আমাকে। শহুরে ছেলে গ্রামে গেলে সবাই একটু বেশি আদর করে। গ্রামে আমাদেরই সম্প্রদায়ের হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার ছিল। সে সুবাদে আমদের মধ্যে সম্প্রীতি ছিল। আমার তখন বয়স ৮ বা ৯। আমার দূর সম্পর্কের এক পিসি, আমাদের পাশেই থাকতেন। পিসির বয়স ১৬ কি ১৮। আমাকে তিনি আদর করতেন ভীষণ, তা মিথ্যা নয়। একেকদিন একেক জায়গায় থাকতাম। পিসি বললেন, “রাতে আমাদের সাথে থাকিস”, আমিও রাজি হয়ে থাকতে যেতাম রাতে।

হঠাৎ একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। উঠে  দেখি পিসির হাত আমার শরীরে এবং তিনি আমার শিশ্নে হাত দিচ্ছেন। আমি ঘামতে শুরু করি তবে আমি বুঝতে পারি না আমার সাথে কী হচ্ছে। এমন ঘটনার পর থেকেই পিসি আমার পাশে আসলে আমি খুব সংকোচ করতাম। এরপর ভালো স্কুলে পড়ার  সুবাদে আমরা চলে গেলাম ১৫-১৬ কি.মি দূরের মফস্বলে। তখন আমার বয়স ১৪। আমরা প্রতিদিন খেলতে যেতাম পাশের মাঠে। সেখানে কিছু বড় ভাই ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন আমাদেরকে কিছু ভিউকার্ড দেখাতেন। সেখানে ছিল কিছু পর্নগ্রাফি। আমাদের কিশোর বয়স তাই এসবের প্রতি আকর্ষণ থেকেই আমরা দেখতাম খুব আগ্রহ নিয়ে। আর যেহেতু আমাদের সেক্স এডুকেশন নেই, তাই আমরা এসব দেখতে প্রায়ই যেতাম সেই দাদার কাছে।

একদিন দাদা আমাকে বললো, “নতুন কিছু মাল আসছে। শুধুই তোকে দেখাব। যদি দেখতে চাস তাহলে কাল দুপুর ৩টায় আমার বাসায় আসিস”। আমি কিশোরের কৌতূহল নিয়ে দুপুরের পরে গেলাম। গিয়ে দেখি তার বাসায় কেউ নেই। আমাকে তিনি দেখালেন সেসব নতুন জিনিস এবং বললেন, “চল আমরাও এমন করি”। আমি বললাম, “না আমরা কীভাবে করব?” তিনি তাও জোর করে আমার প্যান্ট খুলে ফেললেন, আমাকে চুমু খেতে শুরু করলেন। বিছানায় যখন শোয়াতে যাবেন তখন আমার সংকোচ আরো বেড়ে গেল এবং আমি বললাম, “দাদা আমি এখন চিল্লাব, আপনি এসব কী করছেন?” বলেই পালাতে যাব তখন তিনি আমাকে মানা করলেন আমি যেন কাউকে এসব না বলি। আমিও এসব কাউকে বলিনি তবে যখনই উনাকে দেখতাম খুব ভয় পেতাম।

আমি ছোট থেকেই একটু  স্বাস্থ্যবান ছিলাম। আমরা যখন পুকুরে গোসল করতে যেতাম তখন উপরের জামা খুলতে লজ্জা পেতাম এবং ভালো সাঁতার জানতাম না। ফলে বন্ধুরা আমাকে পুকুরে নিয়ে আমার স্তনের দিকে চাপ দিত। বেশি চাপ দেওয়ার ফলে আমি প্রচুর ব্যথা পেতাম। তারা আমার পশ্চাৎদেশে আঙ্গুল দিত। আমি ডুবে যাব ভয়ে তাদের ধরে রাখতাম। তারা ভাবত আমি মজা পাচ্ছি তাই তারা বলত তাইলে আরো একটু করি। আমি এত বেশি ভয় পেতাম যে পরে আর যেতাম না পুকুরে। তারা আমার কাপড় নিয়ে ঘাটে রেখে দিত যেন আমি উলঙ্গ হয়ে উপরে আসি।

আমার জীবনের সবচেয়ে করুণ ঘটনাটি যখন আমি ইন্টার প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমাদের বাড়ি থেকে কলেজ প্রায় দুই কিলোমিটার। কলেজের পাশের গ্রামের এক ভাইয়া ছিলেন যিনি সেনাবাহিনী থেকে চলে এসেছেন বা তাকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তিনি কলেজে এসে আমাদের বন্ধুদের সবাইকে চা নাস্তা খাওয়াতেন। যেখানে যাতায়াত খরচ বাদে ৫ টাকা থাকত সেখানে এভাবে আপ্যায়ন বেশ মজাদার। এভাবে তিনি আমাদের প্রিয় হয়ে উঠলেন। একদিন তার বাসায় আম কাঁঠাল খেতে নিমন্ত্রণ জানালেন। আমরা ৫-৬ জন গিয়েছিলাম। এত ভালো দাওয়াত খাওয়ানোর পর সে সময়ের বক্সাকারের কিছু টিভি ছিল সেসবে তিনি একটি পর্ন মুভির মত ছেড়ে দেন। যেখানে আমরা ভিউকার্ড কিংবা কাটপিস দেখে আসছিলাম এতদিন, সেখানে এমন জিনিস দেখে আমাদের চোখ কপালে। কিছুদিন পরে আমি আমার আগ্রহের কারণে তার বাসায় তাকে দেখতে যাবার ভান করে গিয়েছিলাম। আমার ইচ্ছে ছিল মুভি দেখার। তিনিও বুঝে গেছেন আসলে আমি কেন এসেছি। তাই তিনি এক জাপানি পর্ন ছেড়ে দেন। কিছু সময় পর বললেন, “আয় আজকে তোকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দিই”। আমার আগের অভিজ্ঞতার কারণে আমি ভয় পাই এবং বলি, “আমি জানি আপনি কী করবেন, আমি এসব করব না! আমি চলে যাব”। তিনি আমাকে বুঝালেন তিনি এমন কিছুই করবেন না বরং অন্য কিছু দেখাবেন। তাই দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমার প্যান্ট খুলে আমার শিশ্ন তার মুখে নিলেন। আমি জানতে পারলাম তিনি সমকামী কিন্তু প্যাসিভ ভূমিকা পালন করেন। তিনি চাইলেন আমাকে অ্যাক্টিভ ভূমিকা করতে, আমি রাজি না হওয়াতে তিনিই আমার সাথে বিভিন্ন কার্যকালাপ করতে শুরু করলেন। আমি নিস্তার পেতে অজ্ঞানের অভিনয় করলাম। তিনি আমাকে  পানি খাওয়ালেন এবং যেতে দিলেন। আমি এক দৌঁড়ে বাসায় এসে গেলাম এবং ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। এরপর তার সাথে আমার আর দেখা হয়নি, তবে শুনেছি তিনি এমন ছেলে সাপ্লাই নিতেন। তিনি সমকামী ছিলেন, কখনো বিয়ে করেননি। এসবের পর আমি চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষালাভের জন্যে চলে আসি তবে এখানে এসে বাসে যাতায়াতে এমন কিছুর সম্মুখীন হলে আমি এখন প্রতিবাদ করি”।

এমন কিছু শুনে আমার মন খুবই খারাপ হয়। কেননা আমরা মেয়েরা জানি এসব কিছু কত বেদনা দেয়। উপরের ঘটনাতে আমি কেবল দেখতে পাই আমাদের সমাজের কালো দিক। এত সব কিছুর পরও তিনি সুকুমারবৃত্তির চর্চা করেছেন ও রুচিশীল মনোভাব ধরে রেখেছেন।আমাদের সবাইকে উৎসাহ দেন শক্ত হতে। নিজেকে এগিয়ে নিতে।

আসুন আমরা সমাজের ভন্ডামির প্রথা ভেঙ্গে সত্য বলার সাহস করি। সঠিক যৌনশিক্ষা দিয়ে সুস্থ সমাজে তৈরি করি, তাহলে কোনো মানুষকে এসব বিকৃতির শিকার হতে হবে না।

(নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাক্তির অনুমতি নিয়ে লেখা হয়েছে এবং তথ্য অবিকৃত রাখা হয়েছে)

ছবি: ইন্টারনেট