কদর্য সমাজে নারীর প্রেমের পরিনতি প্রতারণা ও নির্যাতন
শারমিন শামস্।। বাংলাদেশে আর কত আজব আজব ঘটনা ঘটবে, মাঝে মাঝে ভাবি। নৃশংসতা আর নির্মমতাকে কতবার ছাড়িয়ে যাবে এই সমাজ, সেটাও। প্রতিদিন যে অজস্র নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে, সেসবের বেশিরভাগেরই বিচার তো হচ্ছেই না, উল্টো নির্যাতিত নারী ও তার পরিবারকে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এবার সব হয়রানির যেন সীমা ছাড়িয়ে গেল।
মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার নহাটা ইউনিয়নের কলেজছাত্র শাহাবুলের (১৯) সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ১৫ বছরের একটি বাচ্চা মেয়ের। এর সূত্র ধরে শারীরিক সম্পর্ক। ফলে মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে।
অভিযোগ নিয়ে মেয়েটির চাচা যান মহম্মদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নহাটা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা সিদ্দিকি ওরফে লিটনের কাছে। দুই দিন পর সালিস বসানো হয়। মোস্তফা সিদ্দিকির নেতৃত্বে ওই সালিসে শত শত মানুষ উপস্থিত ছিলো।
সালিসে কী হয় জানেন?
সালিশে বলা হয়, বিয়ের আগে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার অভিযোগে মেয়েটির পরিবারকেই ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে।
কী দারুন না!
টাকা দেবার জন্য আবার ১০ দিন সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ছয় মাসের জন্য পরিবারটিকে সমাজচ্যুত করে সালিসকারীরা। সাথে বাড়তি পাওনা হলো বিষয়টি নিয়ে পুলিশের কাছেও যাওয়া যাবে না।
এরপর?
এরপর সালিসে দাবি করা জরিমানার টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় মেয়েটির বাড়িতে চড়াও হয় নেতারা। নহাটা ইউনিয়নের সাবেক সদস্য ওবায়দুর রহমানের নেতৃত্বে কয়েকজন সেই বাড়ি থেকে একটা গরু, চারটা ছাগল, একটা সাইকেল, ভ্যান, শ্যালো মেশিনসহ বেশ কিছু জিনিস ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
খবর পেয়ে পুলিশ গেছে অবশেষে। শাহাবুলকেও ধরা হয়েছে।
সমাজ কতটা অসুস্থ কদর্য হয়ে উঠলে নারীর প্রেম শেষ পর্যন্ত প্রতারণা আর নির্যাতনে পরিনত হয়, তার এক বীভৎস গল্প এটি। ১৫ বছরের কিশোরীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক একটি অপরাধ। কারণ ১৫ বছরের নিচে যে কাউকে অপ্রাপ্তবয়স্ক ধরা হয় আইনে। সে হিসেবে মেয়েটির সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে তাকে গর্ভবতী করাটাই একটি অপরাধ। সেই অপরাধে অভিযুক্ত ১৯ বছরের পুরুষটিকে এই সমাজ অপরাধী মনে করে না। অপরাধ হয় সেই ১৫ বছরের বাচ্চা মেয়েটির, যে শারীরিক সম্পর্ক কী তা বোঝার আগেই গর্ভবতী হয়েছে, প্রতারিত ও চরম অপমানিত হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত পুরো সমাজের হাতে চূড়ান্ত নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আর গায়ে হাওয়া লাগিয়ে পুরুষটিকে ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি দিয়েছে ওই কদর্য সমাজ; তার জরিমানা হয়নি, শাস্তি হয়নি, নির্যাতন নিপীড়ন কিছুই হয়নি। কারণ সে পুরুষ। যৌনতৃপ্তি মেটানোর ইচ্ছেপূরণের জন্য সে যা কিছু করতে পারে এবং তার রক্ষক হিসেবে রয়েছে ওইসব সমাজপতিরা, যারা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়, ক্ষমতার বলয়ে বিষাক্ত সাপের মত চলে ফিরে বেড়াচ্ছে।
ঘটনাটির সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি। শাহাবুল, মোস্তফা সিদ্দিকি ও তার দলবল তো বটেই, সালিশে অংশ নেয়া গ্রামের শত শত অসভ্য লোককেও বিচারের আওতায় আনতে হবে। এরা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়, এরাই সমাজে বেড়ে ওঠা অন্ধকারকে পেলেপুষে যত্ন করে বিকৃতির মহীরুহ রচনা করে।
সবার বিচার হোক।