মেয়েরা কী চায়, আর সমাজ কী করতে বলে!
নায়না আক্তার।। আমাদের সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে মেয়েদেরকে তাচ্ছিল্য করা হয়। একটি কথা শোনা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যে, মেয়ে দেখতে কেমন? এই কথাটি সাধারণত একটি বিবাহের প্রসঙ্গে প্রথম প্রশ্ন করা হয়ে থাকে। কিন্তু কখনো তারা এটা প্রশ্ন করে না যে মেয়ে কী করে? মেয়েটির পড়াশোনা কি সম্পূর্ণ হয়েছে?
তবে ছেলেদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত। বলা হয়, ছেলেটির মাসিক আয় কত? ছেলেটির কী আছে? মেয়েটি যদি সুন্দর আর ছেলেটি যদি ভালো টাকা আয় করে তাহলেই দু-পক্ষের পরিবার ধন্য হয়ে যায়। তাহলে কি একটি মেয়ের সৌন্দর্যকে তারা টাকা দিয়ে কিনে নিচ্ছে?
তবে হ্যাঁ, মেয়েটির সৌন্দর্যও অনেক ক্ষেত্রে যথেষ্ট হয়ে ওঠে না। আমাদের সমাজে কিছু শ্রেণির মানুষ মনে করে, মেয়ের বয়স যদি বিশ পার হয় তাহলে তার জীবনও পার। তবে ছেলেদের বয়স যতই হোক না কেন এমনকি ত্রিশ এর বেশি হলেও কোনো সমস্যা নয়, যদি তাদের টাকা থাকে।
যদি কোন দম্পতির সন্তান না হয় তাহলে তারা মনে করে সমস্যা মেয়ের মধ্যেই রয়েছে। তারা এটা বুঝতে পারে না যে ছেলেরও শারীরিক অক্ষমতা থাকতে পারে। আমাদের সমাজে একটি মেয়ে যদি কারো প্রেমে পড়ে তাহলে সেটাকে পাপ বলে গণ্য করা হয়। একটি মেয়ের যদি ছেলে বন্ধু বা ছেলে সহপাঠী থাকে তাহলে সেটিকে অভিশাপ বলা হয়। তবে এক্ষেত্রে ছেলেদের বিষয়টি অন্য সকল বিষয়ের মতো সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ একটি ছেলে যদি একই সময়ে দশটি সম্পর্কেও জড়িয়ে থাকে, তাহলে সেটা নাকি তার পুরুষত্ব আকারে প্রকাশ পায়।তাদের এই কাজগুলোতে কারো মাথা ব্যথা থাকে না।
একটি মেয়ের গলায় বেশি জোর থাকা নাকি কলঙ্ক! মেয়েদের শব্দ যেন ঘরের বাইরে না পৌঁছায়। এক্ষেত্রে ছেলেদের গলায় যদি জোর না থাকে তাহলে নাকি তার পুরুষত্ব মর্যাদা বৃদ্ধি পায় না।
এখন আসা যাক শিক্ষা প্রসঙ্গে। একটি মেয়ে অনেক পড়াশোনা করছে বা করতে চায়। কিন্তু বিবাহের ক্ষেত্রে তাদের ঐ একটাই প্রশ্ন ‘মেয়ে দেখতে কেমন? মেয়ে কি রান্না করতে পারে? মেয়ে কি ঘরের কাজ জানে?’ তাদের এই সকল প্রশ্নের পিছনে একটাই কারণ, বিয়ের পর ঐ মেয়েটিকে মনপ্রাণ দিয়ে শুধু ঘরের কাজ করতে হবে। মেয়ে যতই শিক্ষিত হোক বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় না। জানতে চাওয়া হয় না যে তারা কী করতে চায় ভবিষ্যতে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় কি না! জানতে চাওয়া হয় না যে, তারা কি কোন চাকুরি করতে চায়? কারণ তাদের মনোভাব মেয়ে মানেই ঘরবন্দি। মেয়ে মানেই ঘরের কাজ সামলানো।
একটি ছেলেকে পড়াশোনার জন্য অনেক পথই খুলে দেয়া হয় পরিবার থেকে। তবে একটি মেয়েকে পথ খুলে দিলেও নানা সীমানা বেঁধে দেয়া হয়। একটিতে যদি সফলতা অর্জন করতে পারা সম্ভব না হয় তাহলে তার পরিনতি ঘরে বন্দি হয়ে থাকা।
এই সকল সমস্যার একটি মাত্র কারণ, তা হলো-নেতিবাচক মনোভাব। মেয়েদেরকে নরম, দুর্বল ভেবে যদি তাদেরকে ঘরবন্দি করে রাখা হয়, তাহলে এটি হবে সম্পূর্ণ ভুল। বর্তমানে যুগ বদলেছে। পাল্টে গেছে অনেকের মনোভাবও। তবে এরই মধ্যে দিয়ে সমাজের কিছু মানুষের নেতিবাচক চিন্তা প্রভাব ফেলে সকলের উপর।
একটি মেয়ের পোশাক-আশাক, তার শারীরিক গঠন সব কিছু সকলের চোখে পড়ে। তুলে ধরে নানান প্রশ্ন। এটা কেন? কারণ যার চোখে পড়ছে তার দৃষ্টি খারাপ। তার অন্তরে বিষ।তাদের চোখে কখনো সুন্দর কিছু পড়লেও তারা সেটাকে নেতিবাচক দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায়। আমরা যদি আমাদের মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টিয়ে ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলি তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে একটি শিক্ষিত জাতি গঠন করা সম্ভব হবে।
চাকরিক্ষেত্রে সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে নারী পুরুষে পার্থক্য অনেক। শিক্ষা অর্জনের জন্য ও একটি চাকরি পাওয়ার জন্য যতটুকু পড়াশোনার প্রয়োজন তা সময়সাপেক্ষ (তবে আমরা কিন্তু জানি পড়াশোনার শেষ নেই)। তা করতে করতে বয়সও বিশ পার হয়ে যায়। আবার যে মানুষেরাই ঐ মহান বাক্যটি বলে বেড়ায় শিক্ষিত জাতি, শিক্ষিত জাতি করে, তারাই আবার বলে ওঠে মেয়েদের বয়স বিশ পার তো জীবন পার। এবং তারাই আবার মেয়ে দেখতে গেলে প্রথম প্রশ্ন করে, ‘মেয়ে দেখতে কেমন?’
সমাজ মেয়েদের সুযোগ দেয় না। আবার দিলেও নানান কু-বার্তা দিয়ে বেড়ায়। চাকরির জন্য অথবা পড়াশোনার জন্য বাসা থেকে বের হলে আমরাই বলি, ‘মেয়ের কলিজা কত বড়।একা একা চলাফেরা করে। এর বাবা-মা কি কোন শিক্ষা দেয় নি?’
এই সমস্ত লোকদের কারণেই অনেক বাবা-মা তাদের ভালোবাসার সন্তানের স্বপ্নপূরণের দরজা বন্ধ করে দেন। কারণ তাদের ‘মুখলজ্জা’। সকলের কথার মাঝে তারা পড়তে রাজি নন।কারণ তাদের মান-সম্মান বিরাট ব্যাপার। তাহলে কি, ‘মেয়ে মানেই ঘরবন্দি?’
মেয়েরাও চায় সকলের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে। তারাও নিজে অর্জন করতে চায় সুন্দর সফল ভবিষ্যত। তাই বলবো, মেয়েদের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব রাখুন। চিন্তাভাবনা-বদলে ফেলুন। তবেই সুন্দর সমাজ গড়ে উঠতে পারবে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]