বৌ-শাশুড়ি-ননদ চক্র: লাভের গুড়টা খাচ্ছে কে?
ডা. মৌমিতা শীল।।
১
নীরার আট মাস চলছে। জরায়ুতে বেশ বড় ফাইব্রয়েড টিউমার ধরা পরেছে। আজকাল প্রায়ই অসুস্থ থাকে, তাই ঢাকার একটা নামী হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে অপারগ হলো সে। চাকরি ছেড়ে বাসায় আছে এখন। গ্রামের বাড়ি থেকে শ্বশুর-শাশুড়ি এসেছেন। শ্বশুর অসুস্থ। তাকে প্রায় প্রতিদিনই ডাক্তার দেখানো চলছে। সকালে উঠে সারাদিনের রান্না করে, তারপর শ্বশুরকে ডাক্তার দেখানোর সময়ও সে সাথে যায়। ফিরতে রাত ৯/১০ টা তো বাজেই। এই কাজটা মন থেকেই করছে, যদি শ্বশুর না হয়ে নিজের বাবা অসুস্থ হতো, সে কি না গিয়ে পারতো, এই চিন্তা থেকেই করছে। শ্বশুরের ডায়াবেটিস, ভোরে ওঠা অভ্যাস। সুতরাং সকাল ৬টায় নাস্তা রেডি থাকতে হবে। সাথে গোসলের গরম পানি। সেইমত ব্যবস্থা করতে গিয়ে দেখা গেলো রুটি-সবজি শ্বশুরবাবার মনমত হচ্ছে না। সেই সাথে নানা কাজে নানা ত্রুটি পাচ্ছেন তারা, বিশেষ করে শাশুড়িমা।
– ঘর টিপটপ না ক্যান? ঘর গুছানো শেখো নাই?
– আলমারির একি অবস্থা,গুছাও না কয়দিন!
– রান্নাঘরে এতো জিনিস গাদায় রাখছো ক্যান?
– চা বানাইছো নাকি! এ কি রকম চা?
– এরকম সবজি আমরা খাই না। ঝোল এত কম দাও কেন?
– তরকারিতে স্বাদ হয় না, কি রান্ধো!
– তিনবেলা গরম খাবার খাই আমরা। তিনবেলা রান্না করবা।
– ফ্রিজের জিনিস খাইনা আমরা। সব ফ্রেশ খাবার খাই। সেইটা বুঝে রান্না করবা। একবারে বেশি রাইন্ধা ফ্রিজে রাইখা সেই খাওয়া আমাগো দিবা না।
– তুমি এতো শুয়ে থাকো কেনো? আমরা কত কাজ করছি এই সময়ে। তোমার এত শরীর খারাপ লাগে ক্যান!
– মাথায় ঘোমটা দাও না ক্যান? গরম লাগে, অস্থির লাগে এইগুলা কোন কথা? আমরাও বাচ্চার মা হইছি।
– পেটে টিউমার! ও মা! শুনিও নাই জীবনে এরকম কিছু। আমাগোও তো বাচ্চা হইছে।
– এত অষুধ খাও ক্যান? আমরাও তো মা হইছি…ব্লা ব্লা ব্লা।
এদিকে টেবিলে সব খাবার গুছানো, কিন্তু তারা কে কখন খাবে কিছুর ঠিক নাই। আট মাসের প্রেগন্যান্ট নীরার খালি খিদা পায় আর ক্লান্ত লাগে। এত দৌঁড়ঝাপ আর ‘কী নিয়ে কী অপছন্দ হবে’ সারাদিন সেই টেনশনের পর তার আর শরীর চলে না। সে ঘুমিয়ে পড়ে। আর শাশুড়ি নিজের মেয়ের সাথে মোবাইলে আলাপ করে-
‘‘বৌ কোনো কাজের না। সারাদিন শুয়ে বসে থাকে। এই দেখ এখন ঘুমায় পড়ছে, ভাত বাড়া লাগবে সেই খেয়াল আছে! কিচ্ছু শেখে নাই।’’
মেয়েও ওপাশ থেকে প্রবল সমর্থন দেয়। ব্যাপার এমন দাঁড়ায় যে উঠতে বসতে গেলেও অনুমতি নেয়া প্রয়োজন হয়ে পরে যেন! না হলেই মুখ ভার।
একদিন দু’দিন এমন করে করে শেষ পর্যন্ত নীরার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গে, সে এসব বিবেকহীন অসভ্য আচরনের উপযুক্ত প্রতিবাদ করে এবং
‘‘ঘর ভাঙ্গানী ছেলের মাথা খাওয়া অভদ্র বৌ’’-খেতাব পায়।
২
নীরার ননদ, দুই মেয়ের মা, ইকোনমিকসে অনার্স-মাস্টার্স, নিজেকে ঘর ম্যানেজমেন্ট ও শিশু পালনে ব্যস্ত রেখেছেন। জামাই চায় না, তাই চাকরির সুযোগ পাওয়ার পরেও করেন না। এদিকে সংসারের বাড়তি খরচটা আবার চাকুরিজীবী মায়ের কাছ থেকেই বের করে নেন। আর মা-ও দিতেই থাকেন দিতেই থাকেন, কিন্তু নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছা-বুদ্ধিহীন এমন মেয়ে, তার মতো স্বনির্ভর মায়ের পেটে কী করে জন্মালো সে চিন্তা করেন না। উল্টো সংসার টিকিয়ে রাখতে নানা ছাড় দিতে পরামর্শ দেন ও নিজের স্বাবলম্বী স্পষ্টভাষী (তার ভাষায় কটুভাষী) ছেলের বৌয়ের নানা গীবত করে দিন কাটান।
ননদও তেমনই, স্বামী ও মা, এই দুইজনের ঘাড়ে বসে আরামে (!) খেতেই তার ভালো লাগে। শ্বশুরবাড়িতে মাথা নীচু করে তাদের ‘হ্যাঁ’-তে হ্যাঁ ও ‘না’-তে না মিলিয়ে যদি চাকরি-বাকরির কষ্ট ছাড়াই আরামে দিন কাটানো যায় তাতে সমস্যা কি! আর মা তো আছেই, তাই ভাইয়ের বৌয়ের নামে কানকথা লাগিয়ে, একচোখা মায়ের মাথাটা আরেকটু উত্তপ্ত করে দিয়ে ‘খালি আমিই তোমাকে সাপোর্ট দেই’-এরকম বুঝ দিয়ে যদি মায়ের থেকে আরো কিছু টাকা খসানো যায় তো মন্দ কি! এভাবেই চলতে থাকে কিছু ছারপোকার জীবন।
এদিকে পোয়াতি, অসুস্থ ছেলের বৌ কী কী কাজ পারে না তার লম্বা লিস্টি বানানো শাশুড়িমা নিজের মেয়ের বেলায় দফায় দফায় কাজের লোক পাঠাতেই থাকেন। ‘তার আদরের মেয়ে, কাজকর্ম কিছু করেছে নাকি কখনো, যে এখন করবে!’
৩
নীরার মাসি শাশুড়ি, ধরে নিচ্ছি ভদ্রমহিলার নাম জয়া। তার দুই ছেলে এক মেয়ে। দুই ছেলের দুই বৌ পালা করে রান্নাবান্না করে। সুবিশাল বাড়ি ও ক্ষেত খামার দেখাশোনার দায়িত্বও তাদের। বিয়ের পর প্রথম বছর ২/৩ বার বাবার বাড়ি যেতে দেয়া হয়েছিলো তাদের। তারপর থেকে বছরে একবার, কোন কোন বছরে একবারও যেতে দেয়া হয় না। এরা দিন কয়েকের জন্য বাপের বাড়ি গেলে, তার এত্ত বড় বাড়িঘর সামলাবে কে!
বড় ছেলে মানসিক রোগে আক্রান্ত। যথারীতি মেয়ে পক্ষকে কোন কিছু না জানিয়েই ছেলে বিয়ে দিয়ে ঘরে এনেছিলেন বড় বৌকে। সে প্রায় নিঃস্ব ঘরের মেয়ে। বর্তমানে বড় বৌ দুটি ছেলের মা, এক ছেলের জন্মগত হার্টের সমস্যা। নিজের অতি কষ্টে অর্জিত শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শাশুড়ির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চাকরি করতে পারেনি। মানসিক ও অর্থনৈতিক সাপোর্ট দিতে অক্ষম জামাই, সেই সাথে রুগ্ন বাচ্চা, নিজের সকল যোগ্যতার জলাঞ্জলী, এতদিনের সংসার পরিক্রমায় ক্লান্ত ও প্রবঞ্চিত বড় বৌ আজকাল কাজের খেই প্রায়ই হারিয়ে ফেলে। ঠকিয়ে ছেলে বিয়ে দিয়ে আরেকটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিয়েছে- এতে লজ্জা পাবে কি, উল্টে কাজেকর্মে কোথায় কী ত্রুটি হচ্ছে সেই হিসাব নিতে সদাই ব্যস্ত জয়াদেবী।
ওদিকে নিজের মেয়ের বিয়ে হয়েছে ১৫ বছর। এই ১৫টি বছরে ১৫ মাসও শ্বশুরবাড়ি থাকতে দেন নি মেয়েকে। ছলে বলে কৌশলে, নানা মিষ্টি কথায় ও নানা উপচারে মন ভুলিয়ে, জামাই-মেয়ে, নাতিসহ বলা যায় নিজের বাড়িতেই প্রতিপালন করছেন। অন্যের বাড়ির মেয়েরা বিয়ে করে তার বাড়ি এসেছে, তারা কাজ করে খাবে- সেটাই নিয়ম। আর নিজের মেয়ের বিয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে, সে কি কাজের লোক নাকি যে পরের বাড়ি কাজ করতে বাধ্য হবে!
এক যাত্রায় পৃথক ফলের আভাস পাওয়া যাচ্ছে তাই না?
তিনটা সিনারিও। একই নারীর বিভিন্ন রূপ। কেন এমনটা হলো?
কারন সমাজ তাকে শিখিয়েছে এটাই নিয়ম, ‘এটাই সায়েন্স’।
-বিয়া হইছে এখন শ্বশুর বাড়ির ঘর সামলানির সব কাজ তোমার,পারলেও, না পারলেও।
– তুমি চাকরি করো? ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার, কর্পোরেট ব্যারন, ভার্সিটির টপার? তো কী হইছে তাতে!
– তুমি রানতে পারো?
– ঘর গুছাইতে পারো?
– সবার খাওয়া শেষ হইলে তুমি খাবা, সেইটা শিখছো?
– তোমার জন্যে শ্বশুরঘর, বর আর বরের ফ্যামিলি- আত্মীয়ই হইলো ধ্যান-জ্ঞান,বাকি সব পরে, তাদের কথামত চলতে হবে, উঠতে বসতে হবে, এইটা শিখছো?
– তুমি চাকরি করো কি না করো, সুস্থ থাকো কি অসুস্থ থাকো, মরো কি বাঁচো, তোমাকে আগে ঘর ফিটফাট রেখে সক্কলের মন যুগায়ে তারপর বাইরে যাইতে হবে। যদি না পারো তো চাকরি ছাড়ো।
– মেয়েমানুষের চাকরির কি দরকার?
– দুই কাজ একসাথে পারবা না আগেই জানি তাই তোমার চাকরি-বাকরির খ্যাতা পুরি। আগে থেকেই চাকরি নট।
– আর যদি সব ঠিক রেখে চাকরি তুমি করোই তো বেতন পেলেই টাকাটা শ্বশুর কিংবা জামাইয়ের হাতে তুলে দিবা। তুমি মেয়ে মানুষ, টাকাপয়সা তোমার হাতে থাকার দরকার কি!
তো এইভাবেই ‘মানিয়ে’ চলতে অভ্যস্ত হওয়া মেয়েটি একদিন মা হয়, সেখানেও তাকে ছেলে বাচ্চার জন্ম দিতে পারা নিয়ে মানসিক চাপে রাখা হয়। সেই সাথে দেয়া হয় একটি অলিখিত কিন্তু দৃশ্যমান লোভের হাতছানি। সেটা হলো এমন-
আজ তুমি ঘরের বৌ, তোমাকে আজ মাথা নোয়ায়ে চলতে হচ্ছে। শাশুড়ি মাথার ওপর ছড়ি ঘোরাবে, মেনে নিতে হচ্ছে বিনা বাক্যব্যয়ে। শ্বশুরবাড়ির সব ডিশিসান মেনে নিয়া ভালো বৌয়ের খাতায় নাম লেখাতে হচ্ছে। You know, তোমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত- সকল কিছুর নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই আছে।
এরপর তুমি মা হচ্ছো। যদি ছেলে সন্তানের মা হতে পারো তো তোমারও কেল্লা ফতে। একদিন তুমিও ছেলের বিয়ে করা বৌয়ের ওপর এমন মাতব্বরি করে, পদে পদে দোষ ধরে, সংসারের পূর্ণ কর্তৃত্ব নিয়ে বড় আরামেই চলতে পারবে। তোমার শাশুড়িরও তো একদিন তোমার মতই অবস্থা ছিল। তাই এখন এইসব মেনে নিয়ে চলো। তাতেই সংসারে ‘সুখ’ (!) বজায় থাকবে।
এভাবে দিনের পর দিন পুরুষতন্ত্রের চাপে পিস্ট হয়ে তারা মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলেন। শাশুড়ি হওয়ার পর নীরার শাশুড়ি ও মাসীশাশুড়িরা তাই এমন অসভ্যতা ও ইতরামি করে থাকেন। তারা মনে করেন, মেয়েদের ওপর এইরকম নির্যাতনই সংসারের নিয়ম।
নিজের মাকে সংসারে কলুর বলদের মতন খাটতে দেখেছে নীরার ননদ। মা চাকরি, সংসার সবই করেছেন, খাটতে খাটতে মুখে রক্ত উঠলেও কারো কাছে প্রশংসা কিংবা সহযোগিতা পান নি। উল্টো বাবা তার মাকে প্রায়ই গালাগালি করতো, সে সঠিকভাবে সংসার গুছিয়ে করতে পারছে না, এই অভিযোগ ছিলো প্রতিদিনের, চাকরি করা নিয়ে গঞ্জনাও। কিন্তু মাস শেষ হলে বেতনের টাকা মায়ের কাছ থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে নিতে বাবার বাঁধতো না মোটেই। কারন মেয়েমানুষের হাতে টাকা থাকবে কেন! তাছাড়া এটা তো সংসারেরই টাকা। সংসারের কর্তার হাতেই থাকবে।
তো এই যখন অবস্থা তখন এতো কস্ট করে পড়ে কী লাভ? ধরে নিলাম ভালো বিয়ের জন্য পড়ালেখা যদি করাও লাগে তো চাকরি করারই বা কী দরকার? টাকা তো নিজের হাতে থাকছে না। চাকরি+সংসার+বাচ্চা সব সামলে নেই কোনো প্রশংসা বরং তিরস্কার।
তাই বিয়ের পরে চাকরির কস্ট না করে জামাই ও তার পরিবারের মন যুগিয়ে যদি ভালো থাকা যায় সেই তো ভালো! তাতে মান সম্মান থাকুক কি যাক সেটা বড় কথা নয়! আসলে সম্মানবোধ এদের তৈরিই হয় না। যেসব বাচ্চা নিজের পরিবারে মায়ের ওরকম পরিনতি দেখে বড় হয়, সেসব বাচ্চার অধিকাংশই এটাকে স্বাভাবিক বলে ভেবে নেয়। আর মেয়ে বাচ্চা হলে কথাই নেই। তাকে শেখানো হয়, মেয়েদের এভাবেই চলতে হয়, মানিয়ে নিতে হয়।
এমন আত্মমর্যাদাহীন,পরনির্ভরশীল মহিলা মহলই তো চায় পুরুষতন্ত্র। এতে ঘরের কর্তৃত্ব পূর্ণভাবে পুরুষের হাতেই থাকে আবার নারীর থেকে তোয়াজ, খাতির, আদর, যত্ন, বন্দনাও পাওয়া যায়। ওদিকে মেয়ের মা যেহেতু শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন কী তা জানেন এবং তার নিজের ও তার মেয়ের কোনো আত্মমর্যাদাই যেহেতু গড়ে ওঠেনি সেহেতু তিনি মেয়েকে স্বনির্ভর হওয়ার পরামর্শ দেন না, বরং মেয়ের শ্বশুরবাড়ি ও মেয়ের জামাইকে তোয়াজ করে, তেল দিয়ে, টাকা দিয়ে, পয়সা দিয়ে, ভালো ভালো উপহার দিয়ে যেমন করে হোক মেয়ের প্রতি নরম রাখার চেষ্টা করেন। এই যেমন- ঘরের সব কাজ তো মেয়েরই করতে হবে তাই প্রক্সি হিসেবে নিজের উদ্যোগে কাজের লোক পাঠিয়ে দেন।
কিংবা মেয়ের হাতে টাকা পয়সা তুলে দেন। জামাই কখনো কখনো দেখে না দেখার ভান করে থাকে, আবার ডাইরেক্ট বা ইনডাইরেক্টলি টাকাপয়সার চাপও দিয়ে থাকে। মেয়েও তেমনি গা ভাসিয়ে চলতে থাকে আর স্বাবলম্বী মেয়েগুলোর কুৎসা করে অলস সময়টা পার করতে থাকে।
আরেক প্রকার নারী আছে যারা অন্যের মেয়ের ওপর চরম অত্যাচারটা ঠিক মতো করে নেয়। আর নিজের মেয়ের বেলায় আল্টা প্রটেক্টিভ হয়। যেহেতু এরা পরের মেয়েকে অত্যাচার করে থাকে সেহেতু নিজের মেয়ের ব্যাপারে ভীতিটা এদের বেশিই। এরা নানাভাবে কুটকাচালি করে মেয়েকে ও জামাইকে সরিয়ে আনে নিজের কাছে। সে কায়দাও ব্যাপক, কখনো নরম কখনো গরম, ত্যারাব্যাকা সব পদ্ধতির ইস্তেমাল শেষে এরা মেয়ে জামাইকে নিজের ঘরে যত্ন করে তুলে রাখেন, যেন মেয়ের গায়ে কুটোটির আঘাত না লাগে। সমাজের নিয়মে (!) তো সম্ভব নয়। তাই এই নষ্ট উপায়ে নিজের মেয়েকে সিকিউর করার প্রচেষ্টা। ওদিকে নিজের বাড়ির ভাইবৌদের ওপর সর্দারির দায়িত্বটি তখন ভাগ করে নেয় সুবিধাপ্রাপ্ত মেয়েটি।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রত্যেকটি সিনারিওতে আখেরে লাভ কিন্তু পুরুষেরই। এইসব পুরুষবাদী নারীদের বেশি দোষ দিয়ে লাভ নেই। এরা আজীবন পুরুষতন্ত্রের চাকায় পিষ্ট হয়ে এই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। এরাও এককালে নিজের শাশুড়ির কাছ থেকে, ননদের কাছ থেকে, নিজের জীবনসঙ্গীর কাছ থেকে খারাপ ব্যবহার পেয়েছে, অসহযোগিতা ও অত্যাচার পেয়েছে। এটাকেই এরা নরমাল মনে করে নিয়েছে-
পরের বাড়ির মেয়ে সংসারে আসবে আর কাজের লোকের মত খাটবে, এটাই নিয়ম আর তাকে দাবিয়ে রাখতে খারাপ ব্যবহার করা চলবে। আর নিজের মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে সেফ রাখতে হলে সে বাড়িতে নিয়মিত বশ্যতা স্বীকার করে, তাদেরকে তেলিয়ে তেলিয়ে চলতে হবে।
এভাবে পুরুষতন্ত্র মেয়েদেরকেই মেয়েদের শত্রু করে তুলেছে আর সুবিধাটা চূড়ান্তভাবে আদায় করে নিয়েছে। এতে করে কী হয়?
মেয়েরা ঘরের শত্রুতা, ঝামেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে বাধ্য হবে। এই প্রতিবন্ধকতার কারনে বাইরের দুনিয়ার দিকে নজর দিতে সময় পাবে না, চাকরি,পড়ালেখা শিকেয় উঠবে। তাতে পুরুষ বাইরে একচ্ছত্র ও প্রায় অর্ধেক প্রতিযোগীবিহীন অবস্থান পাবে। সেই সাথে ঘরে পাবে অসচেতন, পরনির্ভরশীল, আত্মমর্যাদাহীন, আত্মবিশ্বাসহীন একদল অনুগতের নিশ্চিন্ত সেবা!
এ বড় জটিল খেলা। যতই বলি শেষ হবে না।
মেয়েদের বলছি, যদি সত্যিই এইসব অসভ্যতার শেষ চান তো নিজের ছেলেমেয়েকে সুশিক্ষা দিয়ে বড় করার চেষ্টা শুরু করুন।
তাদেরকে, বিশেষ করে ছেলে বাচ্চাকে বোঝান যে তারা আগে মানুষ পরে তাদের লিঙ্গ পরিচয়। বিপরীত লিঙ্গকেও আগে মানুষ ভাবতে ও সেইমত সম্মান করতে শেখান। মানুষ হিসেবে মানবিক সকল অধিকার, দায়িত্ব ও সম্মান পাওয়ার সবটুকুর সমান ও সুষম অধিকার নারী ও পুরুষ উভয়েরই আছে- এটা বুঝতে শেখান।
ঘর, পরিবার সবার। তাই বাসার কাজ, ঘরের কাজ কারো একার না, বাসার সব কাজ ছেলে মেয়ে উভয়কে জানতে হবে ও সুষম বণ্টনের মাধ্যমে ভাগ করে নিতে হবে। কাজের কোনো ছেলে মেয়ে ভাগ নেই। যার যতটুকু করার সময় ও সামর্থ আছে সে সেইটুকু করে সংসারের কাজ শেয়ার করে নেবে। সংসারের আর্থিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কারো একার না। স্ত্রী পুরুষ উভয়েরই। তাই স্বাবলম্বী হতে হবে দুজনকেই।সন্তান পালন কখনোই একা মায়ের কাজ না। মা-ই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থাকেন ও তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করেন- মায়ের তুলনাহীনতার কারন এটাই। এরপর শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যেও বুকের দুধ দিয়ে সন্তানকে লালন করেন। মানব প্রজাতির টিকে থাকার জন্য মেয়েদের অতিরিক্ত শারীরিক-মানসিক শ্রম দিতে হয়। সেই সময়ে তাকে নানাভাবে সহযোগিতা করা মানে পৃথিবীর বুকে নিজের/নিজেদের টিকে থাকার ব্যাপারটিকেই এগিয়ে নিতে সহায়তা করা। এতে যেমন তার প্রতি কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ করা হয়, তেমনি দায়িত্বে অংশগ্রহণও নিশ্চিত হয়।
কেউ কাউকে ছোটো করে কেউ বড় হতে পারে না। অসহযোগ, অকৃতজ্ঞতা মানুষকে হীন করে। পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্মান প্রদর্শন বড় সাফল্য ও সুখ-শান্তি আনে, এই অবধারিত সত্য ধারনাটুকু বাচ্চাদের মনে গেঁথে দিতে হবে। সুন্দর ও শুভ পরিবর্তন একদিন আসবেই।