নিজের প্রয়োজন নিজ উপার্জনে মেটাতে পারি- এটা বড় পাওয়া
দেশের অর্থনীতিতে নারী উদ্যোক্তারা বড় ভূমিকা রাখছেন বর্তমানে। বিশেষ করে অনলাইনে নারী উদ্যোক্তাদের সপ্রতিভ বিচরণ ও সফলতা আমাদের মনে আশা জাগায়। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর নারী উদ্যোক্তাদের সংগ্রাম, অধ্যবসায়, পরিশ্রম, ত্যাগ ও আনন্দ-বেদনার গল্পগুলো তুলে ধরতে চায়। এই গল্পগুলোই আরো হাজার নারীকে উজ্জীবিত করবে, পথ দেখাবে। আজ রইলো ইসরাত জাহান তাতিয়া‘র গল্প।।
আমি ইসরাত জাহান তাতিয়া। কাজ করি টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতের শাড়ি নিয়ে।
আমার ফেসবুক পেজের নাম- তাঁতি আর তাঁত (www.facebook.com/tatiartant)।
বাবা মায়ের বাড়ি টাঙ্গাইল। থাকছি ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স করি। পরবর্তীতে স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে পরিবেশ বিজ্ঞানে দ্বিতীয় মাস্টার্স করি।
অনার্সে পড়ার সময়ই শুরু হয় চাকরি জীবন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত একটি গবেষণা সংস্থায় কাজের মাঝেই শুরু হয় পেশাগত জীবন। এর মাঝে বিয়ে, সন্তান। প্রথম সন্তানের ২ বছর বয়স যখন তখন থেকে শুরু হয় আমার চাকরি জীবনের অনিশ্চয়তা। সন্তানের দেখাশুনা করার কেউ না থাকা, অফিস রাজনীতি মানসিক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ততদিনে অন্য বোনেরাও মোটামুটি নিজেদের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। তাই কোন পিছুটান না থাকায় চাকরিতে ইস্তফা দেই।
প্রথম কিছুদিন বেশ মজাই লাগছিলো। একেবারে নতুন অন্যরকম জীবন। ২০১১ তে পেজ ওপেন করে একটু একটু করে কাজ শুরু করলেও তা ছিলো একেবারেই বন্ধুবান্ধবের মাঝেই সীমাবদ্ধ। কিছুদিন রেস্ট নিয়ে শুরু হলো পেজ-এর কাজ নিয়ে গবেষণা- বাজার গবেষণা করা, মার্কেট যাচাই-বাছাই করা, বাজার তৈরি করা, নিজের পণ্য নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা, নিজে নিজে পড়াশোনা করা।
২০১০/১১ এর দিকে শুধুমাত্র তাঁতের শাড়ি নিয়ে কাজ করে এমন কোন পেজ বা সাইট আমার নজরে আসে নি। কয়েকজন মাত্র উদ্যোক্তা দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করতেন তার মাঝে সব ধরনের শাড়ি, জামা ছিলো। নিজের এলাকার তাঁতের শাড়ির প্রতি ছিলো অন্য এক ধরনের মায়া, ভালোবাসা। তাই আমি পণ্য হিসেবে বেছে নেই টাঙ্গাইলের ট্রাডিশনাল তাঁতের শাড়ি। বিভিন্ন কারনে টাঙ্গাইল শাড়ি তার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য হারিয়ে শুধুমাত্র গরিবের শাড়ি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। ভালো কোয়ালিটির শাড়িগুলি অধিক মূল্যে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুমে পাওয়া যেত। আমার উদ্দেশ্য ছিলো টাঙ্গাইলের আসল গুণসম্মত শাড়ি সঠিক মুল্যে সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
প্রথমদিকে অনেক শাড়ি চিনতে সমস্যা হচ্ছিলো। ব্যাক্তিগত কারনে আমাকে প্রতি সপ্তাহে টাঙ্গাইলে যেতে হতো। তাই এই সুযোগে তাঁতপল্লীতে নিয়মিত যাওয়ার সুযোগ হলো। প্রথমে সরাসরি তাঁতিদের সাথে কাজ করার আগ্রহ নিয়ে পথ চলা শুরু করি। কিন্তু কিছুদিন যাতায়াত করেই বুঝে গেলাম অন্যান্য সকল সেক্টরের মতো এই যায়গায় ও আসলে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দখলে। তাঁতিরা বেশিরভাগ মহাজনের কাছে দায়বদ্ধ। সারা বছরের জন্য তাদের দাদন নেওয়া হয়। শাড়ি বুননের সকল মেটেরিয়ালস কিনে দেন মহাজনরা। তাঁতিরা শাড়ির বুননপ্রতি টাকা পায়। ৫০টা শাড়ি বুনে প্রতি সপ্তাহে অল্প করে করে টাকা পান মহাজনদের থেকে। অল্প কিছু তাঁতি হয়তো নিজেরাই বুনেন কিন্তু সেইগুলির মান, দাম, ডিজাইন সব কিছুতেই অসামঞ্জস্য থেকে যায়।
এভাবে খুঁজে খুঁজে সাহায্য করার মানসিকতা আছে এমন একজন মহাজনের সাথে পরিচিত হই। প্রথমে আমি ৫ হাজার টাকা নিয়ে শাড়ি কিনে আনি। সেই শাড়ির অধিকাংশই বন্ধু এবং পরিবারের সদস্যরা কিনেন। তার লাভ থেকেই আবার নতুন শাড়ি কিনে আনি। এই মহাজনের শোরুমে আমি ৫/৬ ঘন্টা করে বসে থাকতাম। বসে থেকে থেকে বিভিন্ন শাড়ির সুতা, শাড়ির রকম, কিভাবে ক্রেতাকে হ্যান্ডেল করছেন সব আয়ত্ত করার চেষ্টা করি। অনলাইনের বিষয়টা তখন ওনারা গুরুত্ব দিতেন না। তাদের ডিজাইনের শাড়ির ছবিও নিতে দিতেন না। আমার অধ্যবসায় জয়ী হয় এক সময়। তারা আমাকে বিশ্বাস করেন এবং প্রায় ৬০/৭০ হাজার টাকার পণ্য আমাকে বাকিতেও দিয়ে দিতেন। আমি অল্প অল্প করে শোধ করতাম। পরবর্তীতে তাদের ক্যাটালগ দিয়ে দিতেন আমাকে। এভাবে আস্তে আস্তে কাজের পরিধি বেড়ে যায়। ক্রেতারা সবসময়ই আমাকে অনেক সাপোর্ট করেছেন। ফেসবুকে কখনো কোনো বিজ্ঞাপন না দিয়ে শুধুমাত্র ক্রেতাদের রেফারেন্সে ধীরে ধীরে পরিচিতি বাড়ে।
কাজের যথেষ্ট চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আমার কাজ একটু ধীর গতিতেই চলে। প্রাধান্য ছিলো পরিবার। তাই সন্তানকে সময় দিয়ে তারপর যে সময়টুকু পেতাম সেই সময়টুকুই দিতাম ব্যবসায়। ২০১৫ সালে পারিবারিক জীবনে হঠাৎ নেমে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়। নতুন করে আবার চাকরিতে যোগ দিই। এই সময় অনলাইন থেকে আমাদের অফলাইনে পথ চলাও শুরু হয় কয়েকজন বন্ধুসহ পার্টনারশিপে। প্রায় দুই বছর আমরা অফলাইনে থাকি। সারাদিন অফিস করে সন্ধ্যায় বেইলি রোডের শোরুমে বসে রাত ৯ টায় বাসায় ফিরতাম। কাজ, বিনিয়োগ, অভিজ্ঞতা সব একটু একটু করে বাড়ছিলো। প্রজেক্ট এর শেষ হওয়ার কারনে চাকুরি থেকে অব্যহতি নিই আবার এবং চিন্তা করি নতুন কোন চাকরিতে না ঢুকে পুরো সময় ব্যবসায় দেওয়ার।
কিন্তু বিধির লিখন ছিলো অন্যরকম। তিনি হয়তো মুচকি হাসছিলেন আমার সিদ্ধান্ত দেখে। চাকরি ছাড়ার প্রথম মাসেই দ্বিতীয় সন্তানের আগমন সংবাদ পাই। এক বছরের মাথায় ব্যবসায় বেশ ক্ষতি হয়, পার্টনাররাও আর আগ্রহী হোন না ব্যবসা কন্টিনিউ করতে। তাই শোরুম ছেড়ে দেওয়া হয়। শোরুম ছাড়লে কী হবে? আমার তো মাথায় মগজে একটাই জিনিস। তাঁতের শাড়ি। মেয়ে একটু বড় হতে হতেই আবার শুরু করলাম অনলাইনে। দুই বছর পুরোপুরি অনলাইন থেকে দূরে ছিলাম। এর মাঝে অনেক অনেক পেজ দেশি শাড়ি নিয়ে কাস্টমাইজড কাজ করছিলেন। তারা দারুন দারুন কাজ করছিলেন। আমি ট্রাডিশনাল প্রোডাক্ট নিয়ে আগাতে বেশ ভয় পাচ্ছিলাম। আবারও আমার ক্রেতাবন্ধুরা আমাকে সাপোর্ট দিয়ে এগিয়ে নিলেন। প্রথম ৩/৪ মাস প্রোডাক্ট গোছানোতে গেলো। আবারও অনলাইনে শুরু করলাম যাচাই-বাছাই, মার্কেট এনালাইসিসের কাজ। তারপর শুরু হলো পথচলা নতুন করে- নতুন নামে।
সব্বাই এত সুন্দর সুন্দর কাস্টমাইজড কাজ করছিলেন, বেশ ভয় লাগছিল। প্রথম সন্তানের বড় হওয়ার সাথে সাথে ছিল প্রথম পেজ। নতুন নামে শুরু হল দ্বিতীয় সন্তানের বেড়ে ওঠার সাথে সাথে। আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমার ক্রেতাবন্ধু। ওনারা আমাকে হাল ছাড়তে দেন নি। সবার সাথে পারিবারিক সম্পর্কের মতো শক্ত ভিত তৈরি হয়েছে। নতুন করে পথ চলতে শুরু করে দেখি আমার কত ক্রেতা নিজেরাই এখন কাজ করছেন টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে। বাজার একটু প্রতিযোগিতামূলক হলেও তাদের সাফল্যে সবসময় ভালো লেগেছে। নিজেরা প্রতিযোগী না হয়ে পারস্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমে কাজ এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি।
আমার ক্রেতা, বন্ধু, পরিবার অনেকেই আমাকে বলেন- শাড়ি তো এখন তেমন কেউ পরেন না, তাও আবার ট্রাডিশনাল কম দামি শাড়ি, অন্য কিছু নিয়ে কাজ করো। নিজেও মাঝে মাঝে হাল ছেড়ে দেই। তারপর ঘুরে ফিরে আবার যা তাই। এখনও কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয় নি। ২০১৯-এ আবার বাঁধা। ছেলের স্কুল ভর্তির ঘোড়দৌড়ে নামলাম। এবং ঘোষণা দিয়েই ৬ মাস কাজ বন্ধ করলাম। জানুয়ারি ২০২০-এ নতুন করে পরিকল্পনা করে আবার কাজে যোগ দিলাম। ২০২০ এর ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখে ছোট্ট করে যাত্রা শুরু করলাম অফলাইনে- শুধুমাত্র অফিসিয়াল কাজকর্ম এবং মাঝে মাঝে ক্রেতাদের সাথে গল্প-আড্ডায় মেতে ওঠার জন্য। শুরুটা বেশ ভালোমতোই হচ্ছিলো। নতুন করে প্রোডাকশন, নতুন ইনভেস্টমেন্ট, নতুন পরিচয়। কিন্তু কপালের লিখন না যায় খণ্ডন। এক সপ্তাহের মাঝেই আবিষ্কার করলাম ব্যাক্তিজীবনে বেশ বড় রকমের একটা ঝড় এসেছে। কোন কুল-কিনারা পাচ্ছিলাম না। অনেক অসহায় লাগছিলো। আরো শক্ত করে নিজের কাজকে আঁকড়ে ধরলাম। লাভ হলো না। কোভিড-১৯ এসে সব আবার লণ্ডভণ্ড করে দিলো।
তবুও আশায় বুক বাঁধি। একদম নিজের চেষ্টায়, নিজের অর্থে আর বন্ধু-ক্রেতাদের সহায়তায় এখনও নিজের নামেই পরিচিতি পাই। অনেকে অবাক হন এত্ত আগে কাজ শুরু করেও না আছে মিডিয়ায় নাম-ধাম, না আছে সেলিব্রেটি খেতাব। কিন্তু আমার আফসোস নেই তাতে। কারণ আমার লক্ষ্য কখনোই তেমন কিছু ছিলো না। পরিবারকে পুরোপুরি সময় দিয়ে এই এত লম্বা সময়ে আমার নিজের প্রয়োজন নিজের উপার্জনের অর্থে মেটাতে পারি, আমার উপার্জনের উপর আমার সম্পূর্ণ অধিকার এটাই আমার অনেক বড় পাওয়া। আর আমার মাধ্যমে অল্প কয়েকজন লোকের কাজের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে সেটা ভেবেও অনেক মানসিক শান্তি পাই। একটা আফসোস আছে মনে। আমি কাজ শিখতে গিয়ে অনেকবার Mentor খুঁজেছি। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। পাইনি। সবার সহযোগিতা পেলে দুর্যোগ শেষে আবার শুরু করবো নতুন করে।